ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ অনেকবার চা-কফি হয়েছে। আর নয়। বরঞ্চ রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। বলে রীণার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
রীণা উৎফুল্ল হয়ে বলল, আপনি রাত্তিরে এখানে খাবেন? কী সৌভাগ্য! কিন্তু আমি তো রান্না করে খাওয়াতে পারব না।
কথার শেষে হতাশ ভাব ফুটে উঠল রীণার মুখে।
–ঠিক আছে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে আবার একদিন না হয় খাব।
রীণা ম্লান হাসল। মনে রাখবেন কিন্তু।
হ্যাঁ, নিশ্চয়। বলে ডাঃ রুদ্র চুরুট ধরালেন।
.
নটা বাজল।
ডাঃ রুদ্র নিচু গলায় বললেন, খুব ভাগ্য এক চান্সেই আমার বাড়ির লাইন পেয়ে গেলে। নইলে বাড়ি ফিরব না এই খবরটুকু দেবার জন্যে আবার বাড়ি ছুটতে হত।
সঞ্জয় কিছু বলল না। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল।
–কি হল? অমন করে রয়েছ যে?
–ওর অবস্থা কি খুবই খারাপ?
খারাপ বলব না। তুমি নিজে ডাক্তার। প্রেসার তো দেখলে। ফল্স করছে। তাই ভাবলাম রাত্তিরে যদি আরো কিছু হয় তুমি একা নার্ভাস হয়ে পড়বে। সেজন্যেই থেকে গেলাম। তাছাড়া বলা যায় না যদি আজ রাত্রে ও কিছু দেখেটেখে? দুর্বল শরীর
পাশের ঘর থেকে রীণা ডাকল–একবার আসবে?
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠে গেল।
মৃদু আলো জ্বলছে। ধবধবে বিছানায় গলা পর্যন্ত সাদা ওয়াড় পরানো লেপ ঢাকা দিয়ে রীণা শুয়ে আছে। সঞ্জয় কাছে আসতেই রীণা তাকালো–
-কি বলছ?
–উনি খেয়েছেন তো?
-হুঁ।
–কিই বা খেলেন! ভারি লজ্জা করছে আমার।
–লজ্জার কি! তুমি সেরে উঠলে ভালো করে খাওয়াব।
রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না উনি রাত্তিরে এখানে থাকবেন কেন? সত্যি বলো আমার অবস্থা কি খারাপের দিকে যাচ্ছে?
সঞ্জয় হেসে উঠল। আরে না–না। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছ।
–তা হলে উনি থাকছেন কেন?
–এমনিই। বললেন, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করছে না।
রীণা অবিশ্বাসের সুরে বলল, বাড়িতে কেউ না থাকলে লোকে কি বাইরে রাত কাটায়? ডাক্তারের বাড়ি বলে তো চোর-ডাকাতে খাতির করবে না।
সঞ্জয় হাই তুলে বলল, তা হয়তো ঠিক। তবে এও ওঁর একটা খেয়াল। হয়তো স্টকে নতুন কোনো গল্প জমেছে। রাত জেগে শোনাবেন।
কথাটা রীণার মনে ধরল না। বলল, আমার ধারণা নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে থাকতে চাইছেন।
রীণা একটু চুপ করল। সঞ্জয় কিছু বলার আগেই বলল, আমার মনে হয় আজই শনিবার। সত্যি করে বললো না গো!
–দূর! তোমার কেবল সেই এক কথা–শনিবার–শনিবার–সাড়ে নটা বাজল। একটু ঘুমোও তো।
–এত তাড়াতাড়ি ঘুমোব? যদি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়?
–ভাঙবে না। তুমি ঘুমোও।
রীণা ঘুমোবার জন্যে পাশ ফিরল। তারপরেই জিজ্ঞেস করল, পুপু কি করছে?
–ঘুমোচ্ছে।
–মশারি টাঙিয়ে দিয়েছ তো?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার কোনো চিন্তা নেই। এবার তুমি একটু ঘুমোও।
বলে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে চলে এল।
.
রাত সাড়ে দশটা।
বাইরের ঘরে সঞ্জয় আর ডাক্তার রুদ্র। ডিভানের ওপরে ডাক্তার রুদ্র র্যাগ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। মাটিতে শুয়েছে সঞ্জয়।
ডাক্তার রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ? তুমি অবশ্য আমার সামনে স্বচ্ছন্দে স্মোক করতে পার।
সঞ্জয় সে কথায় সাড়া না দিয়ে বলল, ও তত বেশ সামলে উঠেছিল। হঠাৎ এমন হল কেন?
ডাঃ রুদ্র বললেন, আমি তো তোমায় বলেছি এবাড়ি না ছাড়লে ও কখনন একেবারে সুস্থ হবে না। পুপুও ভালো নেই। কেমন Pale হয়ে যাচ্ছে। কেন?
সঞ্জয়ের বুকটা কেঁপে উঠল। উত্তর দিতে পারল না।
–সত্যি হোক মিথ্যে হোক এবাড়ির সঙ্গে ওর মানসিকতার সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে ওর subconscious মনে সবসময় একটা আতঙ্ক দানা বেঁধে রয়েছে। তার থেকে ওর নিষ্কৃতি নেই। ওষুধ দিয়ে ওকে আর সুস্থ করা যাবে না।
–আমি ভাবছি, এত দুর্বল হয়ে পড়ল কেন? সন্ধের সময়ে বলছিল–কিছুই মনে করতে পারছে না। সব যেন খেই হারিয়ে ফেলছে।
ডাঃ রুদ্র বললেন, শুধু শরীর নয়, মনও অসুস্থ হলে দুর্বল হয়ে পড়বেই।
একটু থেমে বললেন, আচ্ছা, আজ যে শনিবার ও জানে না তো?
সঞ্জয় বলল, না। তবে আজই শনিবার কিনা বার বার জিজ্ঞেস করছিল। ক্যালেন্ডার দেখতে চাইছিল। আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম।
ডাঃ রুদ্র বললেন, ভালো করেছ। ও যদি জানতে পারে আজ সেই শনিবার তাহলে একেবারে ভেঙে পড়বে।
–কিন্তু ক্যালেন্ডার সরিয়ে রেখেও নিস্তার নেই। আমায় অনেক জেরা করল।
–কিরকম?
–জানতে চাইল আপনি রাত্তিরে হঠাৎ এখানে থাকছেন কেন? বললাম কাকীমা এখানে নেই-বাড়ি খালি। তাই যেতে চাইলেন না। ও বিশ্বাস করল না। ওর ধারণা হয় ওর অবস্থা ভালো নয়, না হয় নিশ্চয় আজ সেই শনিবার বলে আপনি রাতে এখানে থাকছেন।
ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এসব চিন্তা ওর মাথায় ঢুকলে তো মুশকিলের কথা।
সঞ্জয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল।–মুশকিল কেন বলছেন?
–জান তো ওর হার্ট কিরকম দুর্বল। প্রেসারও অনেক কম। তার ওপর যদি হঠাৎ ও ভয় পায়–
সঞ্জয় ব্যাকুল হয়ে বলল, তাহলে
আমরা তো ওর পাশেই রয়েছি। সব রকম ব্যবস্থাই করে রেখেছ। দেখা যাক।
ঘড়িতে এগরোটা বাজল।
ডাক্তার রুদ্র টেবিল-লাইট জ্বেলে একটা বই পড়ছিলেন। বইটা মুড়ে রেখে বললেন, যদি আজ রাত্রে সত্যিই কেউ আসে তাহলে হাতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক সময়।