আজ হরতালের কত দিন চলছে? মনে হচ্ছে সবাই দিন-তারিখের হিসেব রাখা ভুলে গেছে। নগরীর জন্ডিস হয়েছে। নগরী পড়ে আছে ঝিম মেরে। এই রোগের চিকিৎসা নেই– বিশ্রামই একমাত্র চিকিৎসা । নগরী বিশ্রাম নিচ্ছে। আগের হরতালগুলিতে মোটামুটি আনন্দ ছিল । লোকজন ভিডিও ক্যাসেটের দোকান থেকে ক্যাসেট নিয়ে যেত। স্বামীরা দুপুরে স্ত্রীদের সঙ্গে ঘুমানোর সুযোগ পেত। স্ত্রীরা আঁতকে উঠে বলত- এ কী! দিনে-দুপুরে দরজা লাগাচ্ছ কেন? বাড়িভরতি ছেলেমেয়ে। স্বামী উদাস গলায় বলত, আজ হরতাল না?
এখনকার অবস্থা সেরকম না, এখন অন্যরকম পরিবেশ। জন্ডিসে আক্রান্ত নগরী রোগ সামলে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারবে তো— এটাই সবার জিজ্ঞাসা । নাকি নগরীর মৃত্যু হবে? মানুষের মতো নগরীরও মৃত্যু হয়।
আমি হাঁটছি। আমার পাশে পাশে হাঁটছে বাদল । আমি বললাম— দীর্ঘ হরতালের কিছু-কিছু উপকারিতা আছে। বল তো কী কী?
‘রোড অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে না ।”
‘গুড– হয়েছে। আর কী?’
‘পলিউশন কমেছে- গাড়ির ধোয়া, কার্বন মনক্সাইড কিছু নেই।’
‘ভেরি গুড ।’
‘লোকজন বেশি হাঁটাহাঁটি করছে, তাদের স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা কমছে।’
‘হয়েছে- আর কী?’
‘আরবদের কাছ থেকে আমাদের পেট্রোল কিনতে হচ্ছে না। কিছু ফরেন কারেন্সি বেঁচে যাচ্ছে ।’
‘হুঁ।’
আমরা পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারছি। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে।
‘হুঁ।’
‘পলিটিক্স নিয়ে সবাই আলোচনা করছি- আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশ নিয়ে সবাই ভাবছি।’
‘আর কিছু আছে?’
‘আর তো কিছু মনে পড়ছে না।’
আরও অনেক আছে। ভেবে ভেবে সব পয়েণ্ট বের কর, তারপর একটা লিফলেট ছাড়ব।’
‘তাতে লাভ কী?’
‘আছে, লাভ আছে।’
‘তোমার ভাবভঙ্গি আমি কিছুই বুঝি না। তুমি কোন দলের লোক বলো তো! আওয়ামী লীগ, না বিএনপি?
‘আওয়ামী লীগ যখন খারাপ কিছু করে তখন আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। আর বিএনপি যখন খারাপ কিছু করে তখন বিএনপির সমর্থক।’
‘এর মানে কী?
‘ভালো কাজের সমর্থন সবসময়ই থাকে। খারাপ কাজগুলির সমর্থনের লোক পাওয়া যায় না। আমি সেই লোক । খারাপ কাজের জন্যেও সমর্থন লাগে । কারণ সব খারাপের মধ্যেও কিছু মঙ্গল থাকে।’
‘আমরা যাচ্ছি কোথায় হিমুদা?’
‘একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
‘কে? মারিয়া?’
‘উহুঁ, তার নাম জয়গুন ।’
‘জয়গুন কে?’
‘তুই চিনবি না- খারাপ ধরনের মেয়ে।’
‘ও আচ্ছা |’
বাদল চমকাল না বা বিক্ষিত হলো না । সে আমার আদর্শ ভক্ত । দলপতির কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে কিছু বলবে না। বিস্মিত হবে না, চমকাবে না। অন্ধের মতো অনুসরণ করবে। একদল মানুষ কি শুধু অনুসরণ করার জন্যেই জন্মায়?
প্রথম তিনটা টোকা, তারপর একটা, তারপর আবার তিনটা । এরকম করতে থাকলে জয়গুন নামের অতি রূপবতী এক তরুণীর এসে দরজা খুলে দেবার কথা। যার শাড়ি থাকবে এলোমেলো। যার ব্লাউজের দুটা বোতাম নেই- ।
বেশ কয়েকবার মোর্স কোডের ভঙ্গিতে তিন এক তিন এক শব্দ করার পর দরজা সামান্য খুলল। সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে না দরজা কে খুলেছে। কানা কুদ্দুস বলে দিয়েছিল, দরজা খুলবে জয়গুন । সেই ভরসাতে আন্দাজের উপর বললাম, কেমন আছ জয়গুন?
ভেতর থেকে তীক্ষ কণ্ঠ ভেসে এল- আপনে কে?
‘আমার নাম হিমু।’
দরজা খুলে গেল। আমার সামনে জয়গুন দাঁড়িয়ে আছে। তার শাড়ি মোটেও এলোমেলো নয়। তার ব্লাউজের বোতামও ঠিক আছে। খুব রূপবতী মেয়ে দেখব বলে এসেছিলাম, দুধে আলতা রঙের একজনকে দেখছি— রূপবতী বলার কোনো কারণ নাই। দাঁত উঁচু। যথেষ্ট মোটা। থপথপ করে হাঁটছে। একেক জনের সৌন্দর্য একেক রকম। কুদ্দুসের কাছে জয়গুন হলো- হেলেন অভ ট্রয়। জয়গুন মধুর গলায় বলল, ও আল্লা, ভিতরে আসেন।
‘আমি সঙ্গে করে আমার এক ভাইকে নিয়ে এসেছি। ওর নাম বাদল ।’
‘অবশ্যই আনবেন। ছোট ভাই আসো।’
জয়গুন হাত ধরে বাদলকে ভেতরে নিয়ে গেল। বাদল সংকুচিত হয়ে রইল। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে জয়গুনের ঘর দেখছি। সাজানো-গোছানো ঘর। রঙিন টিভি আছে। ভিসিআর আছে। এই মুহুর্তে ভিসিআর-এ হিন্দি ছবি চলছে।
জয়গুন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সময় কাটে না, এইজন্যে রোজ তিনটা-চাইরটা কইরা ছবি দেখি। আপনেরা আরাম কইরা বসেন। এসি ছাড়ি?
‘এসি আছে?’
‘জি আছে। ঠাণ্ডা বাতাসে শইল্যে বাত হয়, এইজন্য এসি ছাড়ি না। ফ্যান দিয়া কাম সারি।’
‘আমাদের জন্যে এসি ছাড়বে— এতে তোমার আবার বাত হবে না তো?’
‘কী যে কন হিমু ভাইজান! অল্প সময়ে আর কী বাত হইব!’
‘অল্প সময় তো না- আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। এসেছি যখন ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় ভিসিআর-এ একটা ছবি দেখে যাই । অনেকদিন হিন্দি ছবি দেখা হয় না । তোমার অসুবিধা হবে?’
‘কী যে কন ভাইজান আপনে সারাজীবন থাকলেও অসুবিধা নাই ।’
‘তুমি একা থাক?’
‘হ, একাই থাকি।’
‘রান্নাবান্না কে করে?’
‘কেউ করে না । হোটেল থাইক্যা খাওন আসে । কাজকামের লোক রাখন আমার পুষায় না। খালি ভ্যানভ্যান করে । আমার হোটেলের সাথে কনটাক ।
‘ভালো ব্যবস্থা তো”
‘“কপি” খাইবেন?– কপি বানানির জিনিস আছে।’
‘হ্যা, “কপি” খাওয়া যায়।’
জয়গুন অতি ব্যস্ততার সঙ্গে “কপি” আনতে গেল । আমি জয়গুনের বিছানায় পা বোস। একটা হিন্দি ছবি দেখি । দুদিন পর গায়ে কেরোসিন ঢেলে মরে যাবি– হিন্দি ছবি দেখে মনটা ঠিকঠাক কর ।
‘তুমি কি সত্যিসত্যি ছবি দেখবে?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি চিনি না— কানা কুদ্দুস চেনে।’
‘কানা কুদ্দুস কে?’
‘ভয়াবহ খুনি। মানুষ মারা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। মশা মারার মতোই সহজ।’
‘এই ভদ্রমহিলা ওনার স্ত্রী?’
‘প্রায় সেরকমই। জয়গুন কুদ্দুসের বনলতা সেন।’
‘ভদ্রমহিলা কী সুন্দর দেখেছ হিমুদা?’
‘সুন্দর?’
‘আমি এত সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে দেখিনি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, যতই দেখছি- ততই অবাক হচ্ছি।’
‘তোর মনে হচ্ছে না দাঁতগুলি বেশি উঁচু?’
‘তোমার দাঁতের দিকে তাকাবার দরকার কী?’
‘তাও তো বটে। দাঁতের দিকে তাকাব কেন? হাতি হলে দাঁতের দিকে তাকানোর একটা ব্যাপার চলে আসত। গজদন্ত বিরাট ব্যাপার। মানবদন্ত তেমন কোনো ব্যাপার না। মানবদন্তের জন্ম হয় ডেনটিক্টের তুলে ফেলার জন্যে।’
‘তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘বোঝার দরকার আছে?” ‘না, দরকার নেই।’
জয়গুন মগে করে “কপি” নিয়ে এসেছে। এক এক মগে এক এক পোয়া করে চিনি দিয়ে বানানো ঘন এক সিরাপজাতীয় বস্তু। আমি মুখে দিয়ে বললাম অপূর্ব আমি যা করি বাদলও তা-ই করে। কাজেই বাদলও চোখ বড় বড় করে বলল, অপূর্ব!
জয়গুনের সুন্দর মুখ আনন্দে ভরে গেল। সে বলল, ছবি দেখবেন ভাইজান?
‘হ্যা দেখব । ভালো একটা-কিছু দাও।’
পুরানো ছবি দেখবেন? দিদার আছে- দিলীপকুমারের ছবি।’
‘দিলীপকুমারের ছবি দেখা যেতে পারে।’
‘বেলেক এন্ড হোয়াইট।’
‘শাদা-কালোর কোনো অসুবিধা নেই- তারপর জয়গুন, কুদ্দুসের কোনো খবর জান?’
‘জি না । মেলা দিন কোনো খোঁজ নাই। বুঝছেন ভাইজান, মানুষটার জন্য অত অস্থির থাকি- হে বুঝে না। কোনদিন কোন বিপদে পড়ে! বিপদের কি কোনো মা-বাপ আছে? সবকিছুর মা-বাপ আছে বিপদের মা-বাপ নাই। তারে কে বুঝাইবে কন? আফনেরে খুব মানে। যখন আসে তখনই আফনের কথা কয়। ভাইজান!’
‘বলো,’
‘আফনে তার জন্যে এটু দোয়া করবেন ভাইজান ।’
‘আমার দেয়াতে কেনে লাভ হবে না জয়গুণ। সে ভয়ংকর সব পাপ করে বেড়াচ্ছে। সেই পাপের শাস্তি তো হবেই।’
‘মৃত্যুর পরে আল্লাহপাক শাস্তি দিলে দিব। এই দুনিয়ায় শান্তি হইব এইটা কেমন বিচার?’
‘এটা হচ্ছে জনতার বিচার । আল্লাহপাক কিছু কিছু শাস্তি জনতাকে দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। মানুষ ভুল করে- জনতা ভুল করে না।’
জয়গুন ছবি চালিয়ে দিয়েছে। তার চোখভরতি পানি। কানা কুদ্দুসের মতো একটি ভয়াবহ পাপীর জন্যে জয়গুনের মতো একটি রূপবতী মেয়ে চোখের পানি ফেলছে— কোনো মানে হয়? হয় নিশ্চয়ই– সেই মানে বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।
ছবি চলছে। আমি, বাদল এবং জয়গুন ছবি দেখছি। জয়গুন ছবি দেখছে গভীর আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে আশ্চর্য। বাদলও তা-ই করছে।
শামসাদ বেগমের কিন্নরকষ্ঠের গান শুরু হলো- ‘বাচপানকে দিন তুলানা দেনা।’
বাদলের চোখে পানি । দুদিন পর গায়ে আগুন লেগে যার মরার কথা সে ছবি দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে- কোনো মানে হয়?
“বাদল!”
‘জি!’
‘তোর গায়ে কেরোসিন ঢালার ব্যাপারটা মনে হয় তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা দরকার । আর দেরি করা যায় না।’
‘কেন?’
‘দেশ ঠিক হয়ে যাচ্ছে। সব স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে । যা করার তার আগেই করতে হবে।’
‘দেশ ঠিক হয়ে যাচ্ছে কে বলল?’
‘মাঝে মাঝে আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই ।’
বাদল কিছু বলল না। আমার কথা সে শুনতে পায়নি। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় এখন দিলীপকুমারের কর্মকাণ্ডে নিবেদিত। আমি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যেতে পারে। হিন্দি আমি বুঝি না। ওদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাদল এবং জয়গুনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে- ছবি দেখার জন্যে হলেও হিন্দি শেখার দরকার ছিল । আমি শুনেছি হিন্দি খুব নাকি মিষ্টি ভাষা। আমার মনে হয় না। লেডিস টয়লেটের হিন্দি হচ্ছে- “দেবীও কী হাগন কুঠি” অর্থাৎ “দেবীদের হাগাঘর”। যে-ভাষায় মেয়েদের বাথরুমের এত কুৎসিত নাম সেই ভাষা মিষ্টি হবার কোনো কারণ নেই। আমি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম – ০৯
অনেকদিন পর বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি খুব চিন্তিত মুখে আমার বিছানায় বসে আছেন। গায়ে খন্দরের চাদর । হাত দুটা কোলের উপরে ফেলে রাখা । চোখে চশমা । চশমার মোটা কাচের ভেতর থেকে তার জ্বলজ্বল্লেংচোখ দেখা যাচ্ছে। আমি বাবাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসলাম ।
বাবা বললেন, কেমন আছিস হিমু?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, খুব ভালো আছি বাবা ।
বাবা নিচু গলায় বললেন, তুই তো সব গণ্ডগোল করে ফেলেছিস । এত শখ ছিল তুই মহাপুরুষ হবি। এত ট্রেনিং দিলাম…
‘টেনিং দিয়ে কী আর মহাপুরুষ বানানো যায় বাবা?’
‘ট্রেনিং দিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারলে মহাপুরুষ বানানো যাবে না কেন? অবশ্যই যায়। ট্রেনিং ঠিকমতো দিতে পারলে..’
‘তা হলে মনে হয় তোমার ট্রেনিং-এ গণ্ডগোল ছিল।’
‘উহুঁ, ট্রেনিং-এ কোনো গণ্ডগোল নেই। তুই নিয়মকানুন মানছিস না। মহাপুরুষের প্রথম শর্ত হলো- কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপর মায়া করবি না। মায়া হবে সর্বজনীন । মায়াটাকে ছড়িয়ে দিবি ।’
‘তা-ই তো করছি!’
‘মোটেই তা করছিস না। তুই জড়িয়ে পড়ছিস । মারিয়াটা কে?’
‘মারিয়া হচ্ছে মরিয়ম |’
‘তুই এই মেয়ের সঙ্গে এমন জড়ালি কেন?’
‘জড়াইনি তো বাবা! আমি ওর সাংকেতিক চিঠির জবাব পর্যন্ত দিইনি। ও চিঠি দেবার পর ওর বাসায় যাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছি।’
‘এটাই কি প্রমাণ করে না তুই জড়িয়ে পড়েছিস? মেয়েটার মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিস ।’
‘তুমি কি তার বাসায় যেতে বলছ?’
‘অবশ্যই যাবি।’
‘কিন্তু বাবা, একটা ব্যাপার কী জান? আমার ধারণা, এই যে স্বপ্নটা দেখছি এটা আসলে দেখছি আমার অবচেতন মনের কারণে। আমার অবচেতন মন চাচ্ছে আমি মারিয়ার সঙ্গে দেখা করি। সেই চাওয়াটা প্রবল হয়েছে বলেই সে তোমাকে তৈরি করে স্বপ্নে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। তুমি আমাকে মারিয়ার বাসায় যেতে বলছ। তুমি আমার অবচেতন মনেরই একটা ছায়া। এর বেশি কিছু না ।’
‘তা হতে পারে।’
‘আমার অবচেতন মন যা চাচ্ছে, তা-ই তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে।’
‘হুঁ, যুক্তির কথা।’
‘মহাপুরুষরা কি যুক্তিবাদী হন বাবা?’
‘তাদের ভেতর যুক্তি থাকে, কিন্তু তারা যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হন না।’
‘কেন?’
‘কারণ যুক্তি শেষ কথা না। শেষ কথা হচ্ছে চেতনা, Conscience.’
‘চেতনা কি যুক্তির বাইরে?’
‘যুক্তি চেতনার একটা অংশ, কিন্তু খুব ক্ষুদ্রংশ। ভালো কথা, মারিয়া মেয়েটা দেখতে কেমন?’
‘খুব সুন্দর। আমি এত সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে দেখিনি।’
‘চুল কি কোকড়ানো, না প্লেইন?’
‘চুল কোঁকড়ানো।’
‘তোর মা’র চুলও ছিল কোঁকড়ানো। সে অবিশ্যি দেখতে শ্যামলা ছিল। যা-ই হোক মারিয়া মেয়েটা লম্বা কেমন?’
‘গজ ফিতা দিয়ে তো মাপিনি, তবে লম্বা আছে।’
মুখের শেপ কেমন? গোল না লম্বাটে?”
‘লম্বাটে ।”
“চোখ কেমন?’
‘চোখ খুব সুন্দর।’
‘চোখ কি খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছিস? একটা মানুষের ভেতরটা দেখা যায় চোখের দিকে তাকিয়ে । তুই কি চোখ খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছিস?’
‘হুঁ।’
‘আচ্ছা হিমু শোন- মেয়েটার ডান চোখ কি বা চেখের চেয়ে সামান্য বড়?’
‘হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে?’
‘তোর মা’র চোখ এইরকম ছিল । আমি যখন তাকে ব্যাপারটা বললাম— ও তো কেঁদেকেটে অস্থির। আমাকে বলে কি, কাজল দিতে গিয়ে এরকম দেখাচ্ছে। একটা চোখে কাজল বেশি পড়েছে- একটায় কম পড়েছে।’
“মা চোখে কাজল দিত?’
‘হ্যাঁ শ্যামলা মেয়েরা যখন চোখে কাজল দেয় তখন অপূর্ব লাগে।’
‘বাবা!’
‘হুঁ?’
‘এই যে মারিয়া সম্পর্কে তুমি জানতে চাচ্ছ, কেন?’
‘তোর মা’র সঙ্গে মেয়েটার মিল আছে কিনা তা জানার জন্যে ।’
‘বাবা শোনো, তুমি এতসব জানতে চাচ্ছ, কারণ মেয়েটার বিষয়ে আমার নিজের কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমার অবচেতন মন সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্যে তোমাকে নিয়ে এসেছে।’
‘হতে পারে।’
‘হতে পারে না। এটাই হলো ঘটনা। তুমি আমার নিজের তৈরি স্বপ্ন ছাড়া কিছু না।’
‘পুরো জগৎটাই তো স্বপ্ন রে বোকা!’
‘তুমি সেই স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন। আমি েখন আর স্বপ্ন দেখতে চাচ্ছি না। আবাম করে ঘুমাতে চাচ্ছি।’
‘চলে যেতে বলছিস?’
‘হ্যাঁ, চলে যাও।’
‘তুই ঘুমা, আমি পাশে বসে থাকি।’
‘কোনো দরকার নেই বাবা । তুমি বিদেয় হও ।’
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বিষন্ন মুখে চলে গেলেন। তার পরপরই আমার ঘুম ভাঙল। মনটা একটু খারাপই হলো । বাবা আরও কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকলে তেমন কোনো ক্ষতি হতো না ।
আমার বাবা তার পুত্রের জন্যে কিছু উপদেশবাণী রেখে গিয়েছিলেন। ব্রাউন প্যাকেটে মোড়া সেইসব উপদেশবাণীর উপর লেখা আছে কত বয়সে পড়তে হবে। আঠারো বছর হবার পর যে-উপদেশবাণী পড়তে বলেছিলেন—তা হলো!