ঘুম ভেঙে দেখি চোখের সামনে হুলস্থূল ধরনের বাড়ি। প্রথম দর্শনে মনে হলো বাড়িতে আগুন ধরে গেছে। বুকে একটা ছোটখাটো ধাক্কার মতো লাগল। পুরো বাড়ি বোগেনভিলিয়ার গাঢ় লাল রঙে ঢাকা । হঠাৎ ঘুম ভাঙায় ফুলের রঙকে আগুন বলে মনে হচ্ছিল ।
মারিয়া বলল, বাড়ির নাম মনে করে রাখুন- চিত্ৰলেখা। চিত্ৰলেখা হচ্ছে আকাশের একটা তারার নাম ।
আমি বললাম, ও আচ্ছা।
‘আজ বাড়িতে কেউ নেই। মা গেছেন রাজশাহী ।’
আমি আবারও বললাম, ও আচ্ছা।
‘আপনি কি টাকাটা নিয়ে চলে যাবেন, না একটু বসবেন?’
‘টাকা নিয়ে চলে যাব।’
‘বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন না?’
‘না ।’
‘তা হলে এখানে দাঁড়ান।’
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা আগ্রহ করেই আমাকে এতদূর এনেছে, কিন্তু আমাকে বাড়িতে ঢোকানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমি তাতে তেমন অবাক হলাম না। আমি লক্ষ করেছি বেশিরভাগ মানুষই আমাকে বাড়িতে ঢোকাতে চায় না। দরজার ওপাশে রেখে আলাপ করে বিদায় করে দিতে চায়। রাস্তায়-রাস্তায় দীর্ঘদিন লোকজনদের কেউ ঘরে ঢোকাতে চায় না। রাস্তা-ভাবের লোক রাস্তাতেই ভালো । কবিতা আছে না–
বন্যেরা বনে সুন্দর
শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
আমি সম্ভবত রাস্তাতেই সুন্দর।
‘হিমালয় সাহেব!’
আমি তাকালাম। বাড়ির ভেতর থেকে মারিয়া ইন্সটিমেটিক ক্যামেরা-হাতে বের হয়েছে। বের হতে অনেক সময় নিয়েছে, কারণ সে শাড়ি বদলেছে। এখন পরেছে স্কার্ট। স্কার্ট পরায় একটা লাভ হয়েছে। মেয়েটা যে অসম্ভব রূপবতী তা পরিস্কার হয়ে গেছে।
শাড়িতে যেমন অপূর্ব লাগছিল স্কার্টেও তেমন লাগছে। দীর্ঘ সময় গেটের বাইরে রোদে দাড়িয়ে থাকার কষ্ট মেয়েটাকে দেখে একটু যেন কমল ।
‘আপনি সূর্যকে সামনে রেখে একটু দাঁড়ান। মুখের উপর সানলাইট পড়ুক । আপনার ছবি তুলব। বাবাকে ছবির একটা কপি পাঠাতে হবে। ছবি দেখলে বাবা বুঝবেন যে, আমি আসল লোকই পেয়েছিলাম।’
‘হাসব?’
‘হ্যাঁ, হাসতে পারেন।’
‘দাঁত বের করে হাসব, না ঠোঁট টিপে?’
‘যেভাবে হাসতে ভালো লাগে সেভাবেই হাসুন । আর এই নিন টাকা ।’
মারিয়া একশো টাকার দুটা নোট এগায়ে দিল। দুটাই চকচকে নোট। বড়লোকদের সবই সুন্দর। আমি অল্প যে-ক’জন দারুণ বড়লোক দেখেছি তাদের কারও কাছেই কখনো ময়লা নোট দেখিনি। ময়লা নোটগুলি এরা কি ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে ইন্ত্রি করে ফেলে? নাকি ডাক্টবিনে ফেলে দেয়?
‘আমি আপনার বাবাকে একশো টাকা দিয়েছিলাম।’
বাবা বলে দিয়েছেন যদি আপনার দেখা পাই তা হলে যেন দুশো টাকা দিই। কারণ, গ্রন্থসাহেব বই-এ গুরু নানক বলেছেন-
দুগুণা দত্তার
চৌগুণা জুজার।
দুগুণ নিলে চারগুণ ফেরত দিতে হয়। বাবা সামনের মাসের ১৫ তারিখের পর আসবেন । আপনি তখন এলে খুশি হবেন। আর বাবার সঙ্গে কথা বললে আপনার নিজেরও ভালো লাগবে।’
‘আমার ভালো লাগবে সেটা কী করে বলছেন?’
‘অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বাবার সঙ্গে যে পাচ মিনিট কথা বলে সে বারবার ফিরে আসে ।”
‘ও আচ্ছা ।’
‘ও আচ্ছা বলা কি আপনার মুদ্রাদোষ? একটু পরপর আপনি ও আচ্ছা বলছেন।’
‘কিছু বলার পাচ্ছি না বলে “ও আচ্ছা” বলছি।’
‘বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসবেন তো?’
‘আসব।’
‘আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে- যে-প্রশ্নের জবাব আপনি জানেন না— সেই প্রশ্ন বাবার জন্যে নিয়ে আসতে পারেন। আমার ধারণা, আমার বাবা এই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব প্রশ্নের জবাব জানেন।’
আমি যথাসম্ভব বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বললাম-ও আচ্ছা!
মারিয়া বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বাড়ির দারোয়ান গেট বন্ধ করে মোটা মোটা দুই তালা লাগিয়ে দিয়ে জেলের সেন্ট্রির মতো তালা টেনে টেনে পরীক্ষা করতে লাগল। আমি হাতের মুঠোয় দুটা চকচকে নোট নিয়ে চৈত্রের ভয়াবহ রোদে রাস্তায় নামলাম। মারিয়া একবারও বলল না–কোথায় যাবেন বলুন, গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে। বড়লোকদের ঠাণ্ডা গাড়ি মানুষের চরিত্র খারাপ করে দেয়- একবার চড়লে শুধুই চড়তে ইচ্ছা করে। ফিরতে ইচ্ছা করছে না ।
আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো আষাঢ় মাসে। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবা হয়ে ওঁদের বাড়িতে গিয়েছি। দারোয়ান কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। ভাগ্যক্রমে মারিয়া এসে পড়ল। বড়লোকরা বোধহয় কিছুতেই বিক্ষিত হয় না। কাকভেজা অবস্থায় আমাকে দেখেও একবারও জিজ্ঞেস করল না— ব্যাপার কী? সহজ ভঙ্গিতে সে আমাকে নিয়ে গেল তার বাবার কাছে। বিশাল একটা ঘরে ভদ্রলোক খালিগায়ে বিছানায় বসে আছেন। অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসা । তাঁর চোখ একটা খোলা বইয়ের দিকে। দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোক গভীর মনোযোগে বই পড়ছেন। আমরা দুজন যে ঢুকলাম তিনি বুঝতেও পারলেন না । মারিয়া বলল, বাবা, একটু তাকাবে?
ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, তাকাব। বলার পরেও তাকালেন না। যে-পাতাটা পড়ছিলেন সে-পাতাটা পড়া শেষ করে বই উলটে দিয়ে তারপর তাকালেন। তাকিয়ে হেসে ফেললেন। আমি চমকে গেলাম। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়! তৎক্ষণাৎ মনে হল–ভাগ্যিস মেয়ে হয়ে জন্মাইনি। মেয়ে হয়ে জন্মলে এই ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব হতো ।
‘হিমালয় সাহেব না?’
‘জি।’
‘তুমি কেমন আছ?’
‘জি ভালো।’
‘বসো । খাটের উপর বসো ।’
‘আমি কিন্তু স্যার ভিজে জবজবা।’
‘কোনো সমস্যা নেই। বসো । মাথা মুছবে?’
‘জি না স্যার। বৃষ্টির পানি আমি গায়ে শুকাই। তোয়ালে দিয়ে বৃষ্টির পানি মুছলে বৃষ্টির অপমান হয়।’
আমি খাটে বসলাম । ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ স্পর্শ করলেন ।
‘তুমি কেমন আছ হিমালয়?’
‘জি ভালো ।’
‘ঐ দিন তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে এসেছিলাম- ধন্যবাদ পর্যন্ত দিইনি। আসলে মাথার মধ্যে সবসময় ছিল কখন বইটা পড়ব । জগতের চারপাশে তখন কী ঘটছিল তা আমার মাথায় ছিল না। ভালো কোনো বই হাতে পেলে আমার এরকম হয়।’
‘বইটা কি ভালো ছিল?’
‘আমি যতটা ভালো আশা করেছিলাম তারচে ভালো ছিল। এজাতীয় বই লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় না- পথেঘাটে পাওয়া যায়। আমি একবার পুরানো খবরের কাগজ কিনে এরকম ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে একটা বই জোগাড় করেছিলাম। বইটার নাম ‘Dawn of Intelligence.’ এইটিন নাইনটি টু-তে প্রকাশিত বই- অথর হচ্ছেন ম্যাক মাস্টার। রয়েল সোসাইটির ফেলো। চামড়া দিয়ে মানুষ বই বাঁধিয়ে রাখে- ঐ বইটা ছিল সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো ।’
মারিয়া বলল, বইয়ের কচকচানি শুনতে ভালো লাগছে না বাবা- আমি যাচ্ছি। তোমাদের চা বা কফি কিছু লাগলে বলো, আমি পাঠিয়ে দেব।
আসাদুল্লাহ সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের চা দাও। আর শোনো হিমালয়, তুমি আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাবে। তোমার কি আপত্তি আছে?
‘জি না ।’
‘তোমাকে কি একসেট শুকনো কাপড় দেব?’
‘লাগবে না স্যার । শুকিয়ে যাবে।’
‘তোমাকে দেখে এত ভালো লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। মারিয়া, তুই বল তো এই ছেলেটাকে দেখে আমার এত ভালো লাগছে কেন?’
‘তোমার ভালো লাগছে, কারণ, তুমি ধরে নিয়েছিলে ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার দেখা হবে না। তাকে ধন্যবাদ দিতে পারবে না। সাজীবন ঋণী হয়ে থাকবে। তুমি ঋণ শোধু করতে পেরে এইজনেই ভাল লাগছে।’
‘ভেরি গুড-যতই দিন যাচ্ছে তোর বুদ্ধি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।’
মারিয়া চা আনতে গেল। আমি আসাদুল্লাহ সাহেবকে বললাম, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব। আমি আসলে আপনাকে দেখতে আসিনি, প্রশ্নটা করতে এসেছি।
আসাদুল্লাহ সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কী প্রশ্ন?
‘এই জীবজগতে মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কি আছে যে আত্মহত্যা করতে পারে?’
‘আছে। লেমিং বলে একধরনের প্রাণী আছে। ইঁদুরগোত্রীয়। স্ত্রী-লেমিংদের বছরে দুটা বাচ্চা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রতি চার বছর পরপর দুটার বদলে এদের বাচ্চা হয় দশটা করে। তখন ভয়ংকর সমস্যা দেখা দেয়। খাদ্যের অভাব, বাসস্থানের অভাব। এরা তখন করে কী- দল বেঁধে সমুদ্রের দিকে হাঁটা শুরু করে। একসময় সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। মিনিট দশেক মনের আনন্দে সমুদ্রের পানিতে সাঁতরায় । তারপর সবাই দল বেঁধে সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করে। মাস সুইসাইড।’
‘বলেন কী।’
‘নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে মাস সুইসাইডের ব্যাপারটা আছে। সীলমাছ করে, নীল তিমিরা করে, হাতি করে। আবার এককভাবে আত্মহত্যার ব্যাপারও আছে। একক আত্মহত্যার ব্যাপারটা দেখা যায় প্রধানত কুকুরের মধ্যে। প্রভূর মৃত্যুতে শোকে অভিভূত হয়ে এরা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে আত্মহত্যা করে । পশুদের আত্মহত্যার ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছ কেন?’