আজ বৃহস্পতিবার হাফ অফিস। ফুপাদের বাসায় গিয়ে দেখি সবাই টেবিলে খেতে বসেছে। সবার সঙ্গে ফুপাও আছেন। তার মুখ সবসময় গম্ভীর থাকে। আজ আরও গম্ভীর। তার চিঠি পেয়েই আমি এসেছি, তার পরেও তিনি এমন ভঙ্গি করলেন যেন আমাকে দেখে তার ব্ৰহ্মতালু জুলে যাচ্ছে।
শুধু বাদল চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। বিকট চিৎকার দিল, আরে হিমুদা, তুমি! তুমি কোথেকে?
ফুপু বিরক্ত গলায় বললেন, তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আকাশ থেকে নেমে এসেছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছিস কেন? বোস।
বাদল বসল না । ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রইল। আমি গম্ভীর গলায় বললাম–তারপর, সব খবর ভাল? মনে হচ্ছে তুই ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছিস?
কেউ কিছু বলল না, শুধু বাদল বলল, এতদিন পর তোমাকে দেখছি–কী যে ভালো লাগছে! তুমি হাত ধুয়ে খেতে বসো। মা, হিমুদাকে প্লেট দাও। আর একটা ডিম ভেজে দাও। হিমু দা ডিমভাজা খুব পছন্দ করে। ফার্মের ডিম না মা, দেশি মুরগির ডিম।
ফুপু বিরক্ত গলায় বললেন, খামোক কথা বলবি না বাদল। কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিস । ভাত খা। ঘরে পাচ-ছ’ পদ তরকারি, এর মধ্যে আবার ডিম ভাজতে হবে? কাজের লোক নেই, কিছু নেই।
বাদল বলল, আমি ভেজে নিয়ে আসছি। হিমুদা, তুমি হাত ধুয়ে টেবিলে বসো ।
আমি হাত ধুয়ে টেবিলে বসলাম। বাদল তার মা-বাবার অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে সত্যি সত্যি ডিম ভাজতে গেল ।
কাপে ডিম ফেটছে। চামচের শব্দ আসছে।
আমি টেবিলে বসতে বসতে ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাদলের সমস্যাটা কী? আপনি যে আমাকে চিঠি দিয়েছেন, বাদলের জন্যেই তো দিয়েছেন। কী করছে সে? চিকিৎসা করতে হলে রোগটা ভালোমতো জানা দরকার ।
ফুপা বললেন, হারামজাদা দেশদরদি হয়েছে। অসহযোগের কারণে দেশ ধ্বংস হচ্ছে এই চিন্তায় হারামজাদার মাথা শট সার্কিট হয়ে গেছে। সে অনেক চিন্তাভাবনা করে সমস্যা থেকে বাচার বুদ্ধি বের করেছে।
আমি আনন্দিত গলায় বললাম, এটা তো ভালো! দেশের সব চিন্তাশীল মানুষই এই সময় দেশ ঠিক করার পদ্ধতি নিয়ে ভাবছেন। মানববন্ধন-ফন্ধন কীসব যেন করছেন। হাত ধরাধরি করে শুকনা মুখে দাড়িয়ে থাকা। বাদলের পদ্ধতিটা কী?
ফুপা বললেন, গাধার পদ্ধতি তো গাধার মতোই।
‘কীরকম সেটা? রাজপথে চার পায়ে হামাগুড়ি দেবে? হামাগুড়ি দিতে দিতে সচিবালয়ের দিকে যাবে?’
‘সেটা করলেও তো ভালো ছিল–গাধাটা ঠিক করেছে জিরো পয়েণ্টে গিয়ে রাজনীতবিদদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্যে সে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেবে ।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। বেকুবটা দুশো তেত্রিশ টাকা দিয়ে একটিন কেরোসিন কিনে এনেছে। তার ঘরে সাজানো আছে। তুই এখন এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে যা।”
‘কেরোসিন কেনা হয়ে গেছে?’
‘হ্যা, হয়ে গেছে।’
‘দেখি কী করা যায়।’
আমি খাওয়া শুরু করলাম। বাদল ডিম ভেজে হাসিমুখে উপস্থিত হলো। আমি বললাম, কী রে, তুই নাকি গায়ে আগুন দিচ্ছিস?
বাদল উজ্জ্বল মুখে বলল, হ্যাঁ হিমুদা। আইডিয়াটা পেয়েছি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে। আত্মাহুতি। পত্রপত্রিকায় নিউজটা ছাপা হলে রাজনীতিবিদরা একটা ধাক্কা খাবেন । দুই নেত্রীই বুঝবেন— পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে । তাঁরা তখন আলোচনায় বসবেন।
ফুপা তিক্ত গলায় বললেন, দুই নেত্রীর বোঝার হলে আগেই বুঝত। এই পর্যন্ত তো কম মানুষ মরেনি! তুই তো প্রথম না!
আমি বললাম, এইখানে আপনি একটা ভুল করছেন ফুপা । বাদল প্রথম তো বটেই। এম্নিতেই মানুষ মরছে পুলিশের গুলিতে, বোমাবাজিতে- কিন্তু আত্মাহুতি তো এখনও হয়নি। বাদলই হলো প্রথম। পত্রিকায় ঠিকমতো জানিয়ে দিলে এরা ফটোগ্রাফার নিয়ে থাকবে। সিএনএন-কে খবর দিলে ক্যামেরা চলে আসবে। বিবিসি, ভয়েস অভ আমেরিকা সবাই নিউজ কাভার করবে। এতে একটা চাপ তৈরি হবে তো বটেই।
ফুপা-ফুপু দুজনেই হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাঁদের হতভম্ব দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাদলকে বললাম, বাদল, তোর আইডিয়া পছন্দ হয়েছে।
‘সত্যি পছন্দ হয়েছে হিমুদা?’
‘অবশ্যই পছন্দ হয়েছে। দেশমাতৃকার জন্যে জীবনদান সহজ ব্যাপার তো না। তবে শোন, কেরোসিন ঢালার সঙ্গে সঙ্গে আগুন দিবি । কেরোসিন হচ্ছে ভলাটাইল-উদ্ধায়ী । সঙ্গে সঙ্গে আগুন না দিলে উড়ে চলে যাবে- আগুন আর ধরবে না। আর একটা ব্যাপার বলা দরকার— শুধু একটা শাট গায়ে দিয়ে আগুন ধরালে লাভ হবে না। লোকজন থাবাটাবা দিয়ে নিভিয়ে ফেলবে। তুই আলুপোড়া হনুমান হয়ে যাবি কিন্তু মরবি না। তোকে যা করতে হবে তা হলো কেরোসিন ঢালার আগে দুটা গেঞ্জি, দুটা শার্ট পরতে হবে।’
বাদল কৃতজ্ঞ গলায় বলল, থ্যাংক য়ু হিমুদা। তোমার সঙ্গে দেখা না হলে তো বিরাট ঝামেলায় পড়তাম ।
‘এখন বল আত্মাহুতির তারিখ কবে ঠিক করেছিস ।’
‘আমি কিছু ঠিক করিনি। তুমি বলে দাও। তুমি যেদিন বলবে সেদিন।’
‘দেরি করা ঠিক হবে না। তুই দেরি করলি, আর দেশ অটোমেটিক্যালি ঠিক হয়ে গেল, আর্মি এসে ক্ষমতা নিয়ে নিল- এটা কি ঠিক হবে?’
‘না, ঠিক হবে না। হিমুদা, আগামীকাল বা পরশু?’
ফুপা-ফুপু দুজনেই খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুপু যে-দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন সেই দৃষ্টির নিক নেম হলো অগ্নিদৃষ্টি। দুশো তেত্রিশ টাকা দামের কেরোসিন টিনের সবটুকু আগুন এখন তার দুই চোখে। আমি তার অগ্নিদৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর গলায় বাদলকে বললাম, যা করার দুএকদিনের মধ্যেই করতে হবে। হাতে আমাদের সময় অল্প । এর মধ্যেই তোর নিজের কাজ সব গুছিয়ে ফেলতে হবে।
‘আমার আবার কাজ কী?’
‘আত্মীয়স্বজন সবার বাড়িতে গিয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া। পা ছুঁয়ে সালাম করা। সবার দোয়া নেয়া। এসএসসি পরীক্ষার আগে ছেলেমেয়েরা যা করে- বাড়ি-বাড়ি দিয়ে দোয়াভিক্ষা।’
‘এই সব ফরমালিটিজ আমার ভালো লাগে না হিমুদা।’
‘ভালো না লাগলেও করতে হবে। আত্মীয়স্বজনদের একটা সাধ-আহ্লাদ তো আছে। তোর চিন্তার কারণ নেই। আমি সঙ্গে যাব।’
‘তুমি সঙ্গে গেলে যাব।’
আমি ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাদলের জন্য অ্যাডভান্স কুলখানি করলে কেমন হয় ফুপা? সবাইকে খবর দিয়ে একটা কুলখানি করে ফেললাম। ওনলি ওয়ান আইটেম— কাচ্চি বিরিয়ানি । বাদল নিজে উপস্থিত থেকে সবাইকে খাওয়াল। নিজের কুলখানি নিজে খাওয়াও একটা আনন্দের ব্যাপার।
ফুপ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ভয়ংকর কিছু করে ফেলবেন কি না কে জানে কইমাছের ঝোলের বাটি আমার দিকে ছুঁড়ে ফেললে বিশ্রী ব্যাপার হবে। আমি বাটি নিজের দিকে টেনে নিলাম ।
বিকেলে বাদলকে নিয়েই বের হলাম। দু-একজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে হাসপাতালে আসগর সাহেবকে দেখতে যাব। বাদলকে অত্যন্ত প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। বড় কিছু করতে পারার আনন্দে সে ঝলমল করছে।
‘বাদল!’
‘জি।’
‘তোর কাছে টাকা আছে?’
‘একশো বিয়াল্লিশ টাকা আছে।’
‘তা হলে চল, আমাকে শিককাবাব আর নানরুটি কিনে দে।”
‘কেন?’
‘একজনকে শিককাবাব আর নানরুটির দাওয়াত দিয়েছি। টাকার অভাবে কিনতে পারছি না।’
‘কাকে দাওয়াত দিয়েছ?’
‘একটা কুকুরকে । কাওরান বাজারে থাকে। পা খোঁড়া। আমার সঙ্গে খুব খাতির।’
অন্য কেউ হলে আমার কথায় বিস্মিত হতো। বাদল হলো না। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এদের সঙ্গে আমার ভাব তো থাকবেই। আমি তো সাধারণ কেউ না ।
‘হিমুদা!’
‘বল।’
‘তোমার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। তুমি এটা নিয়ে নিও। মরে গেলে তুমি পাবে না ।”
‘আমার কী আছে তোর কাছে?’
‘ঐ যে পাঁচ বছর আগে একটা সাংকেতিক চিঠি দিয়েছিলে! মরিয়া নামের একটা মেয়ে তোমাকে লিখেছিল।’
‘ঐ চিঠি এখনও রেখে দিয়েছিস?’
‘কী আশ্চর্য! তোমার একটা জিনিস তুমি আমার কাছে দিয়েছ আর আমি সেটা ফেলে দেব! তুমি আমাকে কী ভাব?’
‘সাংকেতিক চিঠি তুই এত চট করে ধরে ফেললি কী করে বল তো? এই ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না।’
বাদল আনন্দিত গলায় বলল, খুব সোজা । আমি তোমাকে বললাম, যে চিঠি দিয়েছে তার নাম কী? তুমি বললে, মারিয়া। কাজেই চিঠির শেষে তার নাম থাকবে। চিঠির শেষে লেখা ছিল NBSJB. (অর্থাৎ M-এর জায়গায় মেয়েটা লিখেছে N, A-র জায়গায় লিখেছে B.যেখানে R হবার কথা সেখানে লিখেছে S) মেয়েটা করেছে কী জান- যে-অক্ষরটা লেখার কথা সেটা না লিখে তার পরেরটা লিখেছে। এখন বুঝতে পারছ?
‘পারছি।’
চিঠিতে সে কী লিখেছিল তুমি জানতে চাওনি। বলব কী লিখেছে?
না। বাদল, একটা কথা শোন। তোর এত বুদ্ধি, কিন্তু তুই একটা সহজ জিনিস বুঝতে পারছিস না।’
‘সহজ জিনিসটা কী?’
‘আজ থাক, আরেকদিন বলব।’
শিককাবাব এবং নানরুটি কিনে এনেছি। কুকুরটাকে পাওয়া গেছে। সে আমাকে দেখেই ছুটে এসেছে। বাদলের দিকে প্রথমে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, তোর খাবার এনেছি, তুই আরাম করে খা। এ হচ্ছে বাদল অসাধারণ বুদ্ধিমান একটা ছেলে।
কুকুরটা বাদলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে দুবার ঘেউঘেউ করে খেতে শুরু করল।
আমি বললাম, মাংসটা আগে খা । নানরুটি খেয়ে পেট ভরালে পরে আর মাংস খেতে পারবি না।
কুকুরটা নানরুটি ফেলে মাংস খাওয়া শুরু করল। বাদল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, ও কি তোমার কথা বোঝে?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমার ধারণা নিম্নশ্রেণীর পশুপাখি মানুষের কথা বোঝে। অতি উচ্চশ্রেণীর প্রাণী মানুষই শুধু একে অন্যের কথা বোঝে না। বেগম খালেদা জিয়া কী বলছেন তা শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন না। আবার শেখ হাসিনা কী বলছেন তা বেগম খালেদা জিয়া বুঝতে পারছেন না। আমরা দেশের মানুষ কী বলছি সেটা আবার তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তাঁরা কী বলছেন তাও আমাদের কাছে পরিষ্কার না।
বাদল বলল, কেন?
আমি যে নিবাস ফেলে বললাম, এই প্রশ্নের জবাব আমি জনি না। আসাদুল্লাহ সাহেব হয়তো জানেন ।
‘আসাদুল্লাহ সাহেব কে?’
‘যে-মেয়েটি আমাকে চিঠি লিখেছি তাঁর বাবা। আসাদুল্লাহ সাহেব পৃথিবীর সব প্রশ্নের জবাব জানেন।’
কুকুরটা খেয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে একবার খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির ভঙ্গিতে লেজ নাড়ল । যেন বলল— এত খাবার তোমাকে কে আনতে বলেছে? আমি সামান্য পথের নেড়ি কুকুর । আমাকে এতটা মমতা দেখানো কী ঠিক হচ্ছে? আমাদের পশুজগতের নিয়ম খুব কঠিন। ভালোবাসা ফেরত দিতে হয়। মানুষ হয়ে তোমরা বেঁচে গেছ । তোমাদের ভালোবাসা ফেরত দিতে হয় না ।