আমি মারিয়ার ঘরে ঢুকলাম। এই প্রথম তার ঘরে ঢোকা। কিশোরী মেয়েদের ঘর যেরকম হয় সেরকম। র্যাকভরতি স্টাফড় অ্যানিমেল । স্টেরিও সিস্টেম, এলপি রেকর্ড সারা ঘরময় ছড়ানো। ড্রেসিংটেবিলে এলোমেলো করে রাখা সাজবার জিনিস । বেশিরভাগ কৌটার মুখ খোলা । কয়েকটা ড্রেস মেঝেতে পড়ে আছে। খাটের পাশে রকিং-চেয়ারে গাদা করা গল্পের বই । খাটের নিচে তিনটা চায়ের কাপ । এর মধ্যে একটা কাপে পিঁপড়া উঠেছে। নিশ্চয়ই কয়েকদিনের বাসি কাপ, সরানো হয়নি।
আমি বললাম, তোমার ঘর তো খুব গোছানো।
মারিয়া বলল, আমি আমার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিই না। মাকেও না, বাবাকেও না। আপনাকে প্রথম ঢুকতে দিলাম। আমার ঘর আমি নিজেই ঠিকঠাক করি। ক’দিন ধরে মনটন খারাপ বলে ঘর গোছাতে ইচ্ছা করছে না ।
‘মন-খারাপ কেন?’
‘আছে, কারণ আছে। আপনি দাড়িয়ে কেন? বসুন?’
আমি বসলাম । মারিয়া বলল, আমি সাংকেতিক ভাষায় একটা চিঠি লিখেছি।
‘কাকে?’
‘আপনাকে। আপনি এই চিঠি পড়বেন। এখানে বসেই পড়বেন । সাংকেতিক চিঠি হলেও খুব সহজ সংকেতে লেখা। আমার ধারণা, আপনার বুদ্ধি বেশ ভালো। চিঠির অর্থ আপনি এখানে বসেই বের করতে পারবেন।’
‘সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে হবে?’
‘হ্যা।’
‘আমার বুদ্ধি খুবই নিম্নমানের। ম্যাট্রিকে অঙ্কে প্রায় ধরা খাচ্ছিলাম। সাংকেতিক চিঠি তো অঙ্কেরই ব্যাপার। এখানেও মনে হয় ধরা খাব।’
মারিয়া তার রকিং-চেয়ার আমার সামনে টেনে আনল। চেয়ারের উপর থেকে বই নামিয়ে বসে দোল খেতে লাগল আমি সাংকেতিক চিঠির উপর চোখ বুলিয়ে গেলাম । কিছু বুঝলাম না। তাকালাম মারিয়ার দিকে। সে নিজের মনে দোল খাচ্ছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে । সেখানে তার ছোটবেলার একখানা ছবি । আমি বললাম, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
মারিয়া বলল, বুঝতে না পারলে সঙ্গে করে নিয়ে যান। যেদিন বুঝতে পারবেন সেদিন উত্তর লিখে নিয়ে আসবেন। ‘আর যদি কোনোদিনই বুঝতে না পারি?’
‘কোনোদিন বুঝতে না পারলে আর এ-বাড়িতে আসবেন না। এখন উঠুন, পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে । আপনাকে বাবার কাছ দিয়ে আসি ।’
আমি চিঠি-হতে উঠে দাঁড়ালাম ।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম – ১২
মারিয়াদের বাড়ির নাম- চিত্ৰলেখা ।
আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চিত্ৰলেখার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মানুষ তাদের বাড়ির নাম কেন রাখে? তাদের কাছে কি মনে হয় বাড়িগুলিও জীবন্ত? বাড়িদের প্রাণ আছে- তাদেরও অদৃশ্য হৃৎপিণ্ড ধকধক করে?
কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করছি। কেউ এসে গেট খুলছে না। দারোয়ান তার খুপরিঘর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছে। আসছে না- কারণ উৎসাহ পাচ্ছে না। ঝকঝকে গাড়ি নিয়ে কেউ এলে এরা উৎসাহ পায়। ছুটে এসে গেট খুলে স্যালুট নিয়ে দাঁড়ায়। যারা দুপুরের রোদে ঘামতে ঘামতে আসে তাদের বেলা ভিন্ন নিয়ম। ধীরেসুস্থে এসে ধমকের গলায় বলবে- কাকে চান? দারোয়ানদের ধমক খেতে ইন্টারেস্টিং লাগে । এরা নানান ভঙ্গিতে ধমক দিতে পারে। কারও ধমকে থাকে শুধুই বিরক্তি, কারও ধমকে রাগ, কারও ধমকে আবার অবহেলা। একজনের ধমকে প্রবল ঘৃণাও পেয়েছিলাম। তার ঘৃণার কারণ স্পষ্ট হয়নি।
আমি আবারও বেল টিপে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার এমনকিছু তাড়া নেই। ঘণ্টাখানিক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। তাড়া থাকে ভিখিরিদের । তাদের এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হয়। সময় তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমার কাছে সময় মূল্যহীন। ‘চিত্ৰলেখা’-নামের চমৎকার একতলা এই বাড়িটার সামনে একঘণ্টা দাড়িয়ে থাকাও যা, দুঘণ্টা দাড়িয়ে থাকাও তা। সময় কাটানোর জন্যে কিছুএকটা করা দরকার। বাড়ির নাম নিয়ে তারা যেতে পারে। আচ্ছা, মানুষের নামে যেমন পুরুষ-রমণী ভেদাভেদ আছে—বাড়ির নামেও কি তা-ই আছে? কোনো কোনো বাড়ি হবে পুরুষবাড়ি- কোনো কোনো বাড়ি রমণীবাড়ি। চিত্ৰলেখা নিশ্চয়ই রমণীবাড়ি। সুগন্ধা, শ্রাবণী, শিউলিও মেয়েবাড়ি । পুরুষবাড়ির কোনো নাম মনে পড়ছে না। এখন থেকে রাস্তায় হাটার সময় বাড়ির নাম পড়তে পড়তে যেতে হবে, যদি কোনো পুরুষবাড়ির নাম চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা ভালো করে দেখতে হবে।
আমাকে প্রায় ঘণ্টখানিক অপেক্ষা করতে হলো- এর মধ্যে দারোয়ানশ্রেণীর একজন গেটের কাছে এসেছিল। গেট খুলতে বলায় সে বলল, যার কাছে চাবি সে ভাত খাচ্ছে। ভাত খাওয়া হলে সে খুলে দেবে। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি কি চাৰিটা এনে একটু খুলে দিতে পারেননা? এই কথায় সে বড়ই আহত হলো। মনে হলো তার সুদীর্ঘ জীবনে সে এমন অপমানসূচক কথা আর শোনেনি। কাজেই আমি বললাম, আচ্ছা থাক, আমি অপেক্ষা করি। আপনার কাছে ছাতা থাকলে আমাকে কিছুক্ষণের জন্য দিন। আমি ছাতা-মাথায় দাঁড়িয়ে থাকি, প্রচণ্ড রোদ।
সে এই রসিকতাতেও অপমানিত বোধ করল। বড় মানুষের বাড়ির কাজের মানুষদের মনে অপমানবোধ তীব্র হয়ে থাকে।
‘আপনে কার কাছে আসছেন?’
‘মারিয়ার কাছে।’
‘আপা নাই।’
‘না থাকলেও আসবে- আমি অপেক্ষা করব। গেট খুলে দিন।’
‘গেট খুলনের নিয়ম নাই।’
আগের দারোয়ানদের কেউ নেই- সব নতুন লোকজন। আগেকার কেউ হলে চিনতে পারত। এত ঝামেলা হতো না। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাইসাহেব, আপনার নাম?
‘আমার নাম আবদুস সোবহান ।’
‘সোবহান সাহেব আপনি শুনুন- আমি খুব পাগলা কিসিমের লোক। গেট না খুললে গেটের উপর দিয়ে বেয়ে চলে আসব। আপনার সাহেবের কাছে গিয়ে বলুন- হিমু এসেছে।’
‘ও আচ্ছা, আপনে হিমু? আপনের কথা বলা আছে।’
দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে গেট খুলতে লাগল ।
আমাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । বিশাল ড্রয়িংরুম পার হয়ে খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চলে এসেছি। কোনো ফার্নিচার নেই । ঘরময় কাপেট । এটা ফ্যামিলি-রুম । ফ্যামিলির সদস্যরা এই ঘরে গল্পগুজব করে, টিভি দেখে। যাদের ফ্যামিলি যত ছোট তাদের ফ্যামিলি-রুমটা তত বিশাল । মারিয়াদের ড্রয়িংরুম আগের মতোই ছিল, তবে ফ্যামিলি-রুমের সাজসজ্জা বদলেছে। প্রকাণ্ড এক পিয়ানো দেখতে পাচ্ছি। পিয়ানো আগে ছিল না । পিয়ানো কে বাজায়? মারিয়া?
ফ্যামিলি-রুমে কার্পেটের উপর হাসিখালাকে বসে থাকতে দেখলাম । তিনি তাঁর দুহাত মেলে ধরেছেন। সেই হাতের নখে নেলপালিশ লাগাচ্ছেন সিরিয়াস চেহারার এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের চোখে সোনালি চশমা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। তিনি খুব একটা বাহারি পাঞ্জাবি পরে আছেন। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিখ্যাত ও ক্ষমতাবানদের কেউ হবেন। এবাড়িতে বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। নেলপালিশ লাগানোর ব্যাপারে ভদ্রলোকের মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছে কাজটা অত্যন্ত জটিল । হাসিখালাও নড়াচড়া করছেন না। স্থির হয়ে আছেন। হাসি খালা এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু, তোর কী খবর?
‘কোনো খবর নেই।”
‘মারিয়া বলেছিল তুই আসবি ।’
যে-ভদ্রলোক নেপলিশ লাগছেন ভিন্ন রক্ত গলায় বললেন, হাসি, নড়াচড়া করবে না। নড়লে আঙুল নড়ে যায়।
আমি বললাম, খালা, হচ্ছে কী?
হাসিখালা বললেন, কী হচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছিস । নতুন কায়দায় নেলপলিশ লাগানো হচ্ছে। নখের গোড়ায় কড়া লাল রঙ । আস্তে আস্তে নখের মাথায় এসে রঙ মিলিয়ে যাবে।
‘জটিল ব্যাপার মনে হচ্ছে ।’
‘জটিল তো বটেই। জিনিসটা দাঁড়ায় কেমন সেটা হচ্ছে কথা। একধরনের এক্সপেরিমেন্ট ।’
ভদ্রলোক আরেকবার বিরক্ত গলায় বললেন- হাসি, প্লিজ।
আমি কিছুক্ষণ নেলপালিশ দেয়া দেখলাম। গাঢ় লাল, হালকা লাল, সাদা— তিন রঙের কৌটা, নেলপালিশ রিমুভার নিয়ে প্রায় হুলুস্থূল ব্যাপার হচ্ছে।
হাসিখালা বললেন, জামিল, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি! এ হচ্ছে হিমু। ভালো নাম এভারেস্ট, কিংবা হিমালয় । মারিয়ার বাবার অনেক আবিষ্কারের এক আবিষ্কার। খুব ভালো হাত দেখতে পারে। হাত দেখে যা বলে তা-ই হয় ।
ভদ্রলোক চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। আমি সামনে থেকে সরলে তিনি বাঁচেন এই অবস্থা। আমি বিনয়ী গলায় বলরাম, স্যার, ভালো আছেন?
ভদ্রলোক বললেন, ইয়েস, আই অ্যাম ফাইন। থ্যাঙ্ক য়্যু।
‘আপনার নেলপলিশ দেয়া খুব চমৎকার হচ্ছে স্যার।’
ভদ্রলোকের দৃষ্টি কঠিন হয়ে গেল হাসিখালী বললেন, তুই যা, মারিয়ার বাবার সঙ্গে দেখা করে আয়। আর শোন, চলে যাবার আগে আমার হাত দেখে দিবি । জামিল, তুমি কি হিমুকে দিয়ে হাত দেখাবে?
জামিল নামের ভদ্রলোক নেলপলিশের রঙ মেশানোর ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শীতল গলায় বললেন, এইসব আধিভৌতিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।
আমি বললাম, আধিভৌতিক বলে সবকিছু উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না স্যার । অ্যাস্ট্রলজি ছিল আধিভৌতিক ব্যাপার। সেই অ্যাস্ট্রলজি থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক অ্যাস্ট্রনমি । একসময় আলকেমিও ছিল আধিভৌতিক । সেই আলকেমি থেকে আমরা পেয়েছি আধুনিক রসায়নবিদ্যা।
জামিল সাহেব বললেন, মিস্টার এভারেস্ট, এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না। আমি একটা কাজ করছি। যদি কখনো সুযোগ হয় পরে কথা হবে।
‘জি আচ্ছা, স্যার।’
আমি আসাদুল্লাহ সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়লাম । এই ঘর আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি। খাটে শুয়ে থাকা মানুষটা শুধু বদলেছে। ভরাট স্বাস্থ্যের সেই মানুষ নেই। রোগাভোগা একজন মানুষ। মাথাভরতি চুল ছিল ল কমে গেছে। চোখের তীব্র জ্যোতিও ম্লান। নিজের তৈরি বেহেশতে জীবনযাপন করতে করতে তিনি সম্ভবত ক্লান্ত।
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, কেমন আছ হিমু?
‘ভালো।’
‘তোকে দেখে আমার ভালো লাগছে।’
‘আপনাকে দেখে আমার তেমন ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’
‘স্বর্গেবাস করা ক্লান্তিকর ব্যাপার হিমু। আমি আসলেই ক্লান্ত । সময় কাটছে না ।’
‘সময় কাটছে না কেন?’
‘কীভাবে সময় কাটাব সেটা বুঝতে পারছি না। এখন বই পড়তে পারি না।’
‘বই পড়তে পারেন না?’
‘না। বই পড়তে ভালো লাগে না, গান শুনতে ভালো লাগে না, শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। যা ভালো লাগে না, তা করি না। বই পড়ি না, গান শুনি না। কিন্তু শুয়ে থাকতে ভালো না লাগলেও শুয়ে থাকতে হচ্ছে। আই হ্যাভ নো চয়েস। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন হিমু, বসো। আমার বিছানায় বসো ।’
আমি বসলাম। আসাদুল্লাহ সাহেব মুখ টিপে খানিকক্ষণ মিটমিট করে হাসলেন । কেন হাসলেন ঠিক বোঝা গেল না । হঠাৎ মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর গলায় বললেন– এখন আমি কী করছি জান?
‘জি না, জানি না। আপনি বলুন, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছি।’
‘আমি যা করছি তা হচ্ছে মানসিক গবেষণা ।’
‘সেটা কী?’
‘মনে মনে গবেষণা। কোনো-একটা বিষয় নিয়ে জটিল সব চিন্তা করছি, কিন্তু সবই মনে মনে। আমার সাম্প্রতিক গবেষণার বিষয় হলো- নারী-পুরুষ সম্পর্ক।’
‘প্রেম?’
‘হ্যাঁ, প্রেম । হিমু, তুমি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছ?’
‘না ।’
‘মেয়েরা তোমার প্রেমে পড়েছে?’
‘না।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চিত ।’
আসাদুল্লাহ সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, প্রেম সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী বলো ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি তো এইসব নিয়ে গবেষণা করছি না, কাজেই বলতে পারছি না। আপনি বরং বলুন গবেষণা করে কী পেয়েছেন।
“শুনতে চাও?’
‘হ্যা, চাই।’
আসাদুল্লাহ সাহেব বুকের নিচে বালিশ দিয়ে একটু উঁচু হলেন । কথা বলা শুরু করলেন শান্ত ভঙ্গিতে এবং খুব উৎসাহের সঙ্গে।
‘হিমু শোনো, গবেষণা না- শয্যাশায়ী মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা। চিন্তাও ঠিক না- ফ্যান্টাসি। আমার মনে হয় কী জান? সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি প্রতিটি ছেলেমেয়েকে পাঁচটি অদৃশ্য নীলপদ্ম দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। এই নীলপদ্মগুলি হলো- প্রেমভালোবাসা। যেমন ধরো তুমি । তোমাকে পাঁচটি নীলপদ্ম দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত তুমি কাউকে পাওনি যাকে পদ্ম দিতে ইচ্ছে করেছে। কাজেই তুমি কারোর প্রেমে পড়নি। আবার ধরো, একটা সতেরো বছরের তরুণীর সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো । মেয়েটির তোমাকে এতই ভালো লাগলো যে, সে কোনোদিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তার সবকটি নীলপদ্ম তোমাকে দিয়ে দিল । তুমি পদ্মগুলি নিলে, কিন্তু তাকে গ্রহণ করলে না। পরে এই মেয়েটি কিন্তু আর কারও প্রেমে পড়তে পারবে না । সে হয়তো একসময় বিয়ে করবে, তার স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করবে, কিন্তু স্বামীর প্রতি প্রেম তার থাকবে না ।’
আমি বললাম, আর আমার কী হবে? আমার নিজের পাঁচটি নীলপদ্ম ছিল, তার সঙ্গে আরও পাচটি যুক্ত হয়ে পদ্মের সংখ্যা বেড়ে গেল না?
‘হ্যা, বাড়ল ।’
‘তা হলে আমি কি ইচ্ছা করলে এখন কাউকে পাচটির জায়গায় দশটি পদ্ম দিতে পারি?’
‘তা পার না। অন্যের পদ্ম দেয়া যাবে না। তোমাকে যে-পাঁচটি দেয়া হয়েছে শুধু সেই পাঁচটি দেয়া যাবে।’
‘পাঁচটি কেন বলেছেন? পাঁচের চেয়ে বেশি নয় কেন?’
‘পাঁচ হচ্ছে একটা ম্যাজিক-সংখ্যা। এইজন্যেই বলছি পাঁচ । আমাদের ইন্দ্রিয় পাঁচটি। বেশিরভাগ ফুলের পাপড়ি থাকে পাঁচটি। পাঁচ হচ্ছে একটি মৌলিক সংখ্যা । তবে পাঁচের ব্যাপারটা আমার কল্পনা, পাঁচের জায়গায় সাতও হতে পারে। আমার হাইপথিসিস তোমার কাছে কেমন লাগছে?’
‘চমৎকার লাগছে।’
‘আজকাল আমি দিনরাত এটা নিয়েই ভাবি। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ নীলপদ্ম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, দেয়ার মানুষ পায় না।’
‘”অনেকে হয়তো দিতেও চায় না।’
‘হ্যাঁ, তাও হতে পারে। অনেকে পদ্মগুলি হাতছাড়া করতে চায় না। আবার এমনও হতে পারে, পদ্মগুলি দেয়া হয় ভুল মানুষকে । যাকে দেয়া হলো সে পদ্মের মূল্যই বুঝল না। এই হচ্ছে আমার নীলপদ্ম থিওরি। তোমাকে বললাম, তুমি তো নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াও, অনেকের সঙ্গে মেশ, আমার থিওরিটা পরীক্ষা করে দেখো।’