অবশ্যই খাব।
দাম আছে কিন্তু।
দাম কোনো বিষয়ই না। একদিনইতো খাব। রোজ রোজ তো খাচ্ছি না।
মেয়েটা শক্ত হয়ে বসে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা দিশেহারা। তার হাতের আঙুল কাঁপছে। খুব সম্ভব টেনশান এবং ক্ষুধার কারণে।
তোমার নাম কি?
আমার নাম জেনে কি করবেন?
আমি একজনকে মোরগ—পোলাও, গ্লাসি এবং ডিমসহ কোয়েল পাখি খাওয়াবো, তার নাম জানব না?
আমার নাম রানু।
থাক কোথায়?
মহিলা হোস্টেলে। হাতিরপুলের কাছে।
মহিলা হোস্টেলে কত টাকা বাকি পড়েছে? আমার ধারণা মহিলা হোস্টেলের বাকি শোধ করার জন্যেই তুমি ঘুরছে। টাকা জমা দেবার আজই কি শেষ দিন?
রানু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি জেনে কি করবেন? আমাকে টাকাটা দিবেন?
হুঁ। দেব।
বিনিময়ে আমাকে কি করতে হবে? আপনার সঙ্গে শুতে হবে?
আমি কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট গলায় বললাম, হ্যাঁ।
রানু এখন মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে আছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি বললাম, রানু শোন। তুমি ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছ। সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্যে অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়ে টাকা রোজগারের চিন্তা করছ বলেই আমাকে এমন কুৎসিত কথা বলতে পারলে।
রানু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, সরি।
আমি তোমাকে একটা ঠিকানা লিখে দেব। এই ঠিকানায় চলে এসো, দেখি কোনো চাকরি দেয়া যায় কি-না।
আমার জন্যে আপনাকে কিছু করতে হবে না।
আচ্ছা যাও–কিছু করব না।
হোস্টেলের টাকাটা আপনার কাছ থেকে ধার হিসেবে নেব। যথা সময়ে ফেরত দেব। আমার তিন হাজার টাকা লাগবে। তিনি হাজার টাকা কি আছে আপনার সঙ্গে?
আছে।
আরেকটা কথা আপনাকে বলি—আপনি নিজেকে যতটা ভালো মানুষ প্রমাণ করতে চাইছেন ততটা ভালো মানুষ আপনি নন।
কিভাবে বুঝলে?
আমি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি। সে ভালো না মন্দ।
কখন থেকে পার? ছোটবেলা থেকে?
রানু জবাব না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার শরীরের কাঁপুনি থেকে বুঝতে পারছি সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। আমি বললাম, টাকাটা যে আমাকে ফেরত দেবে কিভাবে দেবে? তোমার ভাবভঙ্গি পরিষ্কার বলছে তুমি গভীর জলে পড়েছ। কারো কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
আপনার টাকা পেলেইতো হল। কোত্থেকে পাচ্ছি সেটা জেনে কি করবেন? যাই হোক আপনাকে বলছি— আমি কিডনী বিক্রি করছি। এক ভদ্রলোক কিনবেন বলে কথা পাকা হয়েছে। ক্রস ম্যাচিং আরো কি কি যেন আছে, সব করা হয়েছে।
কত টাকায় বিক্রি করুছ?
এক লাখ টাকা; যে এজেন্ট বিক্রির ব্যবস্থা করেছে তাকে দশ হাজার দিতে হবে। আমি পাব নব্বই হাজার।
নব্বই হাজারে কিডনী খারাপ না। টাকাটা হাতে পাচ্ছ কবে?
এই মাসের আঠারো তারিখ অর্ধেক টাকা পাব। বাকি অর্ধেক ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরে।
যিনি তোমার কিড়নী কিনছেন তার নাম জান?
রানু বলল, কার জন্যে কিডনী কেনা হচ্ছে তা আমি জানি না। মাজেদা বলে একজন মহিলা সব ব্যবস্থা করছেন। নিউ ইস্কাটনে থাকেন।
আমি বললাম, হলি কাউ। পবিত্ৰ গাভী।
রিকশাওয়ালা বলল, গাভীর কথা কি বললেন স্যার?
গাভীর কথা কিছু বলি নাই। তুমি রিকশা চালাও।
রানু খাওয়া-দাওয়ায় প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে বলল, আমি একটা মিষ্টিপান খাব। তার চোখে চকচকে ভাব আগে ছিল না, এখন চলে এসেছে। তাকে পান কিনে দেয়া হল। সে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, আমি এম্নিতে পান খাই না। শুধু বিয়েবাড়িতে গেলে পান খাই। একবার জর্দা দেয়া পান খেয়ে বিয়েবাড়িতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বান্ধবীর বিয়ে। ওর নাম হাসি। আমরা ওকে ক্ষেপানোর জন্যে বলতাম–
হাসি
রজব আলির খাসি।
রজব আলিটা কে?
রজব আলি কেউ না। এম্নি একটা নাম। মজার ব্যাপার কি জানেন? ওর বিয়ে যার সঙ্গে হয়েছে তার নাম রজব আলি। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। অদ্ভুত না?
কিছুটা অদ্ভুত।
রানু বলল, মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আজ যেমন ঘটেছে। যখন খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ মনে হল আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আজকের তারিখটা জানেন?
সতেরোই মে।
আজ আমার বাবার মৃত্যু দিন। উনি মারা গিয়েছিলেন দুপুর দুটায়। আমি যখন খাওয়া শুরু করি তখন বাজে দুপুর দুটা। আমি ঘড়ি দেখেছিলামতো, আমি জানি। খাবার সময় আমি যে কাঁদছিলাম। আপনি দেখেছেন? প্লেটে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়েছিল।
দেখেছি।
কাঁদছিলাম, কারণ আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, আমার বাবা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন–মা! আরাম করে ভাত খা। খাওয়ার সময় প্লেটে চোখের পানি ফেলতে নেই। এ রকম কেন মনে হল শুনতে চান?
চাই।
আরেক দিন বলব। একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আচ্ছা, বলুনতো, আমি কি দেখতে খারাপ?
খারাপ না, তবে রসগোল্লাও না।
কিছু একটা আমার মধ্যে আছে। ভয়ংকর রিপালসিভ কিছু। এখন পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার প্রেমে পড়ে নি। অথচ প্রতিরাতে ঘুমুতে যাবার সময় আমি চিন্তা করি— একটা ছেলে আমার প্রেমে পড়েছে আমার মন ভুলাবার জন্যে হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানা করছে।
কি রকম হাস্যকর কাণ্ডকারখানা?
একেক রাতে একেক রকম ভাবি। কাল রাতে ভেবেছি–একটা ছেলে ব্লেড নিয়ে আমার ঘরের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেছে— তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হও, তাহলে আমি ব্লেড দিয়ে আমার হাতের শিরা কেটে ফেলব।