পল্টু স্যার বলেছেন, অন্যের কিডনী শরীরে নিয়ে বাঁচার তিনি কোনোই কারণ দেখছেন না। তাঁর মতে ঘুম যেমন ভয়াবহ কিছু না, মৃত্যুও না। বরং ঘুমের চেয়ে ভালো! ঘুম এক সময় ভাঙে, বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। গরম, ঘাম, পেটে ব্যথা, ক্ষুধা, বাথরুম নামক অসুবিধায় বাস করতে হয়। মৃত্যুতে এই সমস্যা নেই। তাঁর একটাই সমস্যা— মৃত্যুর পর বইগুলো সঙ্গে থাকবে না।
অনেকদিন পর রাস্তায় হাঁটছি। গরমটা ভালো লাগছে, গায়ের ঘামের গন্ধও ভালো লাগছে। কঠিন রোদের আলাদা মজা আছে।
এফডিসির কাছের রেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন যাবে সেই দৃশ্য দেখব। ছুটন্ত ট্রেনের সঙ্গে মনের একটা অংশও ছুটে যায়, সেই অনুভূতি অন্য রকম। ট্রেন কখন আসবে জানি না। অপেক্ষা করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। হাতে রাত আটটা পৰ্যন্ত সময়। আমি আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছি। একটা রিকশায় মায়াকাড়া চেহারার শ্যামলা মেয়ে বসে আছে। বৈশাখের দুৰ্দান্ত রোদেও মেয়েটা রিকশার হুড তোলেনি। রোদে ভাজা ভাজা হচ্ছে। মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে কাঁদতে কাঁদতে এবং চোখের পানি মুছতে মুছতে আসছে। প্রকৃতি মানুষের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করেছেন। দুঃখ পেলে মানুষ কাদবে, তার চোখে পানি আসবে এবং আনন্দ পেলে সে হাসবে, তার দাঁত দেখা যাবে— এই ব্যবস্থা। প্রকৃতি এই কাজটা কেন করল?
আমার ধারণা প্রকৃতি এই ব্যবস্থা করেছে যেন মানুষ তার দুঃখ এবং আনন্দ লুকাতে না পারে। যেন অন্যরা টের পেয়ে যায়। দুঃখ এবং আনন্দ ভাগ করার জন্যে এগিয়ে আসে।
রেল ক্রসিং-এর পেট পরে গেছে। মেয়েটার রিকশা থেমে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি রিকশার দিকে। আমার হঠাৎ মনে হল— রিকশার ভাড়া দেবার মতো টাকা মেয়েটার কাছে নেই। তারচেয়েও বড় কথা মেয়েটা ভয়াবহ ক্ষুধার্তা। রাতে সে কিছু খায় নি। এত বেলা হয়েছে এখনো কিছু খায় নি।
মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে পড়েছে। রিকশাওয়ালা কঠিন মুখ করে কি যেন বলছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে হতাশ ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম, ভাড়া কত হয়েছে?
রিকশাওয়ালা বলল, একশ টাকা।
আমি বললাম, ঢাকা শহরে রিকশার ভাড়া একশ টাকা এই প্রথম শুনলাম।
রিকশাওয়ালা বলল, স্যার, আমি ইনারে নিয়া সকাল থাইকা ঘুরতাছি। এর বাড়িতে যায়, তার বাড়িতে যায়। কানতে কানতে ফিরা আসে, যাত্রাবাড়ি গেলাম। মগবাজার গেলাম। রামপুরা গেলাম— এখন আপনি বিবেচনা করেন। একশ টাকা কমই চাইছি।
আমি বললাম, আমারো তাই ধারণা। এই নাও রিকশা ভাড়া একশ টাকা। আর এই নাও বিশ টাকা। বরফ দেয়া লাচ্ছি খাও। গরমে আরাম হবে।
রিকশাওয়ালা এই প্ৰথম ভালোভাবে আমার দিকে তাকালো এবং জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, হিমু ভাই, মাফ দেন। আপনেরে চিনতে পারি নাই। সে নিচু হয়ে কদমবুসি করল।
মেয়েটা হতভম্ভ। আশেপাশের লোকজনও কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে। ট্ৰেন এসে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি ট্রেনের দিকে—
বৃষ্টি দেখলেই যেমন ছেলেবেলার গান বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর মনে পড়ে, ট্রেন দেখলেই ট্রেনের ছড়া মনে পড়ে—
রেল গাড়ি ঝমাঝাম
পা পিছলে আলুর দম
ইস্টিশনের মিষ্টি কুল
শখের বাগান গোলাপ ফুল।
ট্রেন চলে গেছে। রেল গেটের জটিলা শেষ। শুধু আমি, মায়াবতী তরুণী এবং রিকশাওয়ালা আটকে আছি।
রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হাসিমুখে বলল, হিমু ভাই কি আমারে চিনেছেন? আমি ছামছু। আমার মেয়ের নাম সাগরিকা। আপনার কারণে মেয়েটার জীবন রক্ষা হয়েছিল। চিনেছেন হিমু।
হুঁ।
একটা পরীক্ষা আছে না, পাস করলে মাসে মাসে টেকা পায়। সাগরিকা সেই পরীক্ষা পাস করছে। টেকা পাওয়া শুরু করছে। এইটা সেইটা কিনতে চায়। আমি বলেছি, খবরদার! আগে হিমু ভাইরে পছন্দের কিছু কিন্যা দিবি। তারপর অন্য কথা। ঠিক বলেছি না?
হুঁ।
এখন বলেন। আপনার পছন্দের জিনিস কি? আইজই কিনব।
চিন্তা-ভাবনা করে বলি। হুট করে বলতে পারব না। আগে খাওয়াদাওয়া করতে হবে। ক্ষুধায় জীবন যাওয়ার উপক্রম। ঢাকা শহরের সবচে স্বভালো মোরগা-পোলাও কোথায় পাওয়া যাবে?
পুরান ঢাকায় যাইতে হবে। সাইনি পালোয়ান।
চল যাই।
আমি রিকশায় উঠে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, চল, মোরগপোলাও খেয়ে আসি।
মেয়েটা চোখ-মুখ খিচিয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনি আমাকে মোরগ পোলাও খাওয়াবেন কেন?
আমি বললাম, তোমার ক্ষিধে লেগেছে এই জন্যে।
মেয়েটি গলার স্বর আরো তীক্ষ্ণ করে বলল, আমার ক্ষিধে লাগলে আপনি কেন আমাকে খাওয়াবেন?
আমি বললাম, ঝামেলা করবে না। সারাদিন রিকশা নিয়ে ঘুরেছি, ভাড়া দিতে পার নি, আবার ঝগড়া। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে যদি রিকশায় না উঠ তিনটা থাপ্পর দিয়ে চলে যাব। এক… দুই…
তিন বলার আগেই মেয়েটা চোখ মুছতে মুছতে রিকশায় উঠল। রিকশাওয়ালা বলল, আপনেরে চিনে নাই, এই জন্য ভং করছে। চিনলে লাফ দিয়ে কোলে উইঠ্যা বসত।
আমি বললাম, তোমার ঐ দোকানে আইটেম আর কি পাওয়া যায়?
রিকশাওয়ালা মহানন্দে রিকশার প্যাডেল চাপতে চাপতে বলল, গ্রাসি পাইবেন। খাসির মাংস দিয়া বানায়। এমন গ্লাসি আপনে বেহেশতেও পাইবেন না।
মোরগ-পোলাওয়ের সঙ্গে গ্লাসি যায়?
অবশ্যই যায়। কেন যাইব না? চ্যালচ্যালায় যায়।
ঠিক আছে, মোরগ পোলাও এবং গ্লাসি সাথে আর কি?
কোয়েল পাখির রোস্ট খাইবেন? পেটের ভিতরে থাকবে পাখির ডিম।