পল্টু স্যার বললেন, আমার ধারণা শরীরের এয়ার কন্ডিশনিং সিষ্টেম হল পায়ে এবং কানে। খুব যখন ঠাণ্ডা পরে আমরা কি করি? কান ঢাকি এবং পায়ে মোজা পারি। ঠিক কি-না বল।
জ্বি স্যার, ঠিক।
সেখান থেকে আমার ধারণা হয়েছে অতিরিক্ত গরমের সময় যদি পা এবং কান ঠাণ্ডা রাখা যায় তাহলে শরীর ঠাণ্ডা থাকবে। সেই পরীক্ষাই করছি।
স্যার, ফলাফল কি?
ফলাফল পজিটিভ। যদিও কান ঠাণ্ডা করার কোনো বুদ্ধি পাচ্ছি না। পা এবং কান দুটাই একসঙ্গে ঠাণ্ডা করতে পারলে নিশ্চিত হতে পারতাম।
কানে কি বরফ ঘসব স্যার? প্রতি দুই তিন মিনিট পর পর আপনার দুই কানো বরফ ঘসে দিলাম।
পল্ট স্যার আনন্দিত গলায় বললেন, অত্যন্ত ভাল বুদ্ধি। তোমার বেতন আরো পঞ্চাশ টাকা বাড়ালাম। এখন থেকে তোমার বেতন তিন হাজার একশ পঞ্চাশ টাকা।
স্যার, আপনার অসীম দয়া।
অসীম কি জান?
জানি না। স্যার। এইটুকু জানি, অসীম হল অনেক বেশি।
লেখাপড়া কিছু করেছ?
অতি সামান্য।
লেখাপড়া শেখার প্রতি আগ্রহ আছে? শিখতে চাও? শি
খতে চাই না, স্যার।
কেন চাও না?
এত জেনে কি হবে? যত জ্ঞানই হোক মৃত্যুর পর সব শেষ। এই জন্যে ঠিক করে রেখেছি মানকের নাকির এই দুই স্যারের কোশ্চেনের আনসার শুধু শিখে যাব?
পল্টু স্যার অবাক হয়ে বললেন, এই দুইজন কে?
স্যার, ফেরেশতা।
বল কি? নাম শুনি নাইতো। উনারা কোশ্চেন করেন না-কি?
কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন। উত্তর না জানলে বিরাট সমস্যা।
কি প্রশ্ন বলতো? যেমন একটা প্রশ্ন হচ্ছে— তোমার প্রভু কে?
পল্টু স্যার হতভম্ব গলায় বললেন, খুবই কঠিন প্রশ্ন তো। আসলেই তো আমার প্রভু কে? আমার প্রভু কি আমার সাব কনশাস। মাইন্ড, নাকি আমার কনশাস। মাইন্ড? কে আমাকে কনট্রোল করে?
আমি বললাম, স্যার, এরচেয়েও কঠিন প্রশ্ন আছে। যেমন— তোমার ধর্ম কি?
পল্টু স্যার বললেন, সর্বনাশ! লোহার ধর্ম হল লোহা কঠিন। চুম্বক তাকে আকর্ষণ করে। মানুষের ধর্ম তাহলে কি? জটিল চিন্তার বিষয় তো!
পল্টু স্যার চোখ বুঁজে চিন্তা শুরু করলেন। তাঁর মুখ থেকে ককাকক শব্দ বের হতে লাগল।
সাতদিনে আমার বেতন তিন হাজার টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে হল চার হাজার পঞ্চাশ। এবং এই সাত দিনে পন্টু স্যার সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া গেল তার সামারি এবং সাবসটেন্স হচ্ছে—
ক. পল্টু স্যার অতি সজ্জন ব্যক্তি।
খ. পল্টু স্যার বেকুব ব্যক্তি।
ধরা যাক, কোনো এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হবে, আমি প্রতিবেদক। তাহলে আমি যা করব তা হচ্ছে— তিনি ইজিচেয়ারে শুয়ে পায়ে ফ্যানের বাতাস দিচ্ছেন এবং গভীর মনযোগে বই পড়ছেন। এ রকম একটা ছবি তুলিব লেখার সঙ্গে যাবার জন্যে। ছবির নিচের ক্যাপশানে— পাঠেই আনন্দ! মূল লেখাটা হবে। এ রকম—
একজন নীরব জ্ঞান সাধক
(কক কক ধৰ্ম)
তাঁর ভাল নাম আবু হেনা। পরিচিতজনদের কাছে পন্টু ভাই কিংবা পন্টুভাইজান। তাঁর বয়স পঞ্চাশ। চিরকুমার মানুষ। গুলশান এলাকার বক্রিশশ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন। ফ্ল্যাট বাড়ির আসবাব বলতে একটা শোয়ার খাট, একটা ইজিচেয়ার। বইকে যদি আসবাবের মধ্যে ফেলা যায় তাহলে ইজিচেয়ার এবং খাটি ছাড়া তার আছে ছোট-বড় প্রায় দশ হাজার আসবাব। পড়ার কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নেই। হাতের কাছে যা পান তাই পড়েন। বই হাতে না থাকলে তার বুক ধড়ফড় করে। হাঁপানির টান উঠে।
তিনি ঘুম থেকে উঠেন। সকাল সাতটায়। এক কাপ চা একটা টোস্ট বিসকিট খেয়ে পড়তে শুরু করেন।
দুপুর একটায় গোসল করেন। দুপুরের খাবার খেয়ে ইজিচেয়ারে পনেরো থেকে বিশ মিনিট ঘুমিয়ে আবার পড়তে শুরু করেন। সন্ধ্যা ছটায় পড়া বন্ধ করে এক কাপ চা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভঙে সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে। আবার পড়তে বসেন— ব্লাত এগারোটা পর্যন্ত একটানা পড়ার কাজ চলে। এগারোটার পর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যান। রাত তিনটার দিকে ঘণ্টা খানেকের জন্যে তাঁর ঘুম ভাঙে। এই সময়টাও তিনি নষ্ট করেন না। পড়াশোনা করেন।
ব্যক্তিগত প্রোফাইল
উচ্চতা : পাঁচ ফুট ৬ ইঞ্চি।
ওজন : ষাট কেজি (আনুমানিক)।
প্রিয় রঙ : কিছু নেই।
প্রিয় খাবার; সবই প্ৰিয়। যা দেয়া হয় তাই খান।
প্রিয় ব্যক্তিত্ব : এই মুহূর্তে তাঁর গৃহভৃত্য হিমু।
মেডিকেল প্রোফাইল
ব্লাড গ্রুপ : A Positive.
কিডনী : দুটাই অকেজো।
প্রেসার : নরমাল।
ডায়াবেটিস : নাই।
কোলেক্টরেল : বিপদসীমার নিচে।
অর্থনৈতিক প্রোফাইল
নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকেন। এ ছাড়াও কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। সঠিক সংখ্যা জানা যায় নি। ব্যাংকে প্রচুর টাকা। তিনি চেক কেটে টাকা তুলতে পারেন না, কারণ সিগনেচার মিলে না। পল্টু স্যার যে সিগনেচারে একাউন্ড খুলেছেন সেটা ভুলে গেছেন। বাড়ি ভাড়ার নগদ টাকা যা আসে তাতেই সংসার চলে। বাসায় বড় একটা লকার আছে। লকারের কম্বিনেশন নাম্বার স্যার ভুলে গেছেন বলে লকার খোলা যাচ্ছে না। স্যার প্রতি শুক্রবারে আধঘণ্টা সময় বিভিন্ন নাম্বারে চেষ্টা করেন। তাতে লাভ হচ্ছে না।
কক কক ধর্ম
বিষয়টা যথেষ্ট জটিল। কিছু কিছু বই পড়ার সময় তিনি কক কক জাতীয় শব্দ করেন। পছন্দের বই হলে এ ধরনের শব্দ করেন, না-কি অপছন্দের বই হলে করেনতা এখনো বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কক কিক শব্দটার সঙ্গে মুরগির ডাকের সাদৃশ্য আছে।
গৃহভৃত্য বিষয়ে কিছু উপদেশবাণী
গৃহভৃত্য বিষয়ে আমার বাবার কিছু উপদেশবাণী ছিল। উপদেশবাণীর সার অংশ হচ্ছে— মহাপুরুষদের কিছুকাল গৃহতৃত্য হিসেবে থাকতে হবে। তিনি ডায়েরিতে কি লিখে গেছেন হুবহু তুলে দিচ্ছি। এই অংশটি তিনি মৃত্যুর আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। হাতের লেখা জড়ানো এবং অস্পষ্ট। মানুষের মানসিক অবস্থার ছাপ পড়ে হাতের লেখায়। আমার ধারণা তখন তাঁর মানসিক অবস্থাও ছিল এলোমেলো। লেখার শিরোনাম–হিজ মাস্টার্স ভয়েস। তিনি সব লেখাই সাধু ভাষায় লেখেন। এই প্রথম সাধু ভাষা বাদ দিয়ে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন।