প্রথম চাকরি পেলে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের খবর দিতে হয়। মিষ্টি খাওয়াতে হয়। মৃত বাবা-মার কবর জিয়ারত করতে হয়। যারা দূরে বাস করে, চিঠি লিখে তাদের কাছ থেকে দোয়া নিতে হয়। বিশাল কর্মকাণ্ড। আমি বিশাল কর্মকাণ্ডের শুরুতে মাজেদা খালাকে টেলিফোন করলাম। আবেগ জর্জরিত গলায় বললাম, খালা আপনার দোয়া চাই। আজ চাকরিতে জয়েন করেছি।
খালা বিস্মিত হয়ে বললেন, চাকরিতে জয়েন করেছি। মানে কি? কি চাকরি?
বাসাবাড়ির কাজ। সহজ বাংলায় চাকর; বেতন ভালো পেয়েছি— মাসে তিনি হাজার। থাকা-খাওয়া ফ্রি। ঈদে বোনাস এবং কাপড়।
হড়বড় করে কি বলছিস? গরমে তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
খালা, তুমি দুএকটা সহজ রান্না শিখিয়ে দিওতো। স্যারকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। হোটেলের রান্না খেয়ে স্যারের শরীর খারাপ হবে, এটা হতে দেয়া যায় না।
হাংকি পাংকি কথা বন্ধ করবি? পল্টু ভাইজানের সঙ্গে দেখা করেছিস?
করেছি। উনিই চাকরি দিলেন।
খালা রাগি গলায় বললেন, তুই ভাইজানকে টেলিফোনটা দেতো। আমি উনার সঙ্গে কথা বলি।
আমি বললাম, স্যারকে টেলিফোন দেয়া যাবে না। উনি পড়াশোনা করছেন। আমার উপর ইনসট্রাকসান আছে— পড়াশোনার সময় যদি প্রেসিডেন্ট বুশও টেলিফোন করেন তাকে বলতে হবে–off যান। ইরাকে মানুষ মারা নিয়ে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন। স্যারকে টেলিফোন দেয়া যাবে না। স্যার ব্যস্ত।
ছাগলামী করবি না। এক্ষুণি ভাইজানকে টেলিফোন দে। আর শোন, তোকে কিডনী দিতে হবে না। তুই মানুষ হিসেবে বিষাক্ত। আমি চাই না তোর শরীরের কোনো অংশ ভাইজানের ভেতর থাকুক।
উনাকে বাচায়ে রাখতে হবে না?
আমি অন্যখান থেকে কিডনী যোগাড় করব। বাংলাদেশে কিডনী পাওয়া কোনো ব্যাপার? ষোল কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি কিডনী বিক্রির জন্যে কাষ্টমার খুঁজছে। ভাইজানকে টেলিফোন দে।
আমি লাইন কেটে দিলাম।
চাকরি প্রাপ্তির আনন্দ সংবাদ আর কাকে দেয়া যায়। অবশ্যই বাদলকে। সেও নতুন চাকরি পেয়েছে, কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াচ্ছে। তাৱ ছাত্ৰ-ছাত্রীরা তাকে ডাকছে পাগা স্যার। এটা নিয়ে সে মানসিক সমস্যায় আছে। পগা ডাকের পেছনের কারণ বের করতে পারছে না।
কে, বাদল?
হিমুদা তুমি? আমি জানতাম আজ দিনের মধ্যেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হবে।
চাকরি পেয়েছি। এই খবরটা দেয়ার জন্যে টেলিফোন করলাম।
তুমি করবে চাকরি— কি বলছ এসব? কোথায় চাকরি করছ?
বাসার চাকর হিসেবে এক বাড়িতে দাখিল হয়ে গেছি। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, হালকা রান্না— ডাল ভাত ডিম ভাজি।
সত্যি বলছ?
অবশ্যই।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, আমার কাছে দারুণ একসাইটিং লাগছে। বাসা বাড়িতে কােজ নেয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তোমাকে কেউ চিনুক বাঁ না চিনুক, আমি চিনি। হিমুদা, কোথায় চাকরি করছ, কি করছ, একটু দেখে যাই?
আজি না, অন্য একদিন খবর দিয়ে নিয়ে আসব। নতুন চাকরিতো, বসের মেজাজ মর্জি বুঝে নেই। শুরুতেই আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে নিয়ে এলে বাস রাগ করতে পারেন।
ঠিক আছে। তুমি যেদিন বলবে আমি সেদিনই চলে আসব। আচ্ছা! হিমুদা, আমাকে যে পগা স্যার ডাকে তার কারণ তোমাকে বের করতে বলেছিলাম, বের করেছ?
করেছি। ইংরেজি ইউনিভার্সিটিতো ছাত্ররা শুরুতে তোকে ডেকেছে হলি কাউ; সেখান থেকে হলি ডাংকি! পবিত্র গাধা। পবিত্র গাধা থেকে পগা।
বল কি?
বাদল, রাখলাম, স্যারের কিছু লাগে কি-না খোঁজ নিতে হবে।
তুমি কি সত্যি-সত্যিই বাসার চাকরের কাজ নিয়েছ?
ইয়েস। বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, হাউ এক্সাইটিং। তোমাকে যতই দেখি ততই হিংসা হয়।
আমি বললাম, বাদল, টেলিফোন রাখি, আমার স্যার এখন মুরগির মতো কিক কক শব্দ করছে। ঘটনা কি দেখে আসি।
উনি মুরগির মতো কিক কক করেন?
সব সময় করেন না। ইন্টারেস্টিং কোনো বই পড়ার সময় করেন। টেলিফোন রেখে বিনীত ভঙ্গিতে স্যারের সামনে দাঁড়ালাম। স্যার অবাক হয়ে বললেন, কি ছুটি চাও?
আমি বললাম, নাতো!
চাকরিতে জয়েন করেই সবাই ছুটি চায়। বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে আসবে। বিছানা-বালিশ নিয়ে আসবে ইত্যাদি।
ছুটি চাই না। পায়ে বাতাস দিচ্ছেন কেন এটা জানতে চাই।
স্যার উৎসাহিত হলেন। ছাত্রকে শেখাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, এরিস্টটলের নাম শুনেছি?
জ্বি না। স্যার। আমি চাকর মানুষ। আমি আমার মতো চাকর-বকিরদের কিছু নাম জানি। উনার মতো বড় মানুষের নাম জানব কিভাবে?
উনি যে বড় মানুষ এই তথ্য তোমাকে কে দিল?
আন্দাজ করেছি। ইংরেজি নামতো, ইংরেজি নামের মানুষরা বড় মানুষ হয়।
কচু হয়। যাই হোক এরিস্টটল কোনো ইংরেজি নাম না। গ্রিক নাম। উনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। উনার ধারণা ছিল মানুষের মাথার একমাত্র কাজ এয়ার কন্ডিশনিং-এর মতো বডি কন্ডিশনিং। শরীরের তাপ ঠিক রাখা। যেহেতু এরিস্টটলের মতো বড় মানুষ এই কথা বলেছেন, সবাই ধরে নিল মাথার এইটাই একমাত্র কাজ। মাথার কাজ নিয়ে কেউ আর কোনো চিন্তাভাবনাই করল না। পরের এক হাজার বছর এরিস্টটলের কথাই বহাল রইল। এর থেকে কি প্রমাণিত হয় বল।
প্রমাণিত হয় বড় বিজ্ঞানীদের সব কথা শুনতে হয় না।
গুড। তোমার বুদ্ধি ভাল। একশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিলাম। এখন থেকে তোমার বেতন তিনি হাজার একশ।
স্যার, আপনার অসীম দয়া। কিন্তু পায়ে ফ্যানের বাতাসের ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার হয় নাই।