মাঝে মাঝে আমি খালু সাহেবের অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। বেশির ভাগ সময়ই তাকে উত্তেজিত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাদল বিষয়ে উত্তেজনা।
বাদলের কাণ্ড শুনেছ?
নতুন কিছু করেছে?
নতুন কিছু না। সেই পুরানো গীত। বৌমার সঙ্গে ঝগড়া। বৌমা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে আছে।
আপনি বললেই তো খাওয়া শুরু করবে।
আমি কেন বলব? প্ৰতিবার আমাকে কেন ঝামেলা মিটাতে হবে?
আপনার কথা রানু ফেলতে পারবে না বলেই যা করার আপনাকে করতে হবে।
আমি যখন বেঁচে থাকব না, তখন কি হবে?
তখন একটা বিরাট সমস্যা হবে।
বৌমার জন্যে আমি টেনশানে অস্থির হয়ে থাকি। এত ডিপেনডেন্ট আমার উপর। সেদিন শাড়ি কিনবে রঙ পছন্দ করতে পারছে না। দোকান থেকে টেলিফোন করেছে। বাধ্য হয়ে অফিস বাদ দিয়ে গেলাম।
কি রঙ পছন্দ করলেন?
দুইটা শাড়ি ছিল, একটা হালকা সবুজ আর একটা কফি কালার। আমি কফি কালারটা পছন্দ করলাম।
আপনার দিনতো খালু সাহেব ভালই যাচ্ছে।
খালু সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলার মত ভান করে বললেন, এটাকে তুমি ভাল বলছ? বিশাল যন্ত্রণায় আছি। ঐ দিন তোমার খালার সঙ্গে রাগ করে বললাম, ভাত খাব না। বৌ মা সঙ্গে সঙ্গে বলল, বাবা খাবে না। কাজেই আমিও খাব না। তোমার খালা গেল আরো রেগে। বিরাট ক্যাচাল শুরু হয়ে গেল।
খালু সাহেবের সঙ্গে যতবারই কথা হয় আনন্দ পাই। একটা মানুষ জগতের আনন্দ যজ্ঞের নিমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। আনন্দ যজ্ঞে আমাদের সবার নিমন্ত্রণ। কিন্তু আমরা নিমন্ত্রণের কার্ড হারিয়ে ফেলি বলে যেতে পারি না। দূর থেকে অন্যের আনন্দ যজ্ঞ দেখি।
একদিন হাজতে সাত্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অল্প কিছুদিন হাজত বাসের কারণেই ভদ্রলোক বুড়িয়ে গেছেন। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে! আমাকে দেখে হাহাকার করে উঠলেন।
বাবা, আমাকে এই নয়ক থেকে বের করতে পারবে?
পল্টু স্যারকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এরা আপনাকে ছাড়বে না।
ওদেরকে বল, আমি খুঁজে বের করব। হারানো মানুষ খুঁজে বের করার অনেক সিস্টেম আছে। ঝাঁড়-ফুক আছে। জীন দিয়ে তদবিরের ব্যবস্থা আছে। যারা এসব করে তাদেরকে আমি চিনি।
দেখি কিছু করতে পারি কি-না।
তুমি অবশ্যই করতে পারবে। তোমার কথা এরা শুনবে এখানে এক হারামজাদার সঙ্গে আমাকে রেখেছে, সে রোজ রাতে আমার গায়ে পেশাব করে। তাকিয়ে দেখা কালো গেঞ্জি গায়ের বদমাইশটা।
আমি কালো গেঞ্জিওয়ালার দিকে তাকালাম। সে দাঁত বের করে বলল, গত রাতে পেশাব করি নাই, স্যার। উনারে জিজ্ঞেস করে দেখেন। যদি মিথ্যা বলি, আমি মানুষের জাত না।
সাত্তার সাহেব ধরা গলায় বললেন, কার সাথে আমাকে রেখেছে দেখেছ? এরচে মরণ ভাল না?
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, কথা সত্য স্যার।
সাত্তার সাহেব বললেন, এমিতেই সারা রাত ঘুম হয় না। হঠাৎ যদি কোনো কারণে চোখ লাগে এই বদমাইশটা পা দিয়ে খোঁচা দেয়।
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, গফ সাফ করার জন্যে আপনেরে জাগাই।
তোর সঙ্গে কি গল্প করব?
আমি দুইটা মার্ডার করছি এই গপ শুনবেন?
না— চুপ থাক।
শুনেন না। মজা পাইবেন। রাইতে হাতে ইট নিয়া ঘুরতাছি শোয়ার জায়গা পাই না। ভাল জায়গা পাইলে মাথার নিচে ইট দিয়া ঘুম দিব। হঠাৎ দেখি সাত আট বছরের এক পুলা ঘুমাইতাছে। সুন্দর চেহারা। ইট নিয়া আগাইলাম। মাথাত বাড়ি দিয়া মাথা থেতলায়া দিব এই আমার চিন্তা।…
সাত্তার সাহেব বললেন, আর বলবি না। চুপ চুপ।
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, চুপ চুপ কইরা লাভ নাই তোরে পুরা গল্প শুনতে হবে।
সাত্তার সাহেব হতাশ গলায় বললেন, হিমু এর হাত থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি কথা দিলাম। আমি মক্কা শরীফে যাব। সেখানে তাওবা করে শুদ্ধ হব।
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, স্যার আমারে সাথে নিবেন? আমি তওবা করব না। আমি দেখব। আমি তওবা বিশ্বাস করি না। পাপ করলে শাস্তি। তাওবা আবার কি? আমি শাস্তির জন্যে তৈয়ার। একবার একজনের বিচি ফালায়া খাসি বানায়া দিছিলাম। আমি এক না। আমরা ছিলাম তিন জন। দুই জন চাইপ্যা ধরছে। আমি অপারেশন করছি!
সাত্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি বলছে শুনছ? এই রকম একজনের সঙ্গে বাস করছি।
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, সুযোগ পাইলে আপনের উপরে একটা অপারেশনের ইচ্ছা আছে। একলা পারব না। আরো দুই তিন জন হাজতে ঢুকলে তারারে দলে টাইন্যা একটা চেষ্টা নিব। স্যার ছেপ খাবেন?
সাত্তার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, ছেপ খাব মানে!
কালো গেঞ্জিওয়ালা বলল, হা করেন। মুখে ছোপ দেই। খায়া দেখেন মজা পাবেন। দুষ্ট লোকের ছেপ খাইতে মজা। সাধু লোকের ছেপে মজা নাই। স্যার হা করেন।
আমি সাত্তার সাহেবকে এই অবস্থায় রেখে চলে এলাম। তিনি নরক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। এর জন্যে তাকে নরকে যেতে হয় নি। পৃথিবীতেই তাঁর জন্যে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যাপারগুলো কি কাকতালীয়ভাবে ঘটে? না কেউ একজন ব্যবস্থা করে দেন? এই বিষয়ে বিখ্যাত একটা কবিতাও আছে—
কোথায় স্বৰ্গ কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বৰ্গ নরক
মানুষেতে সুরাসুর।
আমি কালো গেঞ্জিওয়ালাকে দেখেছি–সে উত্তর মেরু হলে দক্ষিণ মেরুর একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। রোগা গাত্ৰ বৰ্ণ ধবধবে সাদা। হলুদ রঙের একটা শার্ট পরেছেন। শার্ট ছাপিয়ে তাঁর গায়ের রঙ ছিটকে বের হচ্ছে। তিনি বড় একটা এলুমিনিয়ামের হাড়ি হাতে ডাষ্টিবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয় আয় বলে কাকে যেন ডাকছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলাম, কাকে ডাকছেন?