মাজেদা খালা বললেন, ইস এতগুলো টাকা খামাখা নষ্ট। ওসি সাহেব কঠিন চোখে মাজেদা খালার দিকে তাকানোয় তিনি ঝিম মেরে গেলেন।
আমি আগের জীবনে ফিরে গেছি। পথে হাঁটা। আগে বেশির ভাগ সময় রাতে হাঁটতাম, এখন হাঁটি দিনে। যদি হঠাৎ পল্টু স্যারের দেখা পাওয়া যায়।
সেই সম্ভাবনা অবশ্যি ক্ষীণ। উনি মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। এ ধরনের মানুষেরা ডুব দিয়ে আড়ালে চলে যেতে চাইলে তাদের খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় না।
একদিন দেখা হয়ে গেল কিসলুর সঙ্গে। সে জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে তিন সাইজ বড় একটা মেরুন রঙের শার্ট পরে হাঁটছে। আমাকে হঠাৎ দেখে থমকে গেল। দৌড়ে পালিয়ে যাবার আগের পজিশন। যে কোনো মুহুর্তে অলিম্পিক দৌড় দেবে। আমি বললাম, কি অবস্থা?
জ্বি। ভাল অবস্থা?
পিস্তলের গুলি পাওয়া গেছে?
জ্বি না।
গুলি ছাড়া পিস্তলতো ছুরি কঁচির চেয়ে নিম্নস্তরের অন্ত্র। কোনো একটা মজা পুকুর দেখে ফেলে দাও।
জ্বি আচ্ছা।
চল একজনের কাছে নিয়ে যাই। সে নতুন ধারার রান্নার রেসিপি জানে।
রান্নার রেসিপি দিয়ে আমি কি করব?
একটা বিদ্যা শিখা থাকল। কোন বিদ্যা কখন কাজে লাগে। কিছুইতো বলা যায় না।
একটা জরুরি কাজ ছিল।
তোমার যে কাজ, দুপুর তার জন্যে উপযুক্ত সময় না। চল যাই ঘুরে আসি।
কিসলু বিরস মুখে বলল, চলুন।
তাকে নিয়ে গেলাম হাজতে দেখা হওয়া থুথুওয়ালার কাছে। সে থাকে কলাবাগানের সামনের নার্সারিতে। মালির কাজ করে। কিসলুকে দেখে সে বলল, রক্তের পুডিং কিভাবে রানতে হয় জানেন ভাইজান? এক গামলা টাটক রক্ত নিবেন। পরিমাণ মতো লবণ এবং গোলমরিচ দিবেন…
কিসলু বিড় বিড় করে বলল, একি পাগল?
আমি বললাম, নাহ্।
রক্তের পুডিং বানাতে চায় সে পাগল না?
তুমি গুলি করে রক্ত বের কর তোমাকে কেউ পাগল বলে না। আর এই বেচারা রক্তটাকে দিয়ে একটা খাদ্য বানানোর কথা বলছে তাকে পাগল বলছি। কথাটা কি ঠিক?
কিসলু চুপ করে রইল। থুথুওয়ালা বলল, হিমু ভাই, আপনার জন্যে একটা গাছের চারা আলাদা করে রেখেছি। একদিন এসে নিয়ে যাবেন।
গাছের নাম কি?
দুপুর মণি। ঠিক দুপুরে ফুটে; টিকটকা লাল রঙের ফুল। বিরাট সৌন্দৰ্য।
কিসলু আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাচ্ছে। সাহস করে বলতে পারছে না। আমি বললাম, তোমার বন্ধুর খবর কি? সোহাগ! সে আছে কেমন?,
জানি না।
জান না কেন? বন্ধু, বন্ধুর খোঁজ রাখবে না! তোমার মত লোকজনদের একা চলাফেরা করাও তো বিপজ্জনক।
বিদায় দেন যাই। জরুরি কাজ ছিল।
তোমাকে যখন পেয়েছি, এত সহজে ছাড়ছি না। চল দুই ভাই মিলে একটা ছিনতাই করি?
কি বললেন?
গুলি হোক বা না হোক, তোমার সঙ্গেতো একটা পিস্তল আছেই? ব্রিফকেস হাতে এমন কাউকে আটকাও। ব্রিফকেস রিলিজ করে আমার কাছে দাও। আমি ঝেড়ে দৌড় দিব।
কিসলু। এই পর্যায়ে নিজেই ঝেড়ে দৌড় দিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক পত্রিকা হকারের উপর। হকার গলা উঁচিয়ে বলল, ধর ধর।
ঢাকা শহরে কেউ একজন ধর ধর বলা মানে মহা বিপদ। চারদিক থেকে ধর ধর শুরু হয়ে গেল। কিসলু। প্ৰাণ পণে ছুটছে। তার পেছনে পেছনে অনেকেই ছুটছে। এদের সঙ্গে জুটেছে। একজন পুলিশ সার্জেন্ট। মনে হয় বেচারার আজকের আমদানি ভাল হয় নি। পুলিশ সার্জেন্টের আমদানি ভাল না হলে তারা আহত বাঘের মত হয়ে যায়। তখন তারা অসীম সাহসে ছিনতাইকারী ধরে।
কিসলুর পরিণতি দেখার জন্যেই আমাকে ছুটে যেতে হল। সে সার্জেন্টের হাতেই ধরা খেয়েছে। গণধোলাই শুরুর আগের অবস্থায় আমি উপস্থিত হয়ে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলাম। পল্টন্টু স্যারের ড্রাইভারের কারণে চোখ টিপটা আমি বেশ ভাল রপ্ত করেছি। পুলিশ সর্জেন্ট আমার চোখ টিপে উৎসাহিত! ধরেই নিয়েছেন আমদানী ভাল হবে। ব্যাংকে এলসি খোলা হয়ে গেছে। তিনি কঠিন গলায় বললেন, ভীড় করবেন না। যে যার কাজে চলে যান। একে আমি থানায় নিয়ে যাচ্ছি। জিজ্ঞাসাবাদ হবে।
জাগ্ৰত জনতা নিভে গেল। তবে তারা এত সহজে অকুলস্থল ছেড়ে যাবার মানসিকতা নেই। আমি উঁচু গলায় বললাম, এ আমার আপন ভাইগ্না! হেরোইন খায়। আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে দৌড় দিয়েছে। এক সঙ্গে গল্প করতে করতে যাচ্ছি–হঠাৎ মানিব্যাগ তুলে নিয়ে দৌড়। একে থানায় দিয়ে কোনো লাভ আছে? পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবে। আমি বরং একে কানে ধরে তার মার কাছে নিয়ে যাই। আপনারা চলে যাবেন না। আপনারা আমার পেছনে পেছনে আসুন।
পুলিশ সার্জেন্ট বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
আমি বললাম, পুলিশের সঙ্গে আমার কথা নাই। ইচ্ছা করলে আপনিও মোটর সাইকেল নিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসুন।
ঢাকা শহরে অনেক দিন পর একটা মজার দৃশ্যের অবতারণা হল। আমি কিসলুর কানে ধরে এগুচ্ছি। আমার পেছনে জাগ্ৰত জনতা! সবার শেষে মোটর সাইকেলে পুলিশ সার্জেন্ট। জনতার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আমি কিসলুর কানে কানে বললাম, তুমি তোমার বাড়িতে নিয়ে চল। এ ছাড়া গতি নাই। বাসা কোথায়?
কাওরান বাজার।
মা বাসায় আছেন তো?
হু।
ঢাকা শহরে যারা ঘোরাঘুরি করে তাদের বেশির ভাগেরই কোনো কাজ নেই। সবাই জুটে যাচ্ছে। মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকল। আমার ধারণা আজকের এই ঘটনার পর কিসলুর রূপান্তর হবে! ভালোর দিকে নাকি আরো মন্দের দিকে তা বলা অবশ্য বেশ কঠিন। অসম্ভব ভালো এবং অসম্ভব মন্দের বিভাজন রেখা অতি সূক্ষ্ম।