নূপুর বলল, না।
খাবারের আয়োজন ভাল না। খিচুড়ি এবং ডিম ভুনা। আজকের বিশেষ দিনের জন্যে উপযুক্ত খাবার নিশ্চয়ই না। ডিমও রান্না করা হয়েছে দুটা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্যে ব্যবস্থা! ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, খাবার কি এই?
নূপুর বলল, হ্যাঁ এই। শোন তুমি আগে খেয়ে নাও। আমি সজল ভাইকে নিয়ে পরে খাব। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা।
ওসি সাহেব বললেন, খাবারটা গরম কর। দুপুরের কিছু থাকলে ফ্রিজ থেকে বের কর। ডিম ভাজ। দুটা ডিম আমরা তিনজন কিভাবে খাব? ভদ্রলোককে আমি প্ৰায় জোর করে এনেছি।
নূপুর অনাগ্রহের সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে গেল। ওসি সাহেব আমাকে বললেন, ভাই, কিছু মনে করবেন না। আমার স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ কোনো মানুষ না। তাঁর ভয়াবহ এপিলেপ্সি আছে। একেকবার এপিলেপ্সির এটাক হয়। আর সে অদ্ভুত কোনো গল্প তৈরি করে। সব গল্পেই একজনের সঙ্গে তার প্ৰণয় থাকে। যার সঙ্গে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে মফস্বল কোনো শহরের কাজি অফিসে বিয়ে করে। বিয়ের পর পর সেই ছেলে স্ত্রী রেখে পালিয়ে যায়। সজল সে রকমই কেউ হবে। এপিলেপ্সি রোগ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
আমি বললাম, জানি। এপিলেপ্সিকে বলা হয় ধর্ম প্রচারকদের রোগ। অনেক ধর্ম প্রচারক এই রোগে ভুগতেন। আমার বাবারও এই রোগ ছিল।
তিনি কি ধৰ্ম প্রচারক?
হ্যাঁ তাঁর ধর্মের নাম মহাপুরুষ ধর্ম। এ বিষয়ে আপনাকে আরেকদিন বলব।
শেষ পর্যন্ত তিনজনই খেতে বসেছি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, টেবিলে অনেক খাবার। পোলাও আছে, মুরগির রোস্ট আছে, খাসির মাংসের রেজালা আছে। শুরুতে শুধু দুটা ডিম কেন দেয়া হয়েছিল কে জানে।
নূপুর বলল, সজল ভাই, আপনার সব কথা কিন্তু আমি আমার হাজবেন্ডকে বলে দেব। জানি আপনি রাগ করবেন। করলে করবেন।
ওসি সাহেব বললেন, কথাটা না বললেই হয়। একজন এ্যামবারাসড হবে এমন কথা বলার দরকার কি?
নূপুর বলল, এ্যামবারাস্ড হলে হবে। আমাকে উনি কি অবস্থায় ফেলেছিলেন সেটা জান? বিয়ে করবেন। এই কথা বলে তিনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করলেন। আমি তখন বাচ্চা একটা মেয়ে, ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাকে নিয়ে গেলেন কুমিল্লায়, সেখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে আমাকে তুলবেন। কুমিল্লায় গিয়ে পৌঁছলাম। সজল ভাই বন্ধুর বাড়ি আর খুঁজে পান।
ওসি সাহেব বললেন, তোমাদের তাহলে বিয়ে হয় নি?
বিয়ে কেন হবে না? কুমিল্লায় নেমে প্রথম আমরা ঠাকুরপাড়ায় এক কাজী অফিসে বিয়ে করলাম, তারপর বন্ধুর বাড়ি খুঁজতে বের হলাম।
ওসি সাহেব বললেন, বাড়ি কি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল?
নূপুর বলল, এত কথা তোমাকে বলব না। পরে এসব নিয়ে আমাকে খোটা দেবে। সজল ভাই, যেমন চুপচাপ খাচ্ছেন, তুমিও তাই কর। নিঃশব্দে খাও। সজল ভাই আমার রান্না কেমন?
অসাধারণ। রান্নার কমপিটিশন হলে সিদ্দিকা কবীর ফেল করবে।
সজল ভাই কি যে ঠাট্টা করেন! আমিতো উনার বই দেখেই রাঁধি।
যে রান্নার বই লেখে সে রাঁধতে পারে না।
নূপুর বলল, সজল ভাই! কুমিল্লার এক হোটেলে আমরা কি জঘন্য খাবার খেয়েছিলাম। আপনার মনে আছে? আপনি যে ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, এটা কিসের মাংস? কুকুরের না বানরের। হিঃ হিঃ হিঃ!
হাসতে হাসতে মেয়েটা গড়িয়ে পড়ছে। ওসি সাহেব দুঃখিত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজল। ওসি সাহেব গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
বাসার দরজার তালাবন্ধ। দারোয়ান বলল, স্যার সন্ধাবেলা রিকশা করে কোথায় যেন গেছেন। সঙ্গে চার-পাঁচটা বই ছিল। দারোয়ান নিজেই রিকসা ডেকে দিয়েছে।
পল্টু স্যার দারোয়ানের কাছে চাবি এবং চিঠি রেখে গেছেন। আমি বাসায় ফিরলে আমাকে যেন চিঠি এবং চাবি দেয়া হয়।
চিঠিতে লেখা——
হিমু,
অংকের একটা বই পড়তে পড়তে লকারের কম্বিনেশন নাম্বারটা মনে পড়ল। আমি ফিবোনাচ্চি সিরিয়েল ব্যবহার করেছি। ফিবোনাচ্চি সিরিয়েল হচ্ছে এর যে কোন সংখ্যার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। লকারের নাম্বারটা এই ভাবেই পেয়ে যাবে। নানান কারণে গৃহত্যাগ করলাম। ডাক্তাররা খোঁচাখুচি করে আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে, এটা আমার ভাল লাগছে। না। অন্যের কিডনী নিয়ে বাঁচার প্রশ্নই উঠে না। আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে না। যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে হারিয়ে যেতে দিতে হয়।
ইতি
তোমার স্যার।
নৈঃশব্দের সময়
ফিবোনাচ্চি সিরিয়েলের প্রথম সাতটি সংখ্যা
১ ১ ২ ৩ ৫ ৮ ১২ ২১
আমি চাচ্ছিলাম সবার সামনে লকার খুলতে। তা সম্ভব হল না। সাত্তার সাহেব হাজতে। পুলিশের ধারণা তিনিই পল্টু স্যারকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন, কিংবা গুম খুন করেছেন।
বাদল রানুকে পাওয়া গেল না। তারা হানিমুনে কাঠমুণ্ডু গিয়েছে। তারা যেদিন গেছে তার একদিন পর খালু সাহেবও চলে গেছেন। বৌমাকে না দেখে তার না-কি অস্থির লাগছিল।
লকার খোলার সময় মাজেদা খালা ছিলেন। ওসি সাহেব ছিলেন।
লকারে সীল গালা করা দলিল পাওয়া গেল। দলিল পড়ে জানা গোল তিনি তার সব কিছু দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। দলিল পড়ে ওসি সাহেবের চোখ ছলছল করতে লাগল। তিনি বললেন, পুলিশদের সমস্যা কি জানেন? তারা সব সময় খারাপ লোকদের দেখে চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক…। ভাল মানুষদের সঙ্গে তাদের দেখা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ যখন দেখা হয় তারা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ে।