খালু সাহেব হতাশ গলায় বললেন, বাদলের উপর ভরসা করা যায় না। কোনো একটা গাধামি করবে।। মেয়ে বলবে সব অফ!
আমি বললাম, মেয়েটার অফ বলার সম্ভাবনা আছে।
খালু সাহেব গলা আরো নামিয়ে বললেন, মেয়েটা যদি একবার টের পেয়ে যায় বাদল কত বড় গাধা তাহলে সে কি আর তাকে বিয়ে করবে? না-কি করা উচিত?
করা উচিত না।
এখন আমাদের কি করা উচিত সেটা বল।
এই দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা করা। বাই হুঙ্ক অর বাই কুক্ক।
এর মানে কি?
এর মানে যে কোনো মূল্যে বিবাহ। প্রয়োজনে হাজতেই কর্ম সমাধান করতে হবে। ওসি সাহেব হবেন সাক্ষী। আর আপনি এখন থেকেই বৌমা ডাকা শুরু করে দিন। কাজ এগিয়ে থাকুক।
থুথুওয়ালা আবার খালু সাহেবের দিকে এগুচ্ছে। খালু সাহেব রানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বৌমা তুমি আমার পাশে এসে বসতো! রানুর মুখে চাপা হাসি খেলে গেল। আর তখনি হাজতের দরজা খুলল। খালু সাহেব, রানু এবং বাদল ছাড়া পেয়ে গেল। আটকা পড়লাম আমি। থুথুওয়ালা খিকখিক করে হাসছে। সে এত মজা পাচ্ছে কেন কে জানে?
ধানমন্ডি থানার OC সাহেবের সামনে আমি বসে আছি। এই OC সাহেব নতুন এসেছেন। তাঁকে আমি আগে দেখিনি। ভদ্রলোককে মোটেই পুলিশ অফিসারের মতো লাগছে না। রোগা এবং অতিরিক্ত ফর্সা একজন মানুষ। গায়ে পুলিশের পোশাক নেই। গোলাপি রঙের। হাফসার্ট পরেছেন। প্যান্ট কি পরেছেন দেখতে পারছি না; গোপালি রঙের সার্টের কারণে তার চেহারায় বালক বালক ভাব এসেছে। গোলাপি না-কি মেয়েদের রঙ। কথা সত্যি হতে পারে।
ওসি সাহেবের সামনে একটা হাফ প্লেটে পান সাজানো। তিনি পান মুখে দিলেন। আয়েশ করে কিছুক্ষণ পান চিবানোর পর ঘন ঘন হেঁচকি তুলতে লাগলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, সিগারেট ছাড়ার জন্যে পান ধরেছি। কিন্তু জর্দাটা সহ্য হচ্ছে না। আগে দুই প্যাকেট সিগারেট খেতাম। চল্লিশ ষ্টিক।
আমি খানিকটা বিস্মিত হচ্ছি। ওসি সাহেবকে মনে হচ্ছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন। অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামীকে কোনো পুলিশ অফিসার কৈফিয়ত দেয় না।
আপনার নামতো হিমু?
জ্বি স্যার।
হিমালয় থেকে হিমু?
জ্বি স্যার।
রূপা নামের কাউকে চেনেন।
জ্বি স্যার।
ওসি সাহেব আরেকটা পান মুখে দিলেন। যথারীতি নতুন করে হেঁচকি শুরু হল। তিনি হেঁচকি দিতে দিতে টেলিফোনের বোতাম টিপছেন। একেকবার হেঁচকি দিচ্ছেন, একেকবার বোতাম টিপছেন। ব্যাপারটা যথেষ্টই ইন্টারেস্ট্রিং। ওসি সাহেবের টেলিফোনের বোতাম টেপা শেষ হল। তিনি টেলিফোন আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, কথা বলুন।
আমি বললাম, কার সঙ্গে কথা বলব?
ওসি সাহেব বললেন, হ্যালো বললেই বুঝতে পারবেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন। বলুন হ্যালো।
ওপাশ থেকে রূপার গলা শোনা গেল। রূপা বলল, কেমন আছ?
ভাল।
কতদিন পর তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে জান?
তিন বছর?
না। দুই বছর চার মাস। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ধরতে। ধরতে পারি নি। শেষে বাধ্য হয়ে ঢাকার সব কটা থানায় বলে রেখেছি— হিমু নামের একজন পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে থানায় আসবে। তখন যেন আমার সঙ্গে একটু যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়। এবার কি কারণে এ্যারেস্ট হয়েছ?
পুলিশের CID পরিচয় দিয়ে ধরা খেয়েছি।
এখন তোমাকে পুলিশ সাজতে হচ্ছে?
হুঁ। একে কি বলে জান? একে বলে একই অঙ্গে কত রূপ।
প্লিজ হেঁয়ালি না। স্বাভাবিকভাবে কথা বল। সাধারণ একটা কথা তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছা করছে।
ঠিক আছে, সাধারণ কথা বলছি। রান্নার একটা রেসিপি বলি? রক্তের পুডিং কি করে রান্না করতে হয় জান? প্রথমে এক গামলা গরম রক্ত নেবে। তারপর…
হিমু! কেন এ রকম করুছ?
সরি।
তোমার জন্যে বড় একটা সারপ্রাইজ আছে।
বল শুনি।
টেলিফোনে বলব না। তুমি আমার সামনে বসবে, তারপর বলব। সারপ্রাইজ পাবার পর তোমার মুখের কি অবস্থা হয় দেখব। পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাবার পর সরাসরি আমার কাছে আসবে। ঠিক আছে?
হুঁ।
হুঁ না। বল— আমি আসব।
আমি আসব।
গুড বয়। এখন বল আমি আজ যে শাড়িটা পরে আছি তার রঙ কি?
গোলাপি। আশ্চৰ্যতো। গোলাপি আমার পছন্দের রঙ না। আজই কি মনে করে যেন পরেছি। কিভাবে বললে?
ওসি সাহেব গোলাপি রঙের সার্ট পরেছেন, সেই থেকে মনে হল তুমিও গোলাপি রঙ পরেছ।
রূপা বিরক্ত গলায় বলল, ওসি সাহেবের সার্টের সঙ্গে আমার শাড়ির রঙের কি সম্পর্ক?
আমি জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। ওসি সাহেবের হেঁচকি থেমেছে। তিনি পানের প্লেটের দিকে লোভী লোভী চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে হয় আরেকটা পান মুখে দেবেন।
হিমু সাহেব!
জ্বি স্যার।
আপনিতো বিখ্যাত মানুষ!
জানি না স্যার।
আমাকে স্যার বলার প্রয়োজন নেই। আমি সামান্য পুলিশ অফিসার, আপনার মত কেউ না। এই থানার আগের ওসি সাহেবকে চার্জ বুঝিয়ে দেবার সময় তিনি বলেছেন, আপনার থানায় হিমু নামের কাউকে যদি গ্রেফতার করে আনা হয় তাহলে তাকে যতটা সম্ভব যত্ন করবেন। ওসি সাহেবের নাম কামরুল। চিনেছেন?
জ্বি না।
পুলিশের আইজি সাহেব একদিন থানা ইন্সপেকশনে এসেছিলেন। তিনিও হঠাৎ করে বললেন, হিমু নামের কেউ কখনো এ্যারেস্ট হলে তাকে যেন জানানো হয়।
জানিয়েছেন?
না। স্যার এখন কুয়ালালামপুরে। ইন্টারপোলের এক মিটিং-এ গেছেন। চা খাবেন?
খাব।
ওসি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চা আমার খুব পছন্দের পানীয় ছিল। সারা দিনে বিশ কাপ চা খেতাম। প্ৰতি কাপ চায়ের সঙ্গে একটা করে সিগারেট। বিশটা সিগারেট দিনে আর বিশটা রাতে। ইন টোটাল ফর্টি স্টিকস। আলাউদ্দিন এন্ড ফর্টি রবারস। এখন হিমু সাহেব বলুন, আপনাকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? জানি না। এই বাক্যটা বলবেন না। অবশ্যই জানেন। চা খেতে খেতে বলুন।