পল্টু স্যারকে তারা কিছু বলল না। পল্ট স্যার নির্বিকার ভঙ্গিতে ইলিশ মাছের বই পড়া শুরু করলেন। এত কিছু যে ঘটে যাচ্ছে তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই, তিনি পড়ছেন–ইলিশ আনারস।
ফলের মধ্যে শুধু আনারস দিয়ে ইলিশ রান্না হয় কেন বুঝলাম না। অন্য ফলগুলো কি দোষ করল?
আমি ইলিশ।
কালোজাম ইলিশ।
সাগর কলা ইলিশ।
বিদেশী ফল দিয়েও রান্নার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন আপেল ইলিশ, আঙুর ইলিশ। ইলিশ রান্নাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
পুলিশের গাড়িতে উঠার সময় দেখলাম সাত্তার সাহেবকে। গ্রেফতার নাটক দেখার জন্যে তিনি প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। তার হাতে পাইপ। চোখে সানগ্লাস। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে মধুর গলায় ডাকলাম, সাত্তার ভাই!
তিনি চমকালেন। আমার দিকে তাকালেন কি-না তা সানগ্লাস চোখে থাকার কারণে বুঝা গেল না। আমি বললাম, কক কক কক।
সাত্তার সাহেব কঠিন গলায় বললেন, তুই এসব কি বলছিস? আমি বললাম, কক কক বলছি। আমাকে অনুকরণ করা বাদলের দীর্ঘ দিনের স্বভাব। সেও বলল, কক কক কক।
এই মুহুর্তে বাদলের অতি ঘনিষ্ঠজন রানু। সে বাদলের অনুকরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। সে মিষ্টি গলায় বলল, কক কক কক।
আমরা কিক কক করতে করতে পুলিশের গাড়িতে উঠলাম।
থানা-হাজত দখল করে আছি
পারিবারিকভাবেই আমরা থানা-হাজত দখল করে আছি। রানুও আমাদের সঙ্গে আছে। মেয়ে হাজতীদের জন্যে আলাদা হাজত আছে জানা গেছে। সেখানে এক হাজতী না-কি হেগে-মুতে সর্বনাশ করে রেখেছে। মেথর আনতে লোক গেছে। মেথর সব পরিষ্কার করবে। তখন রানুকে সেখানে ট্রান্সফার করা হবে।
আমাদের হাজতে বাইরের লোক বলতে চার ফুট হাইটের একজন আছে। প্ৰচণ্ড গরমেও তার গায়ে চাদর। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে একটু পরপর থুথু ফেলছে এবং সেই থুথু তর্জন দিয়ে মেঝেতে ঘসছে। খালু সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, লোকটা এমন করছে কেন?
আমি বললাম, সে থুথু দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে।
কেন? পানি পাবে কোথায় যে পানি দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করবে? থুথুই ভরসা।
পাগল নাতো?
সম্ভাবনা আছে। আবার হেরোইনচিও হতে পারে।
হেরোইনচি কি?
এরা হেরোইন খায়। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব?
আরে না। হিমু! আজি যে আমাকে এমন একটা কারেক্টারের সঙ্গে হাজতে বসে থাকতে হচ্ছে তার মূলে আছ তুমি
আমি বললাম, কথাটা ঠিক না খালু সাহেব! আপনি অস্ত্ৰ হাতে ধরা পড়েছেন।
খালু সাহেব বললেন, এটা আমার লাইসেন্স করা পিস্তল। অস্ত্ৰ হাতে ধরা পড়েছি বলছি কেন?
আমি বললাম, খুনের উদ্দেশ্যে আপনি অস্ত্ৰ হাতে বসেছিলেন। এটেম্ট্ টু মার্ডার। এখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই।
রানু বলল, অবশ্যই ভূমিকা আছে। আপনার কারণেই বাদলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আপনি না থাকলে এসব কিছুই হতো না। বাদল থাকতো তার জায়গায় আমি থাকতাম। আমার জায়গায়। উনিও পিস্তল হাতে আসতেন না। পুলিশের হাতে ধরা পড়তেন না।
খালু সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, তুমি কি বল?
আমি হঁয়া সূচক মাথা নাড়লাম! খালু সাহেব বললেন, চেহারাও সুন্দর। বুদ্ধি এবং রূপ একসঙ্গে পাওয়া যায় না। বাদলটার দিকে তাকিয়ে দেখ— রূপ আছে। বুদ্ধি এক ছটাকও নেই। তুমি কি আমার সঙ্গে একমত?
একমত।
তুমিতো অনেকবার হাজতে থেকেছ! হাজত থেকে বের হবার বুদ্ধি কি?
আমি বললাম, গুরুত্বপূর্ণ লোকজনকে টেলিফোন করতে হবে, এরা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। আপনার গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়-স্বজনের একটা তালিকা মনে মনে তৈরি করুন।
রানু বলল, এই কাজ কখনো করা যাবে না। কাউকে জানানো যাবে না। পুলিশ আমাদের ধরে হাজতে রেখেছে। এটা জানলে বিরাট সমস্যা হবে।
খালু সাহেব আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, মেয়েটাকে যতটুকু বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম, এ তারচেয়েও বুদ্ধিমতী। আই এ্যাম ইমপ্রেসড। মেয়েটার উপর থেকে রাগ দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। কি করি বলতো।
রাগ ধরে রাখতে চান?
হ্যাঁ।
মেয়েটা কি কথা বলছে তা শুনবেন না। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। আপনি খুথুওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকুন।
খালু সাহেব থুথুওয়ালার দিকে তাকাতেই থুথুওয়ালা বলল, স্যার, স্লামালিকুম।
খালু সাহেব ভীত গলায় বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।
থুথুওয়ালা বলল, পুডিং খাইবেন?
খালু সাহেব বললেন, পুডিং খাব মানে কি? কিসের পুডিং?
রক্তের পুডিং।
থুথুওয়ালা বসে বসে খালু সাহেবের দিকে এগুচ্ছে। খালু সাহেব আতংকে অস্থির। থুথুওয়ালা বলল, এক গামলা টাটকা গরম রক্ত নিবেন। তার মধ্যে লবণ দিবেন, বাটা লাল মরিচ দিয়া ঘুটবেন। অতঃপর ঠাণ্ডা জায়গায় রাখবেন। জমাট বাইন্ধা পুডিং হয়ে যাবে। চাইলের আটার রুটি দিয়া খাইবেন। বিরাট স্বাদ।
রানু থুথুওয়ালার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, যেখানে ছিলে সেখানে যাও। আজেবাজে কথা বলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবে না। আমরা ভয় খাওয়ার লোক না। আর একটা শব্দ করেছ কি থাবড়ায়ে তোমার দাঁত ফেলে দিব। জন্মের মতো রক্তের পুডিং খাওয়া গুছায়ে দেব। বদমাস কোথাকার।
থুথুওয়ালা ভয় খেয়েছে। সে তার জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। খালু সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললেন, বাদল গাধাটা যে এমন অসাধারণ একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, শুধুমাত্র এই কারণে এ জীবনে সে যত অপরাধ করেছে সব ক্ষমা করে দিলাম।
আমি বললাম, পছন্দে লাভ হবে না। বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এ রকম মেয়ে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।