আমি বললাম, পয়সা দিলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। দুজন ডাক্তার বলেছে পল্টু স্যার পাগল। দশজন বলবে পাগল না। হাইকোর্টে আপিল হবে। উল্টা মামলা হবে যে, সুস্থ মানুষকে পাগল সাজিয়ে সম্পত্তি দখলের ষড়যন্ত্র।
মামলা মোকদ্দমা আমি ভয় পাই না।
ভয় না পাওয়া ভাল। আমি একটা প্ৰস্তাব দেই?
কি প্রস্তাব?
আমি কিছুক্ষণ শীতল চোখে তাকিয়ে তুই থেকে আপনিতে উঠে এলাম। গলার স্বর নিচু করে বললাম, আমাকে দলে নিন। পটু স্যারের সম্পত্তির পার্সেন্টেজের বিনিময়ে আমি আপনার হয়ে কাজ করব।
কত পার্সেন্টেজ?
আপনিই বলুন কত। গুরুত্ব বুঝে বলবেন।
সাত্তার সাহেব চুপ করে আছেন। বিরাট ধাঁধায় পড়ে গেছেন। ধাঁধায় পড়ারই কথা। আমি বললাম, বাসায় যান। বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন। আমার নিজের প্রস্তাব হল ফিফটি-ফিফটি। যদি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকেন। কিসলুকে দিয়ে একটা শাদা গোলাপের তোড়া পাঠাবেন। শাদা হচ্ছে সন্ধির প্রতীক।
কিসলুটা কে?
আমি বললাম, নাম শুনে মনে হল আকাশ থেকে পড়েছেন। কিসলু আপনার ছেলের বন্ধু। একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পিস্তলের যে গুলি আছে সেটা পিস্তলে ফিট করে না। চিনেছেন?
হুঁ।
চা খাবেন?
না।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করুন। একটা আপনি হাতে নিন, একটা আমার হাতে দিন। সিগারেটের রঙ শাদা। দুজন দুজনকে শাদা লাঠি দেখাচ্ছি। তার মানে কি বুঝতে পারছেন? শান্তির চেষ্টা।
সাত্তার সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। একটা বাড়িয়ে দিলেন। আমার দিকে। ভদ্রলোকের ব্রেইন এখনো পুরোপুরি কাজ করছে না।
আমি সিগারেট উঁচু করে বললাম, শান্তি। শান্তি। শান্তি।
সাত্তার সাহেবও বিড়বিড় করে বললেন, শান্তি শান্তি। আমি বললাম, আপনি সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ুন। আপনি যেখানে ধোঁয়া ছাড়বেন। আমিও সেখানে ধোঁয়া ছাড়ব। মানুষ শান্তির পতাকা উড়ায়, আমরা উড়াব শান্তির ধোয়া। ঠিক আছে?
হুঁ।
শান্তির ধোঁয়া উড়ানো হল। শান্তির ধোঁয়া উড়িয়ে সাত্তার সাহেব আরো জবুথবু হয়ে গেলেন। আমি বললাম, বাসায় চলে যান। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে লম্বা ঘুম দিন। মাথা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনারু, ঘুম দরকার।
হুঁ।
একা একা সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারবেন, না-কি আমার সাহায্য লাগবে?
এক নামতে পারব।
গুড। তাহলে বিদায়। মনে রাখবেন, আমার অফার ফিফটি-ফিফটি।
অল কোয়ায়েট অন দি ইস্টার্ন ফ্রন্ট। ভুল বললাম, সব ফ্রন্টেই শান্তি। ঘরের কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে আবার শুরু হয়েছে। রানু রান্না শুরু করেছে। বাদল আছে সহকারী।
আজকের মেনু—
চিংড়ি মাছ দিয়ে করলা।
মলা মাছের চচ্চড়ি।
কুমড়া ফুলের বড়া।
চিতল মাছের গাদা দিয়ে কোপ্তা।
স্ট্যান্ড বাই আইটেম খাসির কলিজা ভুনা।
কলিজা মশলা মাখিয়ে রেডি করা। সময় পাওয়া গেলে রান্না হবে। সময় পাওয়া না গেলে রান্না হবে না। বলতে ভুলে গেছি, বিশেষ ধরনের চাল আজ প্রথম রান্না হবে। চালের নাম বাঁশফুল। চালটা দেখতে মোটা। রান্না হলে চিকন হয়ে যায়। বাঁশ গাছের ফুল ফুটলে যেমন গন্ধ ছড়ায় সে রকম গন্ধ আসে।
পটু স্যারের বিষাক্ত গাছপালার পাঠ শেষ হয়েছে। এখন তিনি পড়ছেন— মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখা বই তবকত-ই-নাসিরি। মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ। এ ধরনের বইপত্র তিনি কোত্থেকে যোগাড় করেন তাও এক রহস্য।
আমার হাতে কোনো কাজ নাই। আমি বারান্দায় বসে ঝিামাচ্ছি। ঝিমুনি হল নিদ্রার আগের অবস্থা! এই অবস্থায় কনশাস এবং সাব-কনশাস দুটিই কিছু পরিমাণে জাগ্রত থাকে বলে অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। রাশিয়ান বৈজ্ঞানিক মেন্ডেলিফ পেরিওডিক টেবিল চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক কেকুলে বেনজিনের গঠন দেখতে পেয়েছিলেন। আমি তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না, তবে রান্নাঘরে বাদল এবং রানু কি বলাবলি করছে তা শুনতে পারছি। প্রতিটি বাক্যের আলাদা অর্থও বুঝতে পারছি। যেমন বাদল বলল, চামচের স্টান্ডার্ট ঠিক না; আরো লম্বা চামচ হওয়া উচিত। তাহলে আর তোমার হাতে গরম তেলের ছিটা পড়ত না। (গূঢ় অর্থ–তোমার হাতে গরম তেলের ছিটা পড়ছে। আমার খারাপ লাগছে।)
রানু বলল, রান্না করতে গেলে একটু-আধটু তেলের ছিটা খেতে হয়। আপনি এত কাছে থাকবেন না, আপনার গায়ে লাগবে। (গূঢ় অর্থ–ওগো, গরম তেল আমার গায়ে লাগে লাগুক, তোমার গায়ে যেন না লাগে।)
আমি দাঁড়িয়ে থাকব। (গূঢ় অর্থ— তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না।)
রানু বলল, হাত ধরে থাকলে আমি নাড়ানাড়ি করব কিভাবে? আপনিতো ভাল পাগল! (গূঢ় অর্থ–প্রহর শেষের আলোয় রাঙা, সেদিন চৈত্র মাস। তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!)
মঞ্চ নাটকে কি হয়? অতি আবেগঘন মুহুর্তে ভিলেনের প্রবেশ ঘটে। নাটকের ভাষায় ক্লাইমেক্স তৈরি হয়।
ক্লাইমেক্স তৈরি হয়ে গেল। ভিলেন হিসেবে মঞ্চে প্ৰবেশ করলেন বাদলের বাবা, আমার শ্রেদ্ধেয় খালু সাহেব। আমি আদরের সঙ্গে তাঁকে ঘরে নিয়ে বসালাম। ঠোঁটে আঙুল রেখে চাপা গলায় বললাম, যা বলবেন, ফিসফিস করে বলবেন। এই বাড়িতে একজন প্রথম শ্রেণীর ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাওয়া পাগল বাস করেন। তিনি এখন বই পড়ছেন। তার পাঠে বিঘ্ন হলে কি করে বসবেন ঠিক নেই। উঁকি দিলেই পাগল দেখতে পাবেন।
খালু সাহেব উঁকি দিয়ে পাগল দেখে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, পায়ে ফ্যানের বাতাস দিচ্ছে না-কি?