আমি পন্টু সাহেবের সামনে বসে আছি। ভদ্রলোক বেতের ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। মাথার নিচে বালিশ। হাতে একটা চটি ইংরেজি বই নাম Love of Lucy লুসির প্ৰেম। বইয়ের কভারে একটা অর্ধনগ্ন বিশাল বক্ষা মেয়ের ছবি। মনে হচ্ছে এই মেয়েটিই লুসি। লুসি। যার প্রেমে পড়েছে তার ছবিও কভারে আছে। বডিবিল্ডার টাইপ এক নিগ্রো। সে কুস্তিগীরের ভঙ্গিতে লুসিকে জড়িয়ে ধরে আছে। কুস্তিগীর লুসির ঘাড়ে চুমু খাচ্ছে। কিন্তু ছবি দেখে মনে হচ্ছে সে লুসির ঘাড় কামড়ে ধরেছে এবং ড্রাকুলার মতো রক্ত চুষে খেয়ে নিচ্ছে। লুসি তাতে মোটেই দুঃখিত না, বরং আনন্দিত।
পল্টু সাহেব গভীর মনযোগে বই পড়ছেন। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন। মনে হচ্ছে লুসির প্রেমের শেষ পরিণতি না জেনে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। ভদ্রলোকের মুরগির মতো কিক কক শব্দ করার কথা। তা করছেন না। কক কিক শব্দ করার মত ভাল বোধ হয়। এই বই না।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের মতো, ভয়ংকর রোগা। গায়ের রঙ অতিরিক্ত ফরসা। কিছু কিছু চেহারা আছে দেখেই মনে হয় আগে কোথায় যেন দেখেছি। এ রকম চেহারা। আইনষ্টাইনের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের একটা মিল আছে! মাথায় বাবরি চুল। মুখে গোঁফ। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। খালি গায়ে। লুঙ্গি পরেছেন। সেই লুঙ্গি দূরবতী বিপদ সংকেতের মতো হাঁটুর উপর উঠে আছে। কখন দুর্ঘটনা ঘটবে কে জানে!
পল্টু সাহেব তার পা জলচৌকিতে রেখেছেন। পায়ের কাছে টেবিল ফ্যান। সেই ফ্যান শুধুমাত্র পায়ে বাতাস দিচ্ছে। ঘটনোটা কি বুঝা যাচ্ছে না। ঘটনা বুঝতে হলে লুসির প্ৰেম কাহিনীর সমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ভদ্ৰলোক বাস করেন গুলশান এলাকার ফ্ল্যাট বাড়িতে। ফ্ল্যাটটা বেশ বড় { লেকের পাশে। একটা আধুনিক ফ্ল্যাট যতটা নোংরা রাখা সম্ভব তা তিনি রেখেছেন। মনে হচ্ছে ঘর পরিষ্কার করার কেউ নেই। যেখানে সেখানে বই পরে আছে। বেশ কিছু সিগারেটের টুকরা ভর্তি আধা খাওয়া চায়ের কাপ। একটা চায়ের কাপ মেঝেতে কত হয়ে আছে; অনেকখানি জায়গা জুড়ে চা শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। পিপড়েরা খবর পেয়ে গেছে। তবে রান্নাঘর তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। রান্নাঘরের ব্যবহার মনে হয় নেই।
বাথরুমে উকি দিলাম। বাথটাব, ভর্তি ভেজা কাপড়। কমোড়ের কাছে সবুজ রঙের একটা তোয়ালে। বেসিনের উপর একটা পিরিচে অ্যািধ খাওয়া কেক এবং কলার খোসা। বোঝাই যাচ্ছে, পন্টু সাহেব বাথরুমে খাওয়াদাওয়া করা দোষণীয় মনে করেন না।
ফ্ল্যাটের সাজসজ্জা বলতে দেয়ালে একটি বিশাল সাইজের বাধানো চার্লি চ্যাপলিনের ছবি। আরেকটা মাঝারি সাইজের আইনষ্টাইনের ছবি। আইনষ্টাইন জিভ বের করে ভেংচি কাটছেন।
পল্টু সাহেব লুসির প্ৰেম কাহিনী পড়ে শেষ করেছেন। বই পড়ে আনন্দিত হলেন কি-না বুঝতে পারছি না। ভুরু কুঁচকে আছে। তিনি বই মেঝেতে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, নাম বল।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, নাম লাভ অব লুসি।
বইয়ের নাম জানতে চাচ্ছি না। বইয়ের নাম জানি। তোমার নাম বল।
স্যার, আমার নাম হিমালয়।
হিমালয় নাম শুনলে সবার মধ্যেই কিছু কৌতুহল দেখা যায়। তাঁর মধ্যে দেখা গেল না। যেন মানুষের নাম হিসেবে হিমালয়, এভারেস্ট, মাউন্ট ফুজি জাতীয় নাম শুনে তিনি অভ্যস্ত।
পল্টু সাহেব ইজি চেয়ারের হাতলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, চুরির অভ্যাস আছে?
না।
সত্যি বলছতো?
জ্বি স্যার।
তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে বললেন, তুমি সত্যি বলছি না। চুরির অভ্যাস নেই এমন মানুষ তুমি কোথাও পাবে না। বড় মানুষরা আইডিয়া চুরি করে। বিজ্ঞানীরা একজন আরেকজনের আবিষ্কার চুরি করেন। মানব জাতির সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে চুরির উপর বুঝেছি?
জ্বি স্যার।
বেতন কত চাও বল? কত হলে পুষাবে সেটা বল। বেতন নিয়ে মুলামুলি করার সময় আমার নেই।
আমি ধাঁধায় পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছে বাসার চাকর হিসেবে তিনি আমাকে এপিয়েন্টমেন্ট দিয়ে ফেলবেন।
আগে যে ছিল সে মহাচোর। টিভি, ক্যাসেট প্লেয়ার, ডিভিডি সেট নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওর নাম হাশেম। টাকা-পয়সাও নিয়েছে। কত নিয়েছে বের করতে পারি নি। তুমি কি চুরি করবে। আগে ভাগে বল। আমি সোজাসুজি আলাপ পছন্দ করি। বল কি চুরি করবে?
যা ছিল সবাতো আগেরজন নিয়েই গেছে। আমি আর কি নেব। হাশেম ভাইজানতো আমার জন্যে কিছু রেখে যান নি।
আগেরজনকে মাসে তিনি হাজার টাকা দিতাম প্রাস থাকা-খাওয়া। চলবে?
জ্বি স্যার, চলবে।
রান্না করতে জান?
না।
না জানলেও সমস্যা নেই। রেস্টুরেন্টের সঙ্গে ব্যবস্থা করা আছে তারা খাবার দিয়ে যায়। এটা একদিক দিয়ে ভাল। রান্নাঘরে চুলা জুলবে না। মসলার গন্ধ, ধোয়ার গন্ধ আমার কাছে অসহ্য লাগে। কাপড় ধুতে পোর? ওয়াসিং মেশিন আছে। ওয়াশিং মেশিনে ধুবে।
শিখিয়ে দিলে পারব।
আরেক যন্ত্রণা। তোমাকে কে শিখাবে? আমি নিজেও তো জানি না। ইনসট্রাকসান ম্যানুয়েল কোথায় গেছে কে জানে।
আমি বললাম, ধোপাখানায় কাপড় দিয়ে আসতে পারি।
পল্টু সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভালো বুদ্ধি। গুড। ভেরি গুড। যাও কাজে লেগে পর l
আমি কদমবুসি করে কাজে লেগে পড়লাম। কিডনী বিষয়ক জটিলতায় গেলাম না। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। পল্টু সাহেব অন্য একটা বই হাতে নিয়েছেন। বইটার নাম–The trouble with physics. লেখকের নাম Lee Smokin. কাজের ছেলে হিসেবে আমাকে এপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার পর তিনি মনে হয় আমাকে মাথা থেকে পুরোপুরি দূর করে দিয়েছেন। আমার নামও ভুলে গেছেন। এ ধরনের মানুষরা কোনো কিছুই মনে রাখতে পারে না।