আমি বললাম, স্যার, কথা নাই। যে লোক দিনরাত বই পড়ে এবং পায়ে ফ্যানের বাতাস দেয় সে তো মানসিক ভারসাম্যহীন বটেই।
সাত্তার সাহেব বললেন, গুড! তুই ইন্টেলিজেন্ট। তোকে আমার পছন্দ হচ্ছে। শুরুতে বদমাইশ টাইপ মনে হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে না।
আমি ছুটে গিয়ে সাত্তার সাহেবকে কদমবুসি করে ফেললাম। চাকরশ্ৰেণীদের নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে–প্রশংসাসূচক কিছু শুনলেই অতি দ্রুত কদম বুসি করা তার একটি। সামান্য ধমক দিলে আড়ালে অশ্রুবর্ষণও নীতিমালার অংশ। আড়ালেরও বিশেষত্ব আছে! আড়ালটা এমন হতে হবে যে যিনি ধমক দিয়েছেন তিনি দেখতে পান।
হিমু!
জ্বি স্যার।
তোর স্যারের বিশাল বিষয় সম্পত্তির বিষয়ে তোরা অবগত আছিস কি-না আমি জানি না। আমার কাছে শুনে রাখা। তার বিষয় সম্পত্তি যথেষ্টই আছে। মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের কাছে এতবড় সম্পত্তি থাকা ঠিক না। দেখা যাবে হঠাৎ উইল করে সে সম্পত্তি লিখে দিল— তার পোষা বিড়ালকে। বা কুকুরকে।
আমি বললাম, স্যারের কোন পোষা কুকুর-বিড়াল নাই।
সাত্তার সাহেব বললেন, আমি কথার কথা বলছি। যাই হোক, এই সমস্ত নানান বিবেচনায় প্রেক্ষিতে কোটি আমাকে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়েছে। তার যাবতীয় বিষয় আমি দেখব। সে ব্যাংকের সঙ্গে কোন রকম লেনদেন করতে পারবে না। যে বিপুল অপচয় সংসারের জন্যে করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। পটু কখনো গাড়ি নিয়ে কোথাও যায় না। অকারণে একটা গাড়ি পড়ে আছে। মাসে মাসে ড্রাইভারের বেতন গোনা হচ্ছে। আজ থেকে ড্রাইভার অফ।
ড্রাইভার বলল, স্যার, এটা আপনি কি বলেন?
সাত্তার সাহেব বললেন, কি বলি কানো শুনা না? কানো ঠাসা লোক গাড়ি কিভাবে চালাবে? পেছন থেকে গাড়ি ডাবল হর্ন দিলেও তো কিছু শুনবে না। তোমার চাকরি ডাবল অফ। যাও নিচে যাও। পাওনা বেতন থাকলে মিটিয়ে দেয়া হবে।
ড্রাইভার নিচে নেমে গেল। সাত্তার সাহেব বাদলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ডিউটি কি?
বাদল কিছু বলার আগেই আমি বললাম, সে, সে আমার First এসিসটেনষ্ট।
তোর আবার এসিসটেন্টও লাগে? এসিসটেন্টের চাকরি অফ। নাম কি? নাম বলে নিচে চলে যা। কি নাম?
বাদল।
ঝড় তুফান বৃষ্টি বাদলা এই বাড়িতে চলবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে রানুর চাকরিও চলে গেল। তাকেও নিচে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে দাঁড়াতে হল।
এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু পল্টু স্যার নির্বিকার। তিনি বিষাক্ত গাছপালা নিয়েই আছেন। এই মুহূর্তে তাঁর চেয়ে সুখি কেউ পৃথিবী নামক গ্রহে আছে তা মনে হচ্ছে না।
আপনি হিসাবে ভুল করছেন।
সাত্তর সাহেব খ্যাকাখ্যাক করে বললেন, আমি হিসাবে ভুল করছি মানে? কিসের হিসাব? কিসের ভুল? তুই আমার ভুল ধরার কে?
আমি মাঠে নামলাম। হোমিওপ্যাথ সাহেবের যন্ত্রণা অনেকক্ষণ সহ্য করা গেছে। আর না। এখন যুদ্ধং দেহি।
আমি বললাম, তুই তোকারি অনেকক্ষণ ধরে করছিস। আর একবার তুই বললে কাপড়-চোপড় সব খুলে ফেলব। তোকে নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। আজ তুই আন্ডারওয়ার পরে আসিস নাই কেন? তাহলে আন্ডারওয়ার পরে নামতে পারতি, কিছুটা ইজ্জত রক্ষা হতো।
সাত্তার সাহেব হঠাৎ গভীর জলে পড়ে গেলেন। তাঁর মস্তিষ্ক খানিকটা জট পাকিয়ে গেল। চাকরীশ্রেণীর একজন এমন কথা কিভাবে বলছে— মস্তিষ্ক তার লজিক খুঁজছে। লজিক দ্রুত খুঁজে না পেলে কম্পিউটারের মতো সিস্টেম হ্যাংগ করবে। সাত্তার সাহেব ঘামতে শুরু করেছেন। তার চোখ লাল। হ্যাংগ হবার দিকেই তিনি যাচ্ছেন।
আমি এবার তাঁর সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। তাঁর মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা করার জন্যে বললাম, তোকে দেখে মনে হয় তুই ইন্টেলিজেন্ট লোক! তোর সঙ্গে কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। আমাকে চিনতে পারিস নাই? আমি CID-র লোক। আমাকে রাখা হয়েছে যেন আমি পল্টু সাহেবের কোনো বিপদ হয় কি-না সেটা দেখার জন্যে। বিশ্বাস হয়?
সাত্তার সাহেব হা করে তাকিয়ে আছেন। তার ব্রেইন এখনো হ্যাংগ অবস্থায় আছে। আমি বললাম, একটা কাজ করলেই তুই বিশ্বাস করবি। দ্বিতীয় প্রশ্ন আর মাথায় আসবে না।
আমি কথা শেষ করেই বাঁ হাতে আচমকা এক চড় বসিয়ে দিলাম। সাত্তার সাহেব চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেন। অস্ফুট শব্দও করলেন— ও খোদা রে!
পল্টু স্যার বই থেকে মুখ তুলে বিরক্ত স্বরে বললেন, কি হচ্ছে?
আমি বললাম, কিছুই হচ্ছে না স্যার, সামান্য আর্গুমেন্ট।
আর্গুমেন্ট বাইরে গিয়ে কর। তোমাদের যন্ত্রণায় পড়তেও পারছি না।
আমি সাত্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিনীত গলায় বললাম, স্যার, চলুন আমরা বসার ঘরে যাই। নিজেদের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে তার সমাধান করি। রুদ্ধ দ্বার বৈঠক।
সাত্তার সাহেব নিঃশব্দে বসার ঘরে চলে গেলেন। তিনি এখনো বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখায় আছেন। এখান থেকে বের হতে তাঁর সময় লাগবে।
বসার ঘরে আমরা দুজন মুখোমুখি বসে আছি। সাত্তার সাহেব কিছু বলার পরিকল্পনা নিয়ে কয়েকবার গলা খাকাড়ি দিলেন। কিছু বলতে পারলেন না।
আমি বললাম, ইচ্ছা করলে আমার বিষয়ে CID অফিসে খোঁজ নিতে পারিস। হায়ার লেভেলে খোঁজ নিতে যাবি। বলবি সিরাজুল ইসলাম নাম। হিমু আমার ছদ্মনাম।
সাত্তার সাহেব বললেন, আমি ঝামেলা পছন্দ করি না। আপনি পুলিশের লোক হোন আর যেই হোন, আমি কোর্টের অর্ডার নিয়ে এসেছি। দুজন ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়েছে যে পল্টু পাগল। একজন হলেন প্রফেসর কেরামত আলি, এসোসিয়েট প্রফেসর অব সাইকিয়াট্ট।