আমি ঠিকানা দিয়ে বললাম, আজ না এসে আপনি বরং আগামীকাল সন্ধ্যায় আসুন।
আজি এলে সমস্যা কি?
আজ বৃহস্পতিবার। আপনার বোতল দিবস। আজ এলে আপনার বোতল দিবসটা মাটি হবে। কাল সন্ধ্যায় আসুন, হাতেনাতে আসামি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান।
বাদল কি সত্যি চাকরের কাজ নিয়েছে?
জ্বি।। তবে পাৰ্ট টাইম কাজ। এটা একটা আশার কথা। খালু সাহেব, বুঝতে পারছি আজ আপনার মন খুবই অশান্ত। এক কাজ করেন, আজ একটু সকাল সকল ছাদে চলে যান। ওমর খৈয়াম বলেছেন—
রাখি তোমার ওমর খৈয়াম। আমি কি চীজ, বাদল কাল সন্ধ্যায় জানবে।
রানু-বাদল কথামালা আবার শুরু হয়েছে। আমি লকারের রিং ঘুরাচ্ছি এবং কথা শুনছি।
রানু : জানেন, আমার খুব শখ টিভি নাটকে অভিনয় করা। কিন্তু এত বাজে চেহারা কে আমাকে নেবে বলুন।
বাদল : তোমার চেহারা খারাপ কে বলল?
রানু : সবাই বলে।
বাদল : আমার সামনে বলে দেখুক।
রানু : আপনার সামনে বললে আপনি কি করবেন?
বাদল : আমি ঘুঁসি দিয়ে নাকসা ফাটিয়ে দেবো।
রানু : (হাসি)।
ঘটনা দ্রুত ঘটছে। কোন দিকে যাচ্ছে তাও বুঝা যাচ্ছে।
আনন্দিত মানুষের বর্ণনা
লেখকরা আনন্দিত মানুষের বর্ণনা নানানভাবে করেন। কেউ লেখেন— লোকটা আনন্দে ঝলমল করছে। কেউ লেখেন–সে আনন্দো আটখানা। রবীন্দ্রনাথ লেখেন বিমলানন্দের চাপা আভায় তাহার মুখমণ্ডলে…
এই মুহুর্তে আমি যাকে দেখছি তার আনন্দ কবি-সাহিত্যের ভাষায় প্ৰকাশ করা কঠিন। আনন্দে আটখানার জায়গায় আনন্দে এগারোখানা বলতে পারি। তাতেও ইতার-বিশেষ হয় না।
আনন্দিত ভদ্রলোকের নাম আবদুস সাত্তার। ডবল স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক MC. MR. PL, শেফা ক্লিনিকের কর্ণধার। তিনি বসে আছেন পল্টু স্যারের সামনের বেতের চেয়ারে। তাঁর হাতে হলদিরামের শনপাপড়ির প্যাকেট। সন্দেশ রসগোল্লার মরণঘন্টা সম্ভবত বেজে গেছে। হলদিরাম বাবুরা বেঁটিয়ে সব বিদায় করার সংকল্পে নেমেছেন।
সাত্তার সাহেব শনপাপড়ির প্যাকেট পল্টু স্যারের দিকে এগিয়ে বললেন, নে, তোর জন্যে এনেছি। ঘিয়ে ভাজা শানপাপড়ি। অমৃতের কাছাকাছি।
পল্টু স্যার হাত বাড়িয়ে প্যাকেট করা অমৃত নিলেন।
সাত্তর সাহেব বললেন, তোর চাকরিটাকে বল, প্যাকেট খুলে সুন্দর করে সাজিয়ে মিষ্টি দিতে। ওটার নাম যেন কি কাঞ্চনজঙ্ঘা না?
ওর নাম হিমু।
সাত্তার সাহেব আমাকে ডাকার আগেই আমি ছুটে গেলাম। চাকরদের দিলাম। সাত্তার সাহেবের ধমক দেয়ার কথা। ধমক দিলেন না। মধুর গলায় বললেন, ভাল আছিস?
জ্বি স্যার, ভাল আছি।
একটা শনপাপড়ি তুই নিয়ে যা। আরাম করে খাঁ। আমি বললাম, স্যার, একটা নিলে হবে না। আমরা চারজন। অনুমতি দিলে চার পিস নিয়ে যাই।
চারজন মানে কি?
আমি, স্যারের ড্রাইভার, স্যারের বাবুর্চি, পার্ট টাইম ক্লিনার।
সাত্তার সাহেব চোখ কপালে তোলার চেষ্টা করতে করতে বললেন, টাকা পয়সারতো দেখি হরির লুট হচ্ছে। সব বন্ধ। এখন থেকে পুরো কনট্রোল আমার হাতে। হিমু, তুই যা, কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা খেতে খেতে আমি বুঝিয়ে বলব, কেন পুরো কনট্রোল আমার হাতে। পল্টু, তুমিও বই পড়া বন্ধ করে আমার কথা শোন। তোমারও শোনা প্রয়োজন।
আমাদের সবার হাতে হলদিরামের একপিস করে শনপাপড়ি। সাত্তার সাহেবের হাতে চায়ের কাপ। পটু স্যারের হাতে একটা বই, নাম— বিষাক্ত গাছ থেকে সাবধান। লেখকের নাম প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য। বই পড়ায় বাধা পড়েছে বলে স্যার বিরক্ত। বিরক্তি প্ৰকাশ করতে পারছেন না বলে আরো বিরক্ত। কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টের মতো কম্পাউন্ড বিরক্তি।
সাত্তার সাহেব খাকাড়ি দিয়ে গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, এখন আমি একটা সংবাদ দেব। সংবাদটা তোমাদের জন্যে আনন্দেরও হতে পারে, আবার নিরানন্দেরও হতে পারে। সংবাদটা হচ্ছে— পল্টুর বিষয় সম্পত্তির বিষয়ে কোটি একটা অর্ডার জারি করেছে। আমাকে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়েছে। পাওয়ার অব এটর্নির ফটোকপি আমার কাছেই আছে। চাইলে দেখতে পার। কেউ দেখতে চাও? দেখতে চাইলে আওয়াজ দাও।
আমরা চারজনই একসঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ুলাম— দেখতে চাই না! পাওয়ার দেখাতে আনন্দ নেই, পাওয়ার না দেখাতেই আনন্দ।
সাত্তার সাহেব পল্টন্টু স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই দেখতে চাস?
পল্টু স্যার বললেন, কি দেখতে চাইব?
পাওয়ার অব এটর্নি?
মাখা এসব দেখতে চাইব কি জন্যে? জরুরি একটা বই পড়ছি।
ঠিক আছে, তুই বই পড়তে থাক। আমি চা-টা শেষ করে এদের সঙ্গে আলাপ করতে থাকি।
পল্টু স্যার গভীর মনযোগে পাঠ শুরু করলেন। আমি তার ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিলাম; তিনি পড়ছেন আতা গাছ। আতা গাছ যে বিষাক্ত আমার জানা ছিল না। জানা গেল, ফল ছাড়া এই গাছের সবই বিষাক্ত! একটি বিষাক্ত গাছ মিষ্টি ফল দিচ্ছে, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। মানুষের মধ্যেও কি এ রকম আছে? বিষাক্ত বাবা-মার অসাধারণ সন্তান।
সাত্তার সাহেব গলা খাকড়ি দিয়ে আমার দিকে চোখ ইশারা করলেন। আমি ছুটে গেলাম, তার হাত থেকে চায়ের খালি পেয়ালা নিয়ে গেলাম। তিনি আয়েসী ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের স্যার যে মানসিকভাবে পঙ্গু একজন মানুষ, আশা করি। ইতোমধ্যে তোমরা বুঝেছি। হিমু, বল তুমি বুঝেছ?
ইয়েস স্যার।
ডাক্তাররা তার বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়েছেন যে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। ডাক্তারদের সার্টিফিকেট বিষয়ে তোমাদের কোনো কথা আছে?