পুনশ্চ ১ : পল্টু ভাইজান না-কি ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল খেতে চেয়েছেন। রেঁধে পাঠালাম। উনার কেমন লাগল জানাবি। ঝাল মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে। এখনকার বাজারে সবই মিষ্টি টাইপ কাচামরিচ। এটা যে এত ঝাল, আগে বুঝতে পারি নি।
পুনশ্চ ২ : কি লিখতে চেয়েছিলাম ভুলে গেছি। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। পল্টু ভাইজানের শোবার ঘরে আমার ছবিটা কি এখনো ঝুলছে? এই ছবি যে আমার কিশোরী বয়সের, তা রানুকে বলবি না। সে যদি নিজে থেকে বুঝে ফেলে তাহলে ভিন্ন কথা।
পল্টু স্যারের খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি রানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জব পার্মানেন্ট। মাঝে মধ্যে মনে হয় ভাল-মন্দ খাবার জন্যে বেঁচে থাকি। নবরত্ন সভার আবুল ফজলের নাম শুনেছ?
রানু বলল, না।
তিনি মোঘল সম্রাট আকবর দ্যা গ্রেটের নয়। রত্বের এক রত্ন। তিনি আকবরের একটা জীবনী লিখেছেন, নাম আইন-ই-আকবরী। সেখানে সমাট আকবর কি কি খেতেন। সেই সব লেখা আছে। মরে যাবার আগে তার পছন্দের একটা খাবার খেতে ইচ্ছা করছে। রেসিপিও উনি লিখে গেছেন। রেসিপি বললে রাঁধতে পারবে?
রেসিপি কি?
পল্টু স্যার আগ্রহের সঙ্গে বললেন, খাবারটার নাম দুনিয়াজা। দশ সের মাংসের সঙ্গে দশ সেরা পিয়াজের রস মিশাতে হবে। এক পোয়া লবণ দিতে হবে। কিছু গোলমরিচের গুড়া। তারপর অল্প আঁচে জ্বাল হতে থাকবে।
আর কিছু না?
আর কিছুতো লেখা ছিল না।
রানু বলল, চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে খেতে পারবেন বলে মনে হয় না। তেল ঘি ছাড়া কেমন হবে খাবারটা?
পল্টু স্যার বললেন, পিঁয়াদের রসে রান্নাই এই খাবারের বিশেষত্ব। হিমু বাবুর্চির কাছ থেকে জেনে নাও কি কি লাগবে। আজ রাতে আমি আকবর বাদশা। দুনিয়াজা খাব।
রানু বলল, আমাকে বাবুর্চি ডাকবেন না। আমার নাম রানু। আমাকে রানু ডাকবেন। আমাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিন যেখানে আমি রাতে থাকব। হোস্টেল থেকে আমার কিছু জিনিসপত্র আনতে হবে।
বাদল বলল, আমি আপনার সঙ্গে যাব। সব নিয়ে আসব।
ঘটনা দ্রুত ঘটছে। কোন দিকে যাচ্ছে কে জানে।
সন্ধ্যা সাতটা। রান্নাঘরে দুনিয়াজা রান্না হচ্ছে। সাহায্যকারী পরামর্শদাতা হচ্ছে বাদল। তার উৎসাহ তুঙ্গস্পর্শী। মনে হচ্ছে রানু বাবুর্চির এসিসটেন্ট হয়ে সে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। একটু পরপর রানুর হাসির শব্দও আসছে। বাদলের হাসির আওয়াজ পাচ্ছি না। দুজন মানুষের মধ্যে একজন যখন হাসে তখন অন্যজনকেও হাসতে হয়। বাদল হাসছে না কেন বুঝতে পারছি না। দুজনের কথাবার্তাও ইতোমধ্যেই রহস্যজনক হয়ে আসছে।
রানু : রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ধোঁয়ায় আপনার কষ্ট হচ্ছে।
বাদল : তোমারও তো কষ্ট হচ্ছে। তুমিতো ধোঁয়া প্রুফ না।
রানু : মেয়েদের আবার ধোঁয়ার কষ্ট!
বাদল : তোমরা মেয়েদের এত ছোট করে দেখ কেন?
রানু : আপনারাই আমাদের ছোট করে রাখেন।
বাদল : খুবই ভুল কথা বলছ রানী।
রানু : রানী বলছেন কেন? আমার নাম রানু।
বাদল : সারি, ভুলে রানী বলে ফেলেছি। স্লিপ অব টাং।
রানু : সবার সামনে এ রকম স্লীপ অব টাং যেন না হয়। অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে।
বাদল : অন্য কি ভাববে?
রানু : ইস্। আপনি বোকা না-কি? কেন বুঝতে পারছেন না?
বাদল : রানী, আসলেই বুঝতে পারছি না।
রানু : আবার রানী! শুনুন, প্রেমিকরাই শুধু তাদের প্রেমিকদের রানী বলে ডাকে কিংবা জানপাখি ডাকে। খুবই হাস্যকর।
বাদল : হাস্যকর কেন হবে?
রানু : আমার কাছে হাস্যকর।
আমি মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমুবার আয়োজন করছি— বাদল হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। হাতে মোবাইল টেলিফোন।
হিমুদা! বাবার সঙ্গে একটু কথা বলতো! বাবা কিছু না বুঝেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তুমি পুরো বিষয়টা সুন্দর করে গুছিয়ে বল।
আমি গম্ভীর গলা বের করলাম, হ্যালো।
খালু সাহেব ধমকে উঠলেন, হিমু না।
জ্বি।
এ রকম করে কথা বলছ কেন? সমস্যা কি?
কোনো সমস্যা নেই।
বাদলের ব্যাপারটা কি আমাকে বল। কিছুই লুকাবে না। সে করছে কি?
এই মুহুর্তে সে সন্দেহজনক চরিত্রের এক বাবুর্চি মহিলার এসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করছে পিঁয়াজ কেটে দিচ্ছে এবং নিচু গলায় গল্পগুজব করছে।
What?
সত্যি কথা জানতে চাচ্ছেন, সত্যি কথা বললাম। তবে বাবুর্চিটার চেহারা ভাল; চরিত্র সন্দেহজনক হলেও চেহারা খারাপ না।
সন্দেহজনক চরিত্র মানে কি?
সন্ধ্যার পর চিন্দ্ৰিমা উদ্যানে কাস্টমারের খোঁজে ঘুরে বলে জনশ্রুতি আছে।
ধাদল ওর সঙ্গে জুটল। কিভাবে?
বলতে চাচ্ছি না, খালু সাহেব।
কোন বলতে চোচ্ছ না?
হয়ত ব্যাপারটা আপনি সহজভাবে নিতে পারবেন না।
হিমু বেড়ে কাশ! ঝেড়ে কাশ বললাম। I order you to caugh.
বাদল যে বাসায় পার্ট টাইম চাকরের কাজ নিয়েছে সন্দেহজনক চরিত্রের ঐ মেয়েও সেই বাড়িতেই কাজ করে।
কি বললে? বাদল পার্ট টাইম চাকরের কাজ নিয়েছে?
জ্বি। মহানন্দে ঘর ঝাট দিচ্ছে। মেঝে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুচছে। আমার ধারণা ছাত্র পড়ানোর মনোটনি কাটানোর জন্যে সে এই কাজ করছে।
খালু সাহেব টেলিফোনে সিংহনাদ করলেন, বাদলকে টেলিফোনটা দাও! আমি সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলব।
আমি বিনীত গলায় বললাম, বাদলকে টেলিফোন দিতে হলে আমাকে রান্নাঘরে যেতে হয়। কাজটা করতে চাচ্ছি না। তাদের কি অবস্থায় দেখব কে জানে; বললাম না মেয়েটার চরিত্র সন্দেহজনক।
বাদল কোন বাসায় আছে সেই ঠিকানা দাও— আমি আসছি।