স্যারের ড্রাইভার এসে দরজা দিয়ে মুখ বের করে চোখ টিপল। চোখ টিপায় এর সীমাহীন পারদর্শিতা। চোখ টিপ দিয়ে বুঝিয়ে দিল— বিরাট সমস্যা।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, কি সমস্যা?
ড্রাইভার হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, কিসলু ভাই আসছে। একা আসে নাই, দলেবলে আসছে।
কিসলু ভাইট কে?
সোহাগ ভাইজানের গ্রুপের লিডার। ডেনজার আদমি। আপনারে খবর দিতে বলেছে, খবর দিলাম। এখন আপনে কি করবেন, সেটা আপনার বিবেচনা।
আমাকে কি করতে বল?
পালায়া যান। জানে বাচেন।
জনে মেরে ফেলার সম্ভাবনা কি আছে?
অবশ্যই। বললাম না, ডেনজার আদমি।
পালাবো কোন দিক দিয়ে? এরচে বরং ডেনজার আদমির সঙ্গে কথা বলতে থাকি। সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে ঝেড়ে দৌড়। এক দৌড়ে পাগার পার।
ড্রাইভার শুকনো মুখে বলল, আমার যা বলার বলে দিয়েছি। আরেকবার বলতেছি— ডেনজার আদমি।
ডেনজার আদমি কিসলু ভাই, ড্রাইভারের ঘরের সামনের চেয়ারে বসে আছে। সে জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে কমলা রঙের গেঞ্জি পয়েছে। গেঞ্জিতে লেখা— Love Bangladesh. বঙ্গ প্রেমিকের চেহারায় ইঁদুর ভাব আছে। সব মানুষ যে বাঁদর থেকে এসেছে তা-না। কিছু মনে হয় ইঁদুর থেকেও এসেছে। আমি ডেনজার আদমির কাছে এগিয়ে গেলাম। ড্রাইভার অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে। ডেনজার আদমির লোকজন কাউকে দেখছি না। তবে তারা আশেপাশেই যে আছে তা ডেনজার আদমির প্রশান্ত মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি। এই ধরনের বিপজ্জনক লোক একা যখন থাকে তখন অসহায় বোধ করে। আমি ডেনজার স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, এই তুই চাস কিরে শুওরের বাচ্চা?
ড্রাইভারের মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেট পরে গেল। সে মাথা ঘুরিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। মনে হচ্ছে তার পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেছে। আমি বললাম, এখনো চেয়ারে বসে আছিস! উঠে দাঁড়া তেলাপোকার ছানা! (তেলাপোকার ছানা গালিটা বের করে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে আরো কিছু নতুন গালি আবিষ্কার করে ফেলব।)
এই তেলাপোকা! তোর নাম কি?
আমার কাছে এসেছিস কি জন্যে? তোকে কি সোহাগ পাঠিয়েছে? ঐ মাকড়সাটা এখন কোথায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে?
হুঁ।
হুঁ কিরে হারামজাদা! বল জ্বি স্যার। তোকে আজ মহব্বত শিখায়ে দিব। সোহাগের রাজস্থানী চাকুটা প্যান্টের ভিতর আপনা-আপনি খুলে গেছে। ঠিক বলেছি না?
জ্বি স্যার।
তোর প্যান্টের পকেটেওতো পিস্তল আছে। আছে কি-না বল?
জ্বি স্যার।
গুলি নাই, পিস্তল নিয়ে ঘুরছিস কোন মতলবে? পিস্তলের গুলি কই?
ডেনজার আদমি বিড়বিড় করে বলল, যে গুলি আছে সেটা এই পিস্তলে ফিটিং হয় না।
পিস্তল আর গুলি দেখেশুনে কিনবি না? আমার কাছে কি জন্যে এসেছিস ঝটপট বল।
ভুল হয়েছে। আপনাকে চিনতে পারি নাই।
এখন চিনেছিস?
ডেনজার আদমি কিসলু হতাশ চোখে এদিক-ওদিক তাকালো। সে এমনই হতভম্ব হয়েছে যে, মাথা এলোমেলোর পর্যায়ে চলে গেছে। ডেনজার আদমি জাতীয় ছেলেপুলেরা অসম্ভব ভীতু হয়।
ওস্তাদ, বিদায় দেন, চলে যাই।
কানে ধর। কানে ধরে লেফট রাইট করতে করতে যা। তোর বন্ধুরা সবাই যেন দেখে তুই কানে ধরে আছিস। আর শোন, পিস্তলের জন্যে ফিটিং গুলি যেদিন পাবি সেদিন এসে আমার সঙ্গে দেখা করবি। মনে থাকবে?
জ্বি ওস্তাদ। এখনো কানে ধরছিস না কেন? কানে ধর!
ডেনজার আদমি কানো ধরল। ড্রাইভারের মুখের হা এতই বড় হয়েছে যে, মুখের ভেতর দিয়ে খাদ্য নালীর খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
হাঁটা শুরু করা। এক কদম যাবি, কিছুক্ষণ থামবি। আবার এক কদম যাবি, কিছুক্ষণ থামবি। মনে থাকবে?
মনে থাকবে, ওস্তাদ।
ডেনজার আদমি চলে যাচ্ছে। ড্রাইভার ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঢোক গিলছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হুমকি ধামকি করে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি— তাই না ফজলু?
ফজলু বিড়বিড় করে বলল, জ্বি ওস্তাদ।
মানুষের সবদিন সমান যায় না। কোনো কোনো দিনকে বলা যায় ভেজিটেবল ডে। তাও উল্লেখযোগ্য ভেজিটেবলও না। কদু টাইপ ভেজিটেবল। আবার কিছু দিন থাকে–সংবাদপত্রের ভাষায় ঘটনাবহুল।
যেমন আজকের দিন। ডেনজার আদমি কিসলু ভাইকে বিদায় করে উপরে এসেছি। পল্টু স্যার হাতের উপন্যাস ছুড়ে ফেলে বললেন, অসাধারণ উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। টানটান উত্তেজনা। দুপুরের খাবার দাও। দেখি নতুন বাবুর্চি ইলিশ মাছের ডিম কেমন রান্না করেছে। আমার মন বলছে, ভাল হয়েছে।
বাবুর্চি নেই, ডিমও নেই— এই দুঃসংবাদ দেয়ার আগেই দরজার কলিংবেল বাজল। ঘরে ঢুকল রানু। হাতে টিফিন কেরিয়ারের একটা বাটি।
আমি বললাম, কি এনেছ, ডিমের ঝোল?
রানু কিছু বলল না। হ্যাঁ, সূচক মাথা নাড়ল। তার চোখে-মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। আমি বললাম, স্যারকে খাবার দাও। স্যারের ক্ষিধে লেগেছে!
রানু বলল, আপনার মাজেদা খালা আপনাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।
আমি বললাম, চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে তুমি কাজে লেগে পর। বাদল তোমাকে সাহায্য করবে। তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দিতে হবে। বাসাবাড়ির কাজ প্রথম করছে তো! এম্নিতে সে ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ায়।
বাদল মেঝে ঝাঁট দিচ্ছিল। রানু তার দিকে তাকিয়ে রইল। রানুর ভাবভঙ্গি অধিক শোকে কংক্রিট টাইপ।
মাজেদা খালা দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন। শুরু করেছেন একটি নিরীহ প্ৰাণীকে দিয়ে–
এই গাধা,
তুই কি শুরু করেছিস; রানুকে কি বুঝিয়েছিস। মেয়েটা আমার কাছে এসে কেঁদে-টেদে অস্থির। সব সময় রহস্য করা যায় না। মানুষকে স্বাভাবিক আচরণ করতে হয়। বয়সতো কম হয় নি। এখন স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে দেখ।
আমি কয়েকদিন কথা বলে দেখেছি রানু মেয়েটা ভাল। ভাল মেয়েদের কপালে দুঃখ থাকে। এই মেয়ের কপালেও নানান দুঃখ। বেচারি এত কষ্ট করে ঢাকায় আছে। গ্রামে তার মা একা। সেই মায়ের কাছে চিঠি গেছে যে, রানু ঢাকায় বেশ্যাগিরি করে জীবন যাপন করে। সন্ধ্যার পর থেকে তাকে না-কি চন্দ্ৰিমা উদ্যানে পাওয়া যায়।
রানু যে হোস্টেলে থাকে সেখানকার কোনো মেয়েই কাজটা করেছে। হোস্টেল থেকেও রানুকে নোটিশ দিয়েছে যেন হোস্টেল ছেড়ে যায়। সে এখন যাবে কোথায়? তার থাকার জায়গা দরকার। টাকা-পয়সা দরকার। রানুর কাছে শুনলাম তুই বাগড়া দিচ্ছিস যেন পল্টু ভাইজান কিডনী না কেনেন। এটা কেমন কথা?
মেয়েটাকে আমি আবার পাঠালাম। তোর দায়িত্ব আজকালের মধ্যে কিডনীর বিষয় ফাইনাল করে আমাকে জানানো। ভাল কোনো ছেলে পাওয়া গেলে আমি নিজ খরচায় মেয়েটার বিয়ে দিতে চাই। তোর সন্ধানে কেউ কি আছে?
আচ্ছা শোন! তোর পাতানো খালার ছেলে বাদলা ঐ ছেলেতো এখনো বিয়ে করে নি। ওর সঙ্গে ব্যবস্থা করা যায় না?
ইতি
তোর মাজেদা খালা