রানু বলল, আপনার প্রতিটি কথাই অসহ্য লাগছে। আমি কি আরেক বার উনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
আমি বললাম, কি কথা বলবে?
উনাকে জিজ্ঞেস করে জানব আপনি যা বলছেন সেটা সত্যি কি-না।
কিভাবে জানবে? সরাসরি জিজ্ঞেস করবে? আমাকে ফাসাবে?
আপনার ভয় নেই, সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করব না। আমি বোকা মেয়ে না।
রানুকে আবার পল্টু স্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। পল্টু স্যার বই থেকে মুখ তুলে আনন্দিত গলায় বললেন, তোমার বেতন কত ঠিক হয়েছে?
রানু বলল, স্যার, আমিতো আগেই বলেছি, আমি বাবুর্চির কাজ করব না। আমি শুধু আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি।
পল্টু স্যার বললেন, প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। দেখছি না বই পড়ছি?
স্যার ছোট্ট প্রশ্ন, হিমু নামের এই মানুষটা কি আপনাকে কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করতে নিষেধ করছে?
হ্যাঁ করেছে। এবং তার কথা আমার কাছে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে; কেন আমি অন্য একজনের শরীরের অংশ নিয়ে বেঁচে থাকব? যার কিডনী নিলাম, তার থাকবে একটা মাত্র কিডনী। সেটা নষ্ট হয়ে গেলে বেচারার গতি কি হবে?
রানু বলল, স্যার, আমি যাই। স্লামালিকুম। একটাই অনুরোধ, আপনার কাজের লোকের কথায় আপনি বিভ্ৰান্ত হবেন না। আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে।
প্লটু স্যার বললেন, কেন? আমিতো সোসাইটিতে কোনো কিছু Contribute করতে পারছি না। শুধু বই পড়ছি। আমার বেঁচে থাকা মানে দরিদ্র দেশের কিছু খাবার নষ্ট করা। বাতাস থেকে কিছু অক্সিজেন নিয়ে গ্রিন হাউস এফেক্টকে আগিয়ে নেয়া।
এসব যুক্তি কি আপনার ঐ লোক আপনাকে বুঝিয়েছে?
হ্যাঁ। তার যুক্তি খুবই ভাল। এখন তুমি যাও— বই পড়ছিতো! বই পড়ার সময় ফালতু কথাবার্তা খুবই অসহ্য লাগে।
রানু বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যে দৃষ্টি সে আমাকে দিল ইংরেজিতে তাকে বলে Ash Look, বাংলায় ভস্ম দৃষ্টি। মুনী-ঋষিদের টাইমে তারা এই দৃষ্টি দিয়ে দুষ্ট লোক ভস্ম বানিয়ে ফেলতেন। সেই ভস্ম গায়ে মেখে সাধনায় বসতেন। ভস্ম নষ্ট হতো না। কাজে লাগতো।
রানু যাবার ঘণ্টা খানিকের মধ্যে বাদল এসে উপস্থিত। দরজা খুলতেই সে ঢুকল। কিছুক্ষণ পল্টু স্যারকে জ্বলজ্বল চোখে দেখল, তারপর নিচু গলায় বলল, হিমুদা, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কারো একজনের চেহারার মিল পাচ্ছি। কে বলতো!
আমি বললাম, ফিসফিস করে কথা বলতে হবে না। উনি যখন পড়ায় ব্যস্ত থাকেন তখন বাড়ির ছাদে এটম বোমা ফাটলেও উনি ঠিক মতো শুনতে পান না। ভাবেন, বেলুন ফেটেছে। এই সিনড্রমের নাম পাঠ বধির সিনড্রম।
কার চেহারার সঙ্গে মিল সেটা বল।
দুজনের চেহারার সঙ্গে খুব মিল একজন হচ্ছে আরব্য রজনীর বুড়োটা। যে ঘাড়ে চেপে থাকে, ঘাড় থেকে নামে না।
ঠিক বলেছতো।
আবার উনি যখন বই পড়া বন্ধ করে মাথা তুলে তাকান তখন তাকে খানিকটা টেকো মাথা আইনষ্টাইনের মতো লাগে।
বাদল বলল, হিমুদা, দুদিন যদি তোমার সঙ্গে থাকি তাহলে কোনো সমস্যা আছে? ইউনিভার্সিটি বন্ধ। বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখাও হয় না। থাকব দুদিন?
থাক।
রাতে ঘুমাব কোথায়?
মেঝেতে ঘুমাবি। চাকর-বাকরের আত্মীয়-স্বজন এলে কোথায় ঘুমায়? মেঝেতে ঘুমায়। চাকরের আত্মীয় হিসেবে দুদিন থাক— ভাল লাগতে পারে।
বাদল চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, ভেরি ইন্টারেস্টিং আইডিয়া। ভদ্রলোক কি পড়ছেন?
এখন একটা উপন্যাস পড়ছেন। দেড়শ পৃষ্ঠার উপন্যাস। আমি সেই উপন্যাসের পাতা ব্লেড দিয়ে কেটে সত্তর পৃষ্ঠা করে দিয়েছি। একটা পাতার পরেই তারপরের পাতা মিসিং। দেখতে চাচ্ছি উনি ব্যাপারটা ধরতে পারেন কিনা।
ধরতে পারছেন?
না। উনি খুব আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটা পড়ছেন। প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, দস্তয়েভস্কির উপন্যাস থেকে উঠে আসা কারেক্টর। হিমুদা, আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও।
আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম। হাত কচলাতে কচলাতে বললাম, স্যার এর নাম বাদল, আমার খালাতো ভাই। দুদিন আমার সঙ্গে থাকবে, খাবে। তবে বিনিময়ে কাজ করে দেবে। ফ্লোর মুছবে। কাপড় ধুয়ে দিবে। লকারটা খোলার ব্যাপারেও কাজ করবে।। এর অংকের মাথা ভাল।
পল্টু স্যার বললেন, গুড! ভেরি গুড!
বাদল বলল, স্যার, যে বইটা পড়ছেন সেটা পড়তে কেমন লাগছে?
পল্টু স্যার বললেন, পড়তে খুবই ভাল লাগছে। তবে বইয়ের অনেকগুলো পাতা নেই। কেউ একজন ইভেন নাম্বার দিয়ে শুরু প্রতিটি পাতা কেটে রেখেছে। তাতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না, বরং সুবিধা হচ্ছে।
বাদল আগ্রহ নিয়ে বলল, কি সুবিধা, স্যার?
মিসিং পাতাগুলোতে কি আছে কল্পনা করে খুবই আনন্দ পাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি, এরপর যে বই-ই পড়বা তার odd কিংবা even নাম্বারের পাতাগুলো কেটে রাখব।
বাদল বলল, স্যার, আপনিতো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। দয়া করে একটা বাণী দিন।
কি বাণী দেব?
বাদল বলল, আপনার মতো মানুষ যা বলবেন সেটাই বাণী। একটা গালি যদি দেন, সেটাও হবে বাণী। দয়া করে আমাকে একটা গালি দিন।
সত্যি গালি দেব?
জ্বি স্যার।
এই মুহুর্তে তেমন কোনো গালি মনে পড়ছে না। একটু পরে দেই?
জ্বি আচ্ছা স্যার।
বাদল আগ্রহ নিয়ে গালির জন্যে অপেক্ষা করছে। পল্টু স্যারকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। সম্ভবত লাগসই গালি পাচ্ছেন না। না পাওয়ারই কথা। বাংলা ভাষায় গালির সম্ভার তত উন্নত না। বেশির ভাগ গালিই পশুর সঙ্গে সম্পর্কিত— কুকুরের বাচ্চা, শুওরের বাচ্চা, গাধার বাচ্চা… নতুন ধরনের গালি কিছু হয়েছে, যেমন–তুই রাজাকার। আরো গালি থাকা দরকার। একটা জাতির সংস্কৃতির অনেক পরিচয়ের একটি হচ্ছে গালির সম্ভার। চীন দেশে গালির অভিধান পর্যন্ত আছে। আহারে কী সভ্যতা!