বিট লবণ দিয়ে যে মাছের ঝোল রান্না করা যায় এটাই আমি জানি না।
কোন রান্নাটা তুমি ভাল পোর।
ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল।
পল্টু স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু, চট করে একটা ইলিশ মাছ নিয়ে এসো। আমারো হঠাৎ করে কেন জানি ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে। বাবুর্চির চাকরি পার্মানেন্ট হবে কি-না তা ইলিশ মাছের ডিম রান্নার উপর নির্ভর করবে।
রানুর হতভম্ব ভাব ক্রমেই বাড়ছে। এক সময় সে গা বাড়া দিয়ে উঠল। কঠিন গলায় বলল, একটা ভুল হচ্ছে। আমি বাবুর্চির কাজের জন্যে এ বাড়িতে আসি নি। আমাকে এসব কেন বলছেন? আমাকে দেখে কি বাবুর্চির মতো লাগছে?
পল্টু স্যার আমার দিকে সাহায্যের জন্যে তাকালেন। রানুর কথায় তিনিও খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। আমি বললাম, রানু শোন, আয়া বা বাবুর্চি এরা দেখতে আলাদা হয় না। এদের কোনো আলাদা পোশাকও নেই। এবং সত্যি কথা বলতে কি তোমার ভাবভঙ্গির মধ্যে কিছু বাবুর্চি ভাব অবশ্যই আছে।
পল্টু স্যার ভরসা পেয়ে বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। খুবই সত্যি কথা। কথাবার্তা বুয়া টাইপ। ঝগড়া ঝগড়া ভাব।
তোমার যদি সম্মান হানি হয়ে থাকে, তাহলে আমি এবং স্যার আমরা দুজনই দুঃখিত।
পল্টু স্যার বললেন, হ্যাঁ দুঃখিত। তবে বাবুর্চির কাজের মধ্যে কোনো অসম্মান নেই। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বাবুর্চি ছিলেন যেমন এরিস্টটল, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি।
রানু বলল, উনারা বাবুর্চি ছিলেন?
পল্টু স্যার বললেন, অবশ্যই। নিজেরা নিজেদের খাবার রান্না করে খেতেন। এখন তুমি বল, বেতন কত চাও?
রানু বলল, বেতন কত চাই মানে কি?
তুমি নিশ্চয়ই বেতন ছাড়া কাজ করবে না। আর আমার পক্ষেও আকাশ-পাতাল বেতন দিয়ে বাবুর্চি রাখা সম্ভব না। লকার খোলা যাচ্ছে না।
রানু বলল, আমরা একই কথাবার্তায় ঘুরাফিরি করছি। হয় আপনি কনফিউজড নয়ত আমি কনফিউজড। আমি এখন চলে যাচ্ছি, কিছু মনে করবেন না। স্নামালিকুম।
পল্টু স্যার সালামের জবাব না দিয়ে বইয়ে মন দিলেন। পাতা উল্টে বইয়ের দিকে ঝুঁকে এলেন। তার চোখ চকচক করতে লাগল। রানু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে আলাদা এক মিনিট কথা বলতে পারি? আড়ালে?
আমি বললাম, আড়ালে যাবার দরকার নেই। এখানেই কথা বলতে পার। স্যার বই পড়া শুরু করেছেন, এখন কোনো কিছুই তাঁর মাথায় ঢুকবে না। তাঁকে এই ছাগল, বই পাগলা বলে গালিও দিতে পার। তিনি কিছুই বুঝবেন না।
রানু কঠিন গলায় বলল, আপনি দয়া করে অন্য ঘরে আসুন! প্লিজ!
আমি রানুকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। এই বাড়িতে শুধুমাত্র রান্নাঘরেই দুটা প্লাষ্টিকের টুল আছে। পিঁড়ির আধুনিক সংস্করণ। রানুকে বসতে বললাম, সে বসল না। থমথমে গলায় বলল, আপনি কি সত্যিই উনার সারভেন্ট? চাকর বলতে লজ্জা লাগছে বলে সারভেন্ট বলছি।
আমি বললাম, সরাসরি চাকর বলতে পার। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভৃত্যকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত লাইন আছে— আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার। মালাকার ব্যাটা চাকর ছাড়া কিছু না। হাই লেভেলের কথা বন্ধ করে সরল করে বলুন ঘটনা কি? আপনি চাকর হবেন কেন?
আমি একটা জরুরি মিশন নিয়ে এখানে কাজ করছি।
কি মিশন?
পল্টু স্যার বহু টাকার মালিক। বিশ কোটি টাকার বেশিতো বটেই। উনি মারা গেলেই সোহাগ নামের একজন পুরো সম্পত্তির মালিক হবে। আমার মিশন হচ্ছে উনি যাতে দ্রুত মারা যান, সেই ব্যবস্থা করা।
তার মানে?
ভদ্রলোকের সময় ঘনিয়েছে। দুটা কিডনীই নষ্ট। আমাকে দেখতে হবে তিনি যেন কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্টে রাজি না হন। বুঝতে পারছ?
না।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, আমি এ বাড়িতে ঢুকেছি তাঁকে কিডনী দেব এই অজুহাতে। এখন তার ধারে-কাছে যাচ্ছি না। স্যারের শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। পরিকল্পনা মতো সব এগুচ্ছে।
রানু বলল, আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাকে এই গোপন কথাগুলো কেন বলছেন?
তোমাকে বলছি, কারণ তুমিও এই পরিকল্পনার অংশ।
রানু প্রায় চিৎকার করে বলল, আমি কি করে এই পরিকল্পনার অংশ হব?
মাজেদা খালা তোমাকে কিডনী দেবার জন্যে ফিট করেছে। ঠিক বলছি না?
রানু হতভম্ব গলায় বলল, সেই কিডনী কি উনার জন্যে?
অবশ্যই। তোমাকে কি করতে হবে শোন— বুড়োটাকে নানান কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে কিডনী ট্রান্সপ্লান্টটা দেরি করাবে। যেন দ্রুত কর্ম কাবার হয়ে যায়। সোহাগ ভাইজান বগল বাজাতে পারেন।
রানু বলল, আপনি অতি ভয়ংকর মানুষ। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম। আমার উচিত সব কিছু পুলিশে জানানো।
ভুলেও এই কাজ করবে না। পুলিশও আমাদের কেনা। সবচে সহজ পণ্য হল মানুষ। মানুষ কেনা কোনো সমস্যাই না। মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে সহজে কেনা যায় বুদ্ধিজীবীদের। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। কখন বিক্রি হবেন।
বকবকনিটা বন্ধ করবেন?
করলাম।
আমি এখন চলে যাব। তবে ভাববেন না। আমি সহজ মেয়ে। একটা মানুষকে খুন্ন করবেন। আর আমি সব জেনেশুনেও চুপ করে থাকব?
খুনতো করছি না। নেচারের উপর নির্ভর করছি। নেচার তার কোর্সে চলবে। যথা সময়ে পল্টু স্যার বই পড়তে পড়তে পটল তুলবেন। উনার জন্যেও ভাল। বই পড়তে পড়তে খুব কম মানুষই মারা যায়। শুধু একজনকে পাওয়া গেছে যিনি বই পড়া শেষ করে লাইব্রেরি থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা পিছলে মারা গেছেন। মোঘল বাদশা হুমায়ুন।