সে আমার সঙ্গে আন্ডারাষ্ট্যান্ডিং-এ যেতে চাচ্ছে। কাজের লোক, বুয়া, মালী, ড্রাইভার, দারোয়ান এদের রসুনের বোঁটা হয়ে থাকাই নিয়ম। একজনের অপরাধ সবার অপরাধ।
ড্রাইভার বলল, পাঁচ হাজার টাকা দেন স্যার, নতুন ব্যাটারি নিয়ে আসি। তবে আজ গাড়ি বের করতে পারবেন না।
পল্টু স্যার ড্রাইভারকে ব্যাটারির টাকা দিয়ে আমাকে নিয়ে বই কিনতে বের হলেন। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি–যথাসময়ে এবং যথা জায়গায় একজন টাকা ভর্তি মানিব্যাগ নিয়ে ছুটে এল এবং চোঁচাতে লাগলো মুরুব্বী, এই মানিব্যাগ কি আপনার? পল্ট স্যার বললেন, কে সোহাগ না? কেমন আছ?
যুবক চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে বলল, ভাল আছি পল্টু ভাইজান।
পল্টু স্যার বলল, এই মানিব্যাগ আমার না। আমারটা পকেটেই আছে। মনে হয় অন্য কারোর।
আমি বললাম, ভাই, মানিব্যাগটা আমার। পকেট থেকে পড়ে গেছে খেয়াল করি নাই।
সোহাগের বন্ধুরা এগিয়ে আসছিল। সোহাগের ইশারায় তারা পিছনে সরে গেল।
সোহাগ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার যে মানিব্যাগ তার প্রমাণ কি? এখানে কত টাকা আছে বলতে পারবেন?
আমি বললাম, এখানে আছে উনিশশ দশ টাকা। ভাই, আপনি গুনে দেখেন।
পল্টু স্যার বললেন, দেখি, আমি গুনে দেই। টাকা গুনতে আমার ভাল লাগে। বইয়ের পাতা উল্টাতে যেমন ভাল লাগে, টাকা গুনতেও ভাল লাগে। টাকা গুনার সময় মনে হয় বই-এর পাতা উল্টাচ্ছি।
টাকা গুনে দেখা গেল উনিশ শ দশ টাকাই আছে। কাকতালীয় ব্যাপার ছাড়া কিছুই না। সবার জীবনেই কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে। আমার বেলায় একটু বেশি বেশি ঘটে।
সোহাগকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে আমরা চলে এলাম। পল্টু স্যার বললেন, আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি এই ছেলের পাওয়ার কথা। আমার কোনো ওয়ারিশ নাই।
আমি বললাম, স্যার, আপনার কি অনেক টাকা-পয়সা?
পল্টু স্যার বললেন, হুঁ।
আমি বললাম, এত টাকা কিভাবে করেছেন?
পল্টু স্যার বললেন, আমি করব কিভাবে? আমার বাবা করেছেন। ব্যবসা করতেন। কিসের ব্যবসা কিছুই জানি না। তাঁর কথা ছিল যেদিন বিশ কোটি টাকার সম্পদ হবে সেদিন তিনি তওবা করে টাকা রোঙ্গার বন্ধ করবেন।
তওবা করার সুযোগ কি পেয়েছিলেন স্যার?
না। যেদিন তওবা করার কথা ছিল সেদিন সকাল বেলায় নাস্তা খাবার সময় মাংসের টুকরা গলায় আটকে গেল। আমি তখন তাঁর সামনে বসে নাস্তা খাচ্ছিলাম। আমি বুঝতেই পারি নাই বাবা মারা যাচ্ছেন। আমি ভাবছি বাবা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? তারপরেই— ধুম!
ধুম কি?
ধুম করে উনার মাথাটা টেবিলে পড়ে গেল। তুমি আবার ভেবো না মাথা খুলে টেবিলে পড়ে গেছে। উনাকে সহ-ই পড়েছে। মাথা টেবিলে লেগে ধুম শব্দ হয়েছে।
ও আচ্ছা।
পল্টু স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন– ধুম বলা ঠিক হয় নাই। বলা উচিত ধুম ঝনঝন। ধুম করে মাথাটা টেবিলে লাগল। টেবিলে পানির যে গ্লাস ছিল সেটা মেঝেতে পরে ভেঙে শব্দ হল ঝনঝন। কাজেই ধুম ঝনঝন।
আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। বাবার মৃত্যু যে কারো কাছে ধুম ঝনঝন হতে পারে তা আমার ধারণাতে নেই। একজন সর্ববিষয়ে নির্বিকার মানুষ এ ধরনের কথা বলতে পারে। উনি কি মহাপুরুষদের মতো চরম নিরাসক্তদের একজন। মহাপুরুষ সম্পর্কে আমার বাবার ধ্যান-ধারণা এ রকমই। মহাপুরুষদের নানান লক্ষণ বলতে গিয়ে তিনি বলছেন
আসক্তি
চরম আসক্তির অন্য নাম নিরাসক্তি। মহাপুরুষরা সৰ্ববিষয়ে যে নিরাসক্তি দেখাইয়া থাকেন তাহা চরম আসক্তিরই অন্য পরিচয়। তোমাকে উদাহরণ দিয়া বুঝাই–মনে কর এক লোকের মদ্যপানের কিছু নেশা আছে। সেই ব্যক্তি মাঝে মধ্যে কিছু মদ্যপান করিবে। তাহার জন্যে নানান আয়োজন করিবে। মদ্যপানের সময় চাটের ব্যবস্থা, সংগীত শ্রবণের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই লোকই যখন মদ্যপানে চরম আসক্তি দেখাইবে তখন সে শুড়িখানায় উপস্থিত হইবে— তখন তাহার চাটের প্রয়োজন নাই, সংগীতেরও প্রয়োজন নাই। মদ্য হইলেই হইল। এই আসক্তি আরো বাড়িলে মদ্য পানেরও প্রয়োজন ফুরাইবে। নেশার বস্তু থাকিবে কিন্তু নেশা থাকিবে না।
একগাদা বই কিনে বাসায় ফিরে দেখি ড্রাইভারের ঘরের সামনের বেঞ্চিতে সোহাগ বসে আছে। হাতে সিগারেট।
পল্টু স্যারকে দেখে সে সিগারেট লুকানোর চেষ্টা করল। স্যার তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। হাত ভর্তি বই নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন। এক্ষুণি তাকে বই পড়া শুরু করতে হবে। খেজুরে আলাপের সময় নেই।
ড্রাইভার চাপা গলায় ডাকল, হিমু ভাই, শুনে যান। আপনার সঙ্গে কথা আছে। সোহাগ ভাইজান কি জানি বলবে। আপনি উনারে চিনেনতো?
আমি বললাম, দেখা হয়েছে। ওস্তাদ মানুষ।
সোহাগ সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল, যে দেখা হয়েছে, সেই দেখা কোনো দেখাই না। তোমার সঙ্গে আসল দেখা বাকি আছে।
আমি বললাম, আসল দেখা কখন হবে? রোজ হাশরের ময়দানে?
রোজ হোশর আমি তোমারে দেখায়ে দিব। মানিব্যাগ আন।
মানিব্যাগতো জমা দিয়ে দিয়েছি।
কোথায় জমা দিয়েছ।
ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেবের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছি। উনি যেন আসল মালিককে ফিরত দেন।
আমাকে ধানমন্ডি থানা চিনাও? চল আমার সঙ্গে থানায়। ব্যাগ রিলিজ করে নিয়ে আস।
ড্রাইভার আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, মানিব্যাগ দিয়ে দেন হিমু ভাই। এই লোক কিন্তু ডেনজার।
আমি সোহাগের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইজান, আপনি না-কি ডেনজার?