স্লীপ ডিপ্রাইভেশন এক ধরনের ঘোর তৈরি করে। বাস্তব জগৎ বিড়ালের সীমকার্ড খাওয়ার জগৎ হয়ে যায়। রিয়েলিটির সংশয় তৈরি হয়। যেমন শেষ রাতে আমার কাছে মনে হল কেবিনে একটা অন্ধ বিড়াল ঢুকেছে। সে ছোটাছুটি করতে গিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে এবং মিউমিউ করছে। কয়েকবার ঘনঘন চোখের পলক ফেলার পর বিড়াল অদৃশ্য হয়ে গেল। তবে সমস্যার সমাধান হল না। তখন দেখলাম খাটে মাজেদা খালা শুয়ে আছেন। পল্টু স্যার না।
আমি বললাম, খালা, তুমি এখানে কেন?
খালা বললেন, তাতে তোর কোনো সমস্যা? আমি কি করব না করব তা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।
তুমিই তাহলে তোমার প্রভু?
হেঁয়ালি কথা বন্ধ করবি?
অন্ধ বিড়ালটা দেখেছ, খালা?
নাতো।
তোমার মোবাইলটা সাবধানে রাখ। বিড়াল অন্ধ হলেও দুষ্ট আছে। মোবাইল খুলে তোমার সিমকার্ড খেয়ে ফেলবে।
কি সর্বনাশ! আগে বলবি না! দুনিয়ার নাম্বার আমার এই সিমকার্ডে। এটা খেয়ে ফেললে আমার গতি কি হবে?
স্লীপ ডিপ্রাইভেশনে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম। বাটি ভর্তি গরম দুধ নিয়ে বসেছেন। পাউরুটি দুধে চুবিয়ে চুবিয়ে খাচ্ছেন।
আমি বললাম, কি খাচ্ছ বাবা?
বাবা বললেন, পাউরুটি খাচ্ছি। শরীরটা গেছে। সহজপাচ্য খাবার ছাড়া কিছু খেতে পারি না। অম্বল হয়।
চোখ এ রকম পিটপিট করছ, কেন? চোখে কি কোনো সমস্যা?
চোখে দেখি না।
কবে থেকে দেখি না?
দিন তারিখ ডায়েরিতে নোট করে রাখি নাই।
খুব সমস্যা হচ্ছে?
না, খুব আরাম হচ্ছে। গাধা ছেলে!
পরকালে মানুষ অন্ধ হয় এটা জানতাম না। আমার ধারণা ছিল পরকালে সবার চির যৌবন এবং…
চুপ কর। কট কট করে কথা বলবি না। শান্তিমতো নাস্তা খেতে দে। খাটের উপর শুয়ে আছে। এই বুড়া কে?
তুমিতো চোখে দেখ না। বুঝলে কি করে খাটে এক বুড়ো শুয়ে আছে?
অনুমানে বুঝেছি। এই বুড়োর সমস্যা কি?
উনার সমস্যা কিডনী। দুটা কিডনী। দুটাই অচল। আচ্ছা বাবা ভাল কথা এইসব ক্ষেত্রে মহাপুরুষদের ভূমিকা কি হবে? মহাপুরুষ কি তৎক্ষণাৎ নিজেরটা দিয়ে দেবেন?
না।
না কেন?
মহাপুরুষদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। ভাল খাওয়া-দাওয়া, শান্তির নিদ্রা তাদের প্রয়োজন।
বাবা, তুমিতো একেক সময় একেক কথা বল।
বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ঠিকই ধরেছিস। অন্ধ হবার পর থেকে কথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে। যাই হোক, তুই শাত্তিতে ঘুমে। তিনবার বল ঘুম শান্তি, ঘুম শান্তি, ঘুম শান্তি আরামের ঘুম হবে।
আমি তিনবার ঘুম শান্তি বললাম। সারাজীবন শুনেছি। ওম শান্তি এখন শুনছি, ঘুম শান্তি। সমস্যা নেই, আমার ঘুম দিয়ে কথা। লাশকাটা ঘরের শান্তিময় জীবনানন্দ স্টাইলের নিদ্ৰা।
আমার ঘুম ভাঙল এক বুড়োর কথাবার্তায়। পল্টু স্যারের সঙ্গে এই বুড়ো হষিতম্বির ভঙ্গিতে কথা বলছে। গলা মিষ্টি। বিশেষ ভঙ্গিতে কৰ্কশা করার চেষ্টা চলছে। কৰ্কশ হচ্ছে না। যে কথা বলছে সে সংগীতশিল্পী হলে নাম করত।
মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এ কে? তোমার সার্ভেন্ট?
কোয়ার টেকার। নাম হিমু।
যে সর্ভেন্ট তাকে সার্ভেন্ট বলধে। কেয়ার টেকার আবার কি?
সার্ভেন্ট শুনতে খারাপ লাগে।
খারাপ লাগার কিছু নাই! যে যা তাকে তাই বলতে হবে। নিয়ত এরা মাথায় উঠবে। এর নাম কি?
হিমালয়।
বা-বা নামের তো বিরাট বাহার। নয়টা বাজে, এখনো শুয়ে ঘুমাচ্ছে— এই শোন, এই।
আমি চোখ মেললাম। ঘুম আগেই ভেঙেছিল। এখন চোখ পিটপিট করছি। বুড়োকে দেখছি। সৌম্য চেহারা। দাড়ি আছে। পরেছেন নীল রঙের আছকন। হাতে বাহারী ছড়ি থাকার কারণে— নাটকের সমাট শাহজাহানের মত লাগছে।
ভদ্রলোক বললেন, তোকে রাখা হয়েছে রুগীর সেবা করার জন্য। আর তুই হা করে ঘুমাচ্ছিস।
আমি বললাম, সরি।
খবরদার, আর কোনোদিন সরি বলবি না। চাকর-বাকরের মুখে সরি থ্যাংকযু্য এইসব মানায় না। আর শোন, তোকে হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা। এসব ডাকতে পারব না। এখন থেকে তোর নাম আবদুল। বুঝেছিস?
বুঝেছি স্যার
আমি পল্টুর আপনি চাচা।
চাচা স্লামালিকুম।
আমাকে চাচা ডাকবি না। তোর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা নাই। আমাকে ডাকবি স্যার।
ইয়েস স্যায়।
চিৎকার করে ইয়েস স্যার বলবি না, তুই মিলিটারিতে ঢুকস নাই। বন্দপুলা।
চাকরদের স্টাইলে অর্থহীন হাসি দিলাম। বাড়ির দামি কোনো কাচের জিনিস ভাঙলে চাকর এবং বুয়ারা যে রকম হাসি দেয়। সেই হাসিতে লজ্জা থাকে, অপ্রস্তুত ভাব থাকে। কঠিন হাসি।
বৃদ্ধ বললেন, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। রোগীকে তার বাসায় নামিয়ে দিব। তুই হাসপাতালের অফিসে যা। রিলিজের বিষয়ে কি করতে হবে খোঁজ নে।
আমি ঘর থেকে বের হতে হতে শুনলাম পল্টু স্যার বললেন, চাচা, তুই তুই করে বলছেন কেন?
বুড়ো খেঁকিয়ে উঠে বলল, তুই করব নাতো কি আপনি আপনি করে কোলে বসাব? পাটু শোন, ছোট জাতকে ছোট জাতের মতো রাখতে হয়। আদর দিলে। লাফ দিয়ে মাথায় উঠে। মাথায় উঠেই ক্ষ্যান্ত হয় না। মাথায় হেগে দেয়?
মাথায় হেগে দিবে কেন?
তাদের স্বভাব হাগা। এই জন্যে হাগবে।
জটিল এই বৃদ্ধ সম্পর্কে পরের কয়েক দিন যা জানলাম তা হচ্ছে—
এই বৃদ্ধের নাম আবদুস সাত্তার। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। টিকাটুলিতে তার চেম্বারা। চেম্বারের নাম শেফা ক্লিনিক। নিচে লেখা ধনন্তরি হোমিও চিকিৎসক, এ সাত্তর MC. MR. PL (ডাবল স্বর্ণপদক প্রাপ্ত)।