আমি বললাম, মা, ঝাড়ফঁকে রোগ সারে?
বগার মা অতি চমৎকৃত হয়ে বললেন, কী কও বাবা! ঠিকমতো ঝাড়ুতে পারলে ক্যানসার সারে।
আপনি সারিয়েছেন?
অবশ্যই-ত্রিশ বচ্ছর ধইরা ঝাড়তেছি। ত্রিশ বচ্ছরে ক্যানসার ম্যানসার কত কিছু ভালো করেছি। একটা কচকা ঝাড়া দশটা পেনিসিলি ইনজেকশনের সমান। বাপধন, তোমারে যে ঝাড়া দিলাম। এই ঝাড়ায় দেখবা আইজ দিনে-দিনে সিধা হইয়া দাঁড়াইবা।
হাসপাতালে আমি অনেককিছুই শিখলাম। হাসপাতালের ব্যাপারটা সম্ভবত আমার বাবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। নয়তো তিনি অবশ্যই তাঁর পুত্রকে কিছুদিন হাসপাতালে রেখে দিতেন। এবং তাঁর বিখ্যাত উপদেশমালার সঙ্গে আরো একটি উপদেশ যুক্ত হত–
প্রতি দুই বৎসর অন্তর হাসপাতালে সাতদিন থাকিবার ব্যবস্থা করিবে। মানুষের জরাব্যাধি ও শোক তাহাদের পার্শ্বে থাকিয়া অনুধাবন করিবার চেষ্টা করবে। ব্যাধি কী, জীবজগৎকে ব্যাধি কেন বার বার আক্রমণ করে তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিবে। তবে মনে রাখিও, ব্যাধিকে ঘৃণা করিবে না। ব্যাধি জীবনেরই অংশ। জীবন আছে বলিয়াই ব্যাধি আছে।
কেমন আছেন হিমু সাহেব?
জি ম্যাডাম, ভালো আছি।
আপনার বুকে কনজেশন এখনো আছে। অ্যান্টিবায়োটিক যা দেওয়া হয়েছে–কনটিনিউ করবেন। সেরে যাবে।
থ্যাংক য়্যু ম্যাডাম।
আপনাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে, আপনি চলে যেতে পারেন।
থ্যাংক য়্যু ম্যাডাম।
প্রতিটি বাক্যে একবার করে ম্যাডাম বলছেন কেন? ম্যাডাম শব্দটা আমার পছন্দ না। আর বলবেন না।
জি আচ্ছা, বলব না।
আপনার হাতে কি সময় আছে? সময় থাকলে আমার চেম্বারে আসুন। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।
জি আচ্ছা।
আমি তরুণী-ডাক্তারের পেছনে পেছনে যাচ্ছি। তার নাম ফারজানা। সুন্দর মানুষকেও সবসময় সুন্দর লাগে না। কখনো খুব সুন্দর লাগে, কখনো মোটামুটি লাগে। এই তরুণীকে আমি যতবার দেখেছি ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। অ্যাপ্রন ফেলে দিয়ে ফারজানা যদি ঝলমলে একটা শাড়ি পর্যন্ত তা হলে কী হত? ঠোঁটে গাঢ় লিপষ্টিক, কপালে টিপ। হালকা নীল একটা শাড়ি-কনে ঝুলবে নীল পাথরের ছোট্ট দুল। এই মেয়ে কি বিয়েবাড়িতে সেজোগুজে যায় না? তখন চারদিকে অবস্থাটা কী হয়? বিয়ের কনে নিশ্চয়ই মন-খারাপ করে ভাবে—এই মেয়েটা কেন এসেছে। আজকের দিনে আমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখানের কথা। এই মেয়েট সেই জায়গা নিয়ে নিয়েছে। এটা সে পারে না।
হিমু সাহেব!
জি।
বসুন।
আমি বসলাম। আমার সামনে পিরিচে ঢাকা একটা চায়ের কোপ। ফারজানার সামনেও তাই। চা তৈরি করে সে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি তার ভেতরে সামান্য হলেও কৌতুহল জাগিয়ে তুলতে পেরেছি।
হিমু সাহেব!
জি।
আপনি কি সিগারেট খান?
কেউ দিলে খাই।
নিন, সিগারেট নিন। ডাক্তাররা সব রোগীকে প্রথম যে-উপদেশ দেয় তা হচ্ছেসিগারেট ছাডুন। সেখানে আমি আপনাকে সিগারেট দিচ্ছি।–কারণ কী বলুন তো?
বুঝতে পারছি না।
কারণ, আমি নিজে একটা সিগারেট খাব। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সিগারেট ধরেছিলাম। ছেলেরা সিগারেট খাবে, আমরা মেয়েরা কেন খাব না? এখন এমন অভ্যাস হয়েছে। এর থেকে বেরুতে পারছি না। চেষ্টাও অবিশ্যি করছি না।
ফারজানা সিগারেট ধরাল। আশ্চৰ্য-সিগারেটটাও তার ঠোঁটে মানিয়ে গেল! পাতলা ঠোঁটের কাছে জ্বলন্ত আগুন। বাহু, কী সুন্দর! সুন্দরী তরুণীদের ঘিরে যা থাকে সবই কি সুন্দর হয়ে যায়?
হিমু সাহেব!
জি।
এখন গল্প করুন। আপনার গল্প শুনি।
কী গল্প শুনতে চান?
আপনি অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছিলেন। ভয় পেয়ে অসুখ বাধিয়েছেন। সেই অস্বাভাবিক দৃশ্যটা কী আমি জানতে চাচ্ছি।
কোন জানতে চাচ্ছেন?
জানতে চাচ্ছি—কারণ এই পৃথিবীতে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটে না। পৃথিবী চলে তার স্বাভাবিক নিয়মে। মানুষ সেইসব নিয়ম একে একে জানতে শুরু করেছেএই সময় আপনি যদি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখতে শুরু করেন তা হলে তো সমস্যা!
মানুষ কি সবকিছু জেনে ফেলেছে?
ফারজানা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, সবকিছু না জানলেও অনেককিছুই জেনেছে। ইউনিভার্স কীভাবে সৃষ্টি হল তাও জেনে গেছে।
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসিমুখে বললাম, ইউনিভার্স কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে?
বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু। আদিতে ছিল প্রিমরডিয়েল অ্যাটম যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কিছুই নেই। সেই অ্যাটম বিগ ব্যাং-এ ভেঙে গেল—তৈরি হল স্পেস এবং টাইম। সেই স্পেস ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এক্সপানডিং ইউনিভার্সে।
সময়ের শুরু তা হলে বিগ ব্যাং থেকে?
হ্যাঁ।
বিগ ব্যাং-এর আগে সময় ছিল না?
না।
বিগ ব্যাং-এর আগে তা হলে কী ছিল?
সেটা মানুষ কখনো জানতে পারবে না। মানুষের সমস্ত বিদ্যা এবং জ্ঞানের শুরুও বিগ ব্যাং-এর পর থেকেই ।
তা হলে তো বলা যেতে পারে-জ্ঞানের একটা বড় অংশই মানুষের আড়ালে রেখে দেওয়া হয়েছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছেন?
না, সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আমি তর্ক করি না। তারা যা বলে তা-ই হাসিমুখে মেনে নিই।
সস্তা ধরনের কনভারসেশন আমার সঙ্গে দয়া করে করবেন না। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আমি তর্ক করি না এটা বহু পুরাতন ডায়ালগ। বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে। শুনলেই গা-জ্বালা করে। আপনি খুব অল্প কথায় আমাকে বলুন–কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন, তারপর রিলিজ অর্ডার নিয়ে বাসায় চলে যান।
আমি আপনাকে বলব না।
ফারজানার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। তার ঠোঁটের সিগারেট নিভে গিয়েছিল-সে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, কেন বলবেন না?