- বইয়ের নামঃ হিমুর আছে জল
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
হিমু, চোখ মেল
উৎসর্গ
একজন মানুষকে চেনা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ছবির আউটডোর শুটিং-এ। নিষাদের প্রিয় দাড়িওয়ালা মামাকে।
তারিক আনাম খাঁন।
ভূমিকা
হিমুর পায়ের নিচে সবসময় মাটি থাকে। সে হেঁটে বেড়ায় বিষণ্ণ ঢাকা নগরীর পথে পথে। আচ্ছা, তার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরিয়ে নিলে কেমন হয়? সে থাকুক। কিছু সময় পানির উপরে। দেখা যাক তার চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন আসে। কি না।
ও আচ্ছা! এবার তাকে তার কাছাকাছি চরিত্রের তরুণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটির নাম তৃষ্ণা। তৃষ্ণা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। সেখানে সম্পূর্ণ তৃষ্ণামুক্ত (?) হিমু কী বলবে।
হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া
ধানমণ্ডি
==============
০১.
কানের কাছে কেউ একজন বলছে, হিমু, চোখ মেল!
আমি চোখ মেলতে পারছি না। চোখের পাতা সীসার মতো ভারী। ভারী প্রসঙ্গে চোখের পাতাকে সীসার সঙ্গে তুলনা করা হয় কেন? অনেক ধাতু আছে সীসার চেয়ে ভারী, যেমন লোহা। আমরা কখনো বলি না, চোখের পাতা লোহার মতো ভারী। লেখকরা এক একটা জিনিস চালু করেন, সেগুলি চালু হয়ে যায়। প্রাচীনকালে বাতাসে প্ৰদীপ নিভত, তখন ধাপ করে শব্দ হতো। লেখকরা লিখলেন, দপ করিয়া প্ৰদীপ নিভিয়া গেল। তা-ই চালু হয়ে গেল। ইলেকট্রিক বাতি নেভা প্রসঙ্গেও এখনকার লেখকরা লিখেছেন, দপ করে বাল্ব নিভে গেল।
আমি ডান পায়ে ঝাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ঘুম তাড়ানোর সহজ উপায় পা দিয়ে ঝাকি দেওয়া। পারলাম না। হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে। গায়ের ওপর দিয়ে ঠান্ডা হওয়া বইছে। ভালোই ঠান্ডা লাগছে। এতে ঘুম আরও গাঢ় হচ্ছে। হাত-পা গুটিয়ে কুকুরগুলি নিদ্ৰা। মাছের তোলে মাছ ভাজার মতো নিজের ওমে নিজে গরম হওয়া।
হিমু, চোখ মেল!
আবার শুনলাম। কোনো একজন আমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই কোনো একজনের গলা ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফতের মতো ভারী। উনি আমাকে কেন ডাকবেন বুঝতে পারছি না। ক্রিকেটের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? মনে হয় না। স্বপ্নদৃশ্য হলে যে ডাকছে তাকে দেখা যেত। চৌধুরী জাফরুল্লাহ সাহেবকে স্বপ্নে দেখারও কিছু নেই। আমি বিড়বিড় করে বললাম, আপনি যে-ই হোন, ক্যানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবেন না। বলতে বলতে ঘুম ভেঙে গেল।
প্রথম কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। আমি কোথায়। ঘুম ভাঙার পর নিজের অবস্থান বুঝতে দশ সেকেন্ড সময় লাগে। নিয়ম হচ্ছে এই দশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থাকা। তারপর চোখ মেলে নিজের অবস্থান বুঝে নেওয়া। আমি তাই করলাম। অবস্থান জানা গেল।
আমি শুয়ে আছি দোতলা লঞ্চের ডেকে। অন্ধকারে লঞ্চ চলছে। ইঞ্জিনের ধক ধক শব্দ হচ্ছে। একজন বৃদ্ধ ছাড়া আমার আশপাশে কেউ নেই। বৃদ্ধের চেহারা হোচিমিনের মতো। বয়স সত্তরের বেশি। পিঠ ধনুকের মতো খানিকটা বেঁকেছে। বৃদ্ধের চোখে মোটা কাচের চশমা। কাচ এতই মোটা যে পেছনের চোখ দেখা যাচ্ছে না। হাতে বেতের বাঁকানো লাঠি। শুনেছি হযরত মুসা আলায়হেস সালামের লাঠি নাকি বাঁকা ছিল। লাঠির মাথায় চোখ আঁকা ছিল। এই বৃদ্ধের লাঠিতে চোখ নেই। চশমা এবং লাঠিতে বৃদ্ধকে মানিয়েছে। লঞ্চে কোনো শখের ফটোগ্রাফার থাকলে তাঁর অনেকগুলি ছবি উঠত। এই বৃদ্ধই কি আমাকে ডাকছিলেন? সম্ভাবনা ক্ষীণ। বৃদ্ধের আমার নাম জানার কথা না।
বাজানের ঘুম ভাঙছে?
হুঁ।
শীতে কষ্ট পাইতেছিলেন, এজন্যে আমার চাদরটা আপনার গায়ে দিছি। নয়া চাদর, আমার মেয়েজামাই খরিদ করে দিয়েছে।
এখন কি চাদর ফেরত চান?
বৃদ্ধ কিছু বলল না, অবাক হয় তাকিয়ে থাকল। সে নিশ্চয়ই আমার কাছে ধন্যবাদসূচক কথাবার্তা আশা করছিল। নিজের গায়ের চাদর অন্যকে দিয়ে বৃদ্ধ কিছু প্রশংসা আশা করতেই পারে মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।
আমি শোয়া থেকে বসলাম। আয়োজন করে হাই তুলতে তুলতে বৃদ্ধিকে বললাম, দুটা টাকা দিন তো। ময়লা নোট দিবেন না। ময়লা নোট ভর্তি থাকে জীবাণু। এখন জীবাণু ছানাছানি করতে পারব না। হাতের কাছে লাইফবয় সাবান নেই যে হাত ধুয়ে জীবাণুর কাছ থেকে সুরক্ষা নিব।
বাজান, আপনার কথা কিছু বুঝতেছি না।
আরও সহজ করে বলি, দুটা টাকা দেন চা খাব।
চা খাওয়ার টাকা দিব?
হ্যাঁ। টাকা ছাড়া ওরা চা দিব কোন দুঃখে!
আমি দিব?
হ্যাঁ, আপনি দিবেন। গায়ে চাদর দিয়েছেন, এখন চা খিলান।
দুই টাকা ভাংতি নাই।
ভাংতি না থাকলে পাঁচ টাকার একটা নোট দেন। তিন টাকা ফেরত দিব।
বৃদ্ধ অসহায় ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করতে করতে বলল, গায়ের চাদরটা ফিরত দেন।
আমি বললাম, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। হাত থেকে কিছু বের হয়ে গেলে আর ফেরত আসে না। কাজেই খামাখা চাদর চাদর করে মুখে ফেনা তুলবেন না। চাদরের ব্যাপারটা ভুলে যান।
বৃদ্ধ হতাশ গলায় বলল, বাজান এইসব কী কন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সহজ কথা দিয়ে শুরু করেছি। আরও কঠিন কথা শুনতে হবে। রাতে লঞ্চের হোটেলে খানা খাব। খানার টাকা দিবেন। লঞ্চের টিকিট কাটি নাই। টিকিটের টাকা দিবেন। হাংকি পাংকি করবেন না। হাংকি পাংকি বোঝেন তো?
বাজান! আমি তো বিরাট বিপদে পড়লাম।
বিপদে তো অবশ্যই পড়েছেন। মানুষ খালি কেটে কুমির আনে, আপনি চাদর বিছিয়ে বাঘ নিয়ে এসেছেন। হালুম।
আমার বিকট হালুম শুনে বৃদ্ধ চমকে খানিকটা পিছলেন। তাঁর চোখে সংশয়। তিনি ধরে নিয়েছেন চাদর ফেরত পেতে তাঁর ঝামেলা হবে। আমি বৃদ্ধের হাত থেকে টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বৃদ্ধ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে কিংবা আমার গায়ে তাঁর চাদরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দূর থেকে দেখলাম তাঁর ঠোঁট নড়ছে। সম্ভবত দোয়া পাঠ করছেন।
তিনতলা লঞ্চের দুতলায় চায়ের দোকান। এখানে শুধু চা বিক্রি হয় না, ভাতও বিক্রি হয়। অ্যালুমিনিয়ামের বিশাল সাইজের বেশ কয়েকটা ডেগা সাজানো আছে। ভাত বিক্রি শুরু হয় নি। দোকানের এক কোনায় সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা—চানপুর ক্রস করিবার পর খানা দেওয়া হইবে। খানার তালিকা দেওয়া আছে। ছোট ব্ল্যাকবোর্ডে চিক দিয়ে লেখা——
ইলিশ মাছ
ইলিশ মাছের ডিম
সবজি
ডাল-খাসি
মসুর ডাল
(মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করিবেন।)
কোন খাবারের কী মূল্য তা লেখা ছিল; এখন মুছে গেছে, কিংবা মুছে ফেলা হয়েছে।
দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চে যুবক বয়সী দুইজন উদাস ভঙ্গিতে চা খাচ্ছে। দুজনের গলাতেই লাল রঙের মাফলার। দুজনের গায়ের শার্টের রঙ হলুদ। তাদের চোখে চশমার ফ্রেমও একই। বোঝাই যাচ্ছে এরা কঠিন বন্ধু। বিয়ে করার সময়ও এরা চেষ্টা করবে। একই পরিবারের দুই বোনকে বিয়ে করতে। একজনের হাতে মোবাইল। মোবাইলে নোংরা কোনো ভিডিও ক্লিপিং আছে। দুজনই আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং খ্যাকশিয়ালের মতে খিকখিক করে হাসতে গিয়েও হাসছে না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
দোকানের মালিক কাঠের উঁচু চেয়ারে বসা। মাথাভর্তি ঘন চুল ছোট ছোট করে কাটা। ডাকাতের মতো চেহারা। এই লোকের দৃষ্টি ক্রমাগত ঘুরছে, কোথাও স্থির হচ্ছে না। আমি চায়ের কাপ নিয়ে দুই যুবকের মাঝখানে বসলাম। তারা সহজেই জায়গা ছাড়ল। বিরক্ত হলো না। যদিও বিরক্ত হওয়ার কথা। দুই বন্ধুর মাঝখানে হাইফেন হয়ে থাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য না। তাদের ভিডিও দেখা কিঞ্চিৎ বাধাগ্রস্ত হলো! চায়ে চুমুক দিয়ে ডানপাশের যুবককে বললাম, চায়ে কর্পুরের গন্ধ পাচ্ছেন?
যুবক তার কাপে চুমুক দিয়ে বলল, হুঁ!
কড়া গন্ধ না?
হুঁ।
চায়ে কর্পুরের গন্ধ কেন পাওয়া যায় জানেন?
না।
জানতে চান? অবশ্যি না-জানাই ভালো। জেনে ফেললে কাপের বাকি চাটা খেতে পারবেন না। দুই টাকার চা নষ্ট হবে।
যুবক তীক্ষ্ণ গলায় বলল, বলেন তো কী ঘটনা।
আমি বললাম, ডেডবডি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হলে চা পাতা দিয়ে মুড়ে নিতে হয়। চা-পাতার সঙ্গে থাকে কপুর। চা-পাতার ভেষজগুণের কারণে ডেডবডিতে পচন ধরে না। ঐ চা-পাতা পরে খুবই সস্তাদরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ডেডবিডির চা-পাতায় বানানো চায়ে থাকে কাপুরের গন্ধ। এখন বুঝেছেন?
পরিষ্কার বুঝেছি। আর বলতে হবে না।
যুবক চায়ের কাপ নামিয়ে আঙুল ফুটাতে লাগল। যুবকের চোখমুখ শক্ত! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যুবক একটা ঘটনা ঘটাবে। বাঘ শিকারের ওপর লাফ দিয়ে পড়ার আগে মাটিতে লেজ দিয়ে বাড়ি দেয়। মানুষের লেজ না থাকার কারণে সে আঙুল ফুটায়। অনেকে থুথু ছিটায়।
এই যুবকের বন্ধু ভীতু প্ৰকৃতির। সে চাপা গলায় বলল, বাদ দে দোস্ত। বাদ দে।
বাদ দিব কেন?
ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী?
ঝামেলার প্রয়োজন আছে। এই হারামজাদার নাকটা আমি যদি না ফাটাই আমার নাম শাকুর না। আমার নাম কুকুর।
আমি গলা নামিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, শাকুর ভাই, ভিডিওতে কী দেখাচ্ছেন, আমাকে দেখাবেন?
আমার কথা বলার ভঙ্গিতে হোক বাঁ অন্য কোনো কারণেই হোক, শাকুর ভাই আমার দিকে বন্ধু-ভঙ্গিতে তাকালেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, প্রাইভেট জিনিস দেখছি! আপনার দেখা ঠিক না। দেখলে লজ্জা পাবেন।
দেশি মেয়ে না বিদেশি?
দেশি।
মডেলকন্যা?
না, আমাদের অঞ্চলের মেয়ে। নিজে ইচ্ছা করে তুলেছে, এখন আমাদের দুইজনকে দোষ দেয়। আমরা নাকি ফান্দে ফেলে ছবি তুলেছি। আপনি বলেন, মেয়েছেলে কি ফান্দে পড়ার জিনিস? ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে—এই গান শোনা যায়। কিন্তু ফান্দে পড়িয়া বগী কান্দে এমন গান নাই।
আমি বললাম, অতি সত্য কথা বলেছেন। এ রকম সত্য কথা সচরাচর শোনা যায় না।
তাহলেই বোঝেন।
আপনাদের ভিডিওর দোকান আছে?
হুঁ। আমাদের ভিডিওর ব্যবসা। ভিডিও ফিল্ম বানাব। আমি পরিচালক। আমার প্রথম কাজ। নায়িকার সন্ধানে ঢাকা গিয়েছিলাম।
নায়িকা পেয়েছেন? একজন পেয়েছি। হাইট খুবই কম। এইটাই সমস্যা। কায়দা করে ক্যামেরা ধরতে হবে। অর্ডার দিয়ে এক ফুট হাইটের জুতা বানাতে হবে।
ভালো ঝামেলায় আছেন বুঝতে পারছি। আপনি কি চায়ের দোকানিকে সত্যি মারবেন?
অবশ্যই। না মারলে বাপ-মায়ের দেওয়া আকিকা করা নাম চেঞ্জ করতে হবে। এটা ঠিক না।
মারামারি শুরু হবে কখন?
রাগ উঠাচ্ছি। রাগ এখনো উঠে নাই। আমার রাগ উঠতে দেরি হয়। এমনও হয়েছে রাগ উঠতে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগেছে।
আমি উঠে পড়লাম। শাকুর ভাইয়ের রাগ উঠুক, তারপর দেখা যাবে কতদূর কী হয়। আপাতত লঞ্চ ঘুরেফিরে দেখা যাক। ভূ-পর্যটক রমানাথ। লঞ্চ-পর্যটক হিমু। আমার পর্যটন শুরু হলো লঞ্চের পেছন থেকে।
দুই হাত হাতকড়ায় আবদ্ধ একজনকে দেখা গেল। কোমর দড়ি দিয়ে বাঁধা। পায়ে ডাপ্তাবেড়ি। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় বাবরি চুল। সাদা লুঙ্গির ওপর মাওলানা ভাসানী টাইপ সাদা পাঞ্জাবি। তার সঙ্গে চারজন রাইফেলধারি পুলিশ। সবাই পা লেপ্টেট মেঝেতে বসে আছে। তাদের কাছাকাছি লাল প্লাষ্টিকের চেয়ারে একজন সাব-ইন্সপেক্টর বাসা। শার্টের পকেটে নাম লেখা—জাকির হোসেন।
উৎসুক কিছু মানুষ দূর থেকে দেখছে। কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। আমি এগিয়ে গেলাম। বিনীত গলায় বললাম, জাকির ভাই, আপনাদের কিছু লাগবে? চা-সিগারেট? লাগলে বলেন, এনে দিব।
জাকির হোসেন বিরুস গলায় বললেন, কিছু লাগবে না। তিনি ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাচ্ছেন। কাঠির যে অংশে বারুদ সেই অংশই ক্যানের ভেতর ঢুকানো। তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগে। মনে হয় এই বুঝি কাঠিতে আগুন ধরে যাবে।
আমি বললাম, স্যার হাতকড়া পরা মাওলানা সাহেবের ঘটনাটা কী?
ঘটনা তোমার জানার প্রয়োজন নাই।
আমি পত্রিকার লোক। ঘটনা জানলে নিউজ করে দিতাম। ছবিসহ নিউজ। সঙ্গে আপনার মিনি ইন্টারভিউ।
কোন পত্রিকা?
আমি কালের চিৎকার পত্রিকার ভ্ৰাম্যমাণ লঞ্চ-সাংবাদিক। লঞ্চে ঘুরে ঘুরে নিউজ সংগ্ৰহ করি।
হাতকড়া পরা মানুষটি আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাংবাদিক ভাই বসেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বসলাম। এইসব ক্ষেত্রে দেরি করতে নাই। জাকির হোসেন কঠিন চোখে তাকালেন তবে কিছু বললেন না। তিনি কাঠি দিয়ে কান চুলকিয়েই যাচ্ছেন। মনে হয়। কাঠিতে আগুন না। ধরা পর্যন্ত তিনি থামবেন না।
আমি হাতকড়া বাধা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার নাম কী?
আমি পীর হাবিব কুতুবি।
আপনি পীর নাকি?
জি। আমার হাজারের ওপর মুরিদ আছে। মুরিদানদের মধ্যে জজ আছে, উকিল আছে, সাংসদ আছে। একজন প্রতিমন্ত্রী আছে।
বলেন কী!
সবই আল্লাহর লীলা, আমার কিছু না। সুবাহানাল্লাহে ওয়াল হামদু লিল্লাহে ওয়া-লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবর। অর্থ-আমি আল্লাহতালার পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি এবং সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহতালার জন্যে। আর তিনি ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নাই এবং আল্লাহতালাই সর্বশ্ৰেষ্ঠ।
আপনার এই অবস্থা কেন?
পীর হাবিব কুতুবি হাসিমুখে বললেন, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলাম। এখন আমাকে বরিশাল সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই ফাঁসি দিবে।
ফাঁসি?
জি। বরিশাল হলো মফস্বল শহর। সেখানে ফাঁসির ব্যবস্থা কেমন কে জানে! ভালো থাকার কথা না। সরকারের কাজকর্ম কিছুই বুঝি না। তাদের উচিত ছিল আমাকে ঢাকায় ফাঁসি দেওয়া। তাদের খরচ বঁচিত। সাংবাদিক ভাই, আমার এই কথাটা মনে করে লিখবেন।
অবশ্যই লিখব। আপনার ফাঁসি হলো কেন? করেছিলেন কী?
আমি কিছুই করি নাই। আমার পালা জ্বিন কফিল করেছে। আমার দুই স্ত্রী এবং এক শালি তিনজনকে একসাথে খুন করেছে। দোষ পড়েছে আমার ঘাড়ে। তবে আশায় আছি শেষ মুহূর্তে জ্বিন কফিল বুঝবে কাজটা সে অন্যায় করেছে। আদালতে গিয়ে বলবে, হুজুরে কেবলা, পীর হাবিব কুতুবি নির্দোষ।
আদালতে সে যাবে কীভাবে? জ্বিন চোখে দেখা যায় না বলে শুনেছি।
ভুল শুনেছেন। তারা নানান বেশ ধরতে পারে। কুকুরের রূপ নেয়, সাদা সাপের রূপ নেয়। মাঝে মধ্যে মানুষের বেশও ধরে।
জ্বিন কফিল কি এখন আপনার সঙ্গে আছে?
জি আছে। পালা জ্বিন। যাবে কোথায় বলেন? তবে সে এখন কষ্টে আছে।
কষ্টে কেন?
পানির উপর দিয়ে যাচ্ছি। তো এই কারণে কষ্ট। জ্বিন জাতি পানির উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে না।
এটা জানতাম না।
আগুনের তৈরি জিনিস, বোঝেন না কেন? রাব্বি আমী মাচ্ছানিয়াদুরু ওয়া আন্তা আরহামুর রাহেমীন। অর্থ—হে প্ৰভু নিশ্চয়ই আমাকে কষ্ট আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে এবং তুমি দয়ালুদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু।
পীর সাহেব, জ্বিন এখন কোথায়?
ওসি সাহেবের কোলে বসে আছে। জ্বিন জাতি উঁচা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।
ওসি সাহবে নড়েচড়ে বসলেন, আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, হ্যালো সাংবাদিক! অনেক কথা শুনেছেন। এখন যান। খুচরা আলাপ বন্ধ করেন।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, একটা অনুরোধ। দুষ্টপ্রকৃতির খুনি জ্বিন কফিল আপনার কোলে বসে আছে। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকাবেন না। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কী দুর্ঘটনা?
মনে করুন কাঠির মাথা ভেঙে কানের ভেতর থেকে গেল। বিরাট টেনশন—-কাঠির মাথায় আগুন ধরে যায় কি না।
ইউ গেট লস্ট।
চলে যাচ্ছি স্যার। প্রয়োজন পড়লে খবর দিবেন। আমি তিনতলার ডেকে আছি।
ওসি সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, খামাখা বাতচিত করতেছেন কেন? নিষেধ করলাম না? সাংবাদিকের আমি… ছিঁড়ি।
অশ্লীল কথা বলবেন না স্যার।
চুপ বললাম। চুপ।
চায়ের দোকান থেকে হইচইয়ের শব্দ আসছে। মনে হয় ধুন্ধমার শুরু হয়েছে! দৌড়াদৌড়ির শব্দ। চিৎকারের শব্দ। মাঝনদীতে লঞ্চ হঠাৎ থেমে গেল। প্ৰতি লঞ্চেই তিনজন আনসার থাকে। আনসারদের বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অতি ক্ষুদ্র ঝামেলার সময়ও দেখা যায় আনসাররা নিজেদের রাইফেল ফেলে দিয়ে প্ৰাণপণ শব্দে বাঁশি বাজায়।
জাকির হোসেন চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে পুলিশি ধমক দিলেন, এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যেতে বললাম না?
পীর সাহেব বললেন, সাংবাদিক ভাই থাকুক না। উনার সঙ্গে কথা বলে মজা পাচ্ছিলাম।
এত মজার প্রয়োজন নাই।
পীর সাহেব বললেন, আপনাদের নাই। মজা পাওয়ার অনেক সময় আপনাদের আছে। আমার মজার প্রয়োজন আছে। কারণ আমার সময় শেষ। সাংবাদিক ভাই, আপনাকে একটা আমল শিখায়ে দেই। এই আমল নিয়মিত করলে নাজাত পাবেন। আমাদের সবার জন্যে নাজাত প্রয়োজন, এমনকি জ্বিন জাতির জন্যেও নাজাত প্রয়োজন।
আমি জাকির হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার অনুমতি দেন। আমলটা শুনে যাই। আমার নাজাত পাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন।
জাকির হোসেন হ্যা-না কিছু বললেন না। মনে হচ্ছে আমল শোনার অনুমতি দিলেন। পীর সাহেব বললেন, সাংবাদিক ভাই! যতবার ঘুমাতে যাবেন, ততবার এই আমল করবেন। খাসিনিয়তে বলবেন, আল্লাহুমা বি ইছমিকা আমতু ওয়া আহ্ইয়া। অর্থ –হে আল্লাহ্, তোমারই নামে আমি মৃত্যুর কোলে অর্থাৎ নিদ্ৰায় যাইতেছি এবং জীবিত হইব। সাংবাদিক ভাই মনে থাকবে?
থাকবে।
তাহলে যান হইচই কী হইতেছে খোঁজ নেন। আপনারা সাংবাদিক মানুষ। যেখানে হইচই সেখানেই সাংবাদিক। যেখানে খুন-খারাবি সেখানে পুলিশ, যেখানে আল্লাহ-খোদার নাম সেখানে পীর মুরশিদ। যেখানে মদ মেয়েমানুষ সেখানেই দালাল।
আমি জাকির হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার! হইচইটা কিসের সেই সন্ধান নিয়ে আপনাকে কি জনাব?
জাকির হোসেন কঠিন গলায় বললেন, প্রয়োজন নাই।
পীর কুতুবি বললেন, উনার প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমার প্রয়োজন আছে। সাংবাদিক ভাই, কী ঘটনা আমাকে জানাবেন। আমি জ্বিন কফিলের মাধ্যমে সংবাদ নিতে পারি। তবে সে মিথ্যা কথা বলে। জ্বিন জাতি মানুষের চেয়েও বেশি মিথ্যা বলে।
চায়ের দোকানের ঝামেলা এখনো লাগে নাই, তবে লাগবে। আনসারের বাঁশি বাজানোর কারণ ভিন্ন। চলন্ত লঞ্চে ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। তার বয়স সতেরো-আঠারো। করুণ চেহারা। পায়জামা-পাঞ্জাবিতে তাকে নিতান্তই অসহায় দেখাচ্ছে। সে এক পান-ব্যবসায়ীর খুঁতির টাকা সরিয়েছে। টাকার পরিমাণ খারাপ না। দুই লাখ ছেচল্লিশ হাজার। পান ব্যবসায়ী এখন কোনো ঝামেলায় যাচ্ছেন না। টাকাটা ফেরত চাচ্ছেন। টাকা আনসারদের কাছে। তারা টাকা ফেরত দিবে না। তারা হেডকোয়ার্টারে টাকা জমা দিবে। প্রমাণ দিয়ে সেখান থেকে টাকা নিতে হবে।
লাল মাফলার শাকুর ভাই আমাকে দেখে বললেন, ঘটনা বুঝেছেন? আনসাররা টাকা মেরে দেওয়ার ধান্ধায় আছে। শাকুর ভাইয়ের দোস্ত বললেন, ইহা সত্য।
পান ব্যবসায়ী কোথায়?
পুলিশের ওসি সাহেবের কাছে গেছে। বোকাসোকা মানুষ; এ টাকা উদ্ধার করতে পারবে না। তবে আমি ব্যবস্থা নিব। আনসারের গলায় পাড়া দিয়ে টাকা বের করব। টাকা খরচ হবে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে।
পান ব্যবসায়ী কিছু পাবে না?
কিছু অবশ্যই পাবে। টাকা উদ্ধার করে দিব, সেই খরচ আছে না?
আছে।
একজন ওসি সাহেব লাঞ্চে আছেন তাকেও ভাগ দিতে হবে।
আমি বললাম, বেশি ভাগাভাগি করলে দেখা যাবে আপনার ভাগেই কিছু থাকল না।
শাকুর ভাই বললেন, আমি টাকা নিয়ে কী করব? নাটক বানাচ্ছি। টাকার প্রয়োজন আছে, তবে অন্যের টাকা কেন নিব? আমি ছাত্রলীগ বা জাতীয় ছাত্রদল করলেও একটা কথা ছিল। যে-কোনো টাকায় এদের হক আছে। সত্যু কথা বলছি না?
অবশ্যই।
নাটক করার অভ্যাস আছে?
না। তবে শখ আছে। শিখিয়ে দিলে পারব। আপনার মতো গুণী পরিচালকের হাতে পড়লে জীবনের একটা গতি হয়ে যাবে।
চোখ টেরা করতে পারেন?
চেষ্টা করলে পারব।
চোখ টেরা করে দেখান তো।
আমি চোখ টেরা করে দেখলাম। পরিচালক সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আপনাকে দিয়ে হবে। আমার একটা ক্যারেক্টার আছে, মেয়েছেলে দেখলেই ট্যারা হয়ে যায় এবং তোতলাতে শুরু করে। কমেডি ক্যারেক্টার। তোতলাতে পারেন?
সেইভাবে পারি না। তবে চেষ্টার ক্রটি হবে না।
তোতলাতে তোতলাতে বলুন তো, কেমন আছ রিনা?
কে কে কে মনআ ছরি না।
বাহ ভালো হয়েছে। হানড্রেড পারসেন্ট ok, আপনাকে নিয়ে নিলাম।
আমি পরিচালককে কদমবুসি করে ফেললাম। পরিচালক হৃষ্ট গলায় বললেন, ভিডিও ক্লিপ দেখতে চেয়েছিলেন, নেন আড়ালে নিয়ে দেখেন। পাটখেতের ভেতরে ভিডিও করা। ক্লিয়ার ভিউ পাবেন না। তারপরেও যা আছে যথেষ্ট। মেয়ের নাম সুলতানা, ক্লাস নাইনে পড়ে। এই বয়সেই পেকে ঝানু নারিকেল হয়ে গেছে। দেখেন কেমন খিলখিল হাসি। দেখলেন?
হুঁ।
কেউ খিলখিল করে হাসতে হাসতে নেংটি হতে পারে? তাও ক্যামেরার সামনে?
কাজটা কঠিন।
এলাকার সাংসদ লোকজন নিয়ে যখন আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন তাকেও আমি এই কথা বললাম। আমি ভদ্রভাবে বললাম, স্যার খিলখিল করে হাসতে হাসতে কোনো মেয়ের পক্ষে কি ক্যামেরার সামনে কাপড় খোলা সম্ভব?
সাংসদ বললেন, আজকালকার মেয়েদের পক্ষে সবই সম্ভব। আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাকশন চাই। আমার এলাকায় অনাচার হবে না।
আমি তখন ওসি সাহেবকে কুড়ি হাজার টাকা নজরানা দিলাম। ওসি সাহেব টাকা পকেটে রাখতে বললেন, ক্যামেরার সামনে এই অবস্থায় খিলখিল অসম্ভব। পুরো ঘটনা আপোষে ঘটেছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। সাংসদদের সব কথা শুনলে আমাদের চলে না। আমাদের ইনকোয়ারি করতে হবে। কঠিন তদন্ত হবে। তারপর ব্যবস্থা।
শাকুর ভাই আপনার নাটকের নাম কী?
নাটকের নাম কেঁদো না পারুল। রোমান্টিক অ্যাকশান এবং হাই ফ্যামিলি ড্রামা। নাম কেমন হয়েছে?
আমি বললাম, প্যান প্যানা নাম হয়েছে। কান্দিস না পারুল নাম হলে ভালো হতো।
দুই বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মনে হয় নাম পছন্দ হয়েছে।
শাকুর ভাইয়ের বন্ধু বললেন, কান্দিস না পারুল নামের মধ্যে পাওয়ার আছে। এটা নিয়ে আরও চিন্তা করা প্রয়োজন। আপনি মোবাইলে ভিডিও ক্লিপিং দেখতে থাকুন। নাটকের নাম আজ রাতেই ফাইনাল হবে।
আমি বললাম, মোবাইল ফোন আপনার কাছে থাকুক। অবসর সময়ে আপনার সঙ্গে আরাম করে দেখব। এইসব জিনিস একা দেখা যায় না।
সত্যি কথা বলেছেন। যান কোথায় যাচ্ছেন, ঘুরে আসেন। তারপর তিন ভাই মিলে আরাম করে দেখব। দেখার মতো অনেক জিনিস আছে।
আমি দােতলার ডেকে চলে গেলাম। বৃদ্ধ আগের জায়গাতেই বসা। আমাকে দেখে করুণ গলায় বলল, বাজােন। চাদরটা কি দিবেন? আমার শীত লাগতেছে।
আমি বললাম, লঞ্চ বন্ধ। বাতাস নাই। শীত লাগবে কেন?
বৃদ্ধ চিন্তিত গলায় বলল, লঞ্চ বন্ধ কী জন্যে?
জানি না। খোঁজ নিব?
বাজান! খোঁজ নেন। জানি না। কী জন্যে যেন ভয় লাগতেছে।
লঞ্চের খোঁজ নিয়ে জানলাম, অবস্থা ভয়াবহ। একই সঙ্গে লঞ্চের হাল ভেঙেছে, ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে। লঞ্চ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পানিতে ভাসছে। সারেঙের নাম খালেক। বাড়ি চট্টগ্রাম। তার জ্বর উঠেছে একশ পাঁচ। সে বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে। সকিনার মা নামে একজনকে চোখ বড় বড় করে খুঁজছে। যে পানি ঢালছে, কিছুক্ষণ পর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে, ও সকিনার মা, তুই কন্ডে? আঁর শরীর পুড়ি যার গৈ। তুই কডে?
লঞ্চ চাঁদপুরকে বাঁ-পাশে রেখে চলে যাচ্ছে। আব্দুল খালেক লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসল। ঝলমলে চাঁদপুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, যারগৈ! চানপুর যারগৈ। চাঁদপুর চলে যাওয়াতে তাকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে।
লঞ্চ মোহনায় দুলছে
এখন মধ্যরাত্রি। লঞ্চ মোহনায় দুলছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝড় শুরু হবে। ঝড়ের সময় লঞ্চকে কে সামলাবে বোঝা যাচ্ছে না। সারেং খালেকের জ্বর আরও বেড়েছে। মাথায় পানি ঢেলে এই জ্বর কমানো যাবে না। দমকল ডাকতে হবে।
অল্প বাতাস ছেড়েছে, এতেই লঞ্চ এপাশি-ওপাশ করা শুরু করেছে।
ছোট জেনারেটর এতক্ষণ চলছিল। কিছুক্ষণ আগে জেনারেটর বন্ধ হয়েছে। পুরোপুরি বন্ধ হয় নি, মাঝে মাঝে চালু হচ্ছে। এখন ভরসা কয়েকটা হারিকেন। আজকালকার চায়নিজ মোবাইলে টর্চলাইটের মতো থাকে। মোবাইলধারীরা তাদের টর্চলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে অন্ধকার কমে নি, বরং বেড়েছে।
সারেঙের মাথায় যে পানি ঢালছে তার নাম হাবলু মিয়া। বয়স পনের-ষোল। হাস্যমুখী। সম্ভবত তার জীবনের মটো হলো, সৰ্ব্ব অবস্থায় আনন্দে থাকতে হবে।
আমি বললাম, লঞ্চের লোক বলতে কি তোমরা দুজন? আর কেউ নাই?
কী বলেন স্যার! দুইজনে কি এতবড় লঞ্চ চলে? ইঞ্জিন মাস্টার আছে। খালাসি আছে। লঞ্চমালিকের ছোটপুলা কাদের সাব আছেন।
কাদের সব কোথায়?
সারেঙের কেবিনে আছেন। উনার কাছে খবৰ্দার যাবেন না।
সমস্যা কী?
উনি অসামাজিক কাজে ব্যস্ত। তার উপর মাল খেয়েছেন। স্যারের কেবিনে মেয়েছেলে আছে।
বলো কী?
উনার সঙ্গে লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। মিজাজও উগ্র। আমারে তাক কইরা একবার গুল্লি দিছিলেন। নিশা অবস্থায় ছিলেন বইল্যা গুল্লি লাগে নাই। নিশার মধ্যেও উবগার আছে।
নিশার উপকারের কথা ভেবেই হয়তো হাবলু মিয়া মনের আনন্দে হলুদ দাঁত বের করে হাসল। তার কাছ থেকে লঞ্চে অসামাজিক কাজের নানান গল্প শুনে ডেকে ফিরছি, হঠাৎ একটা কেবিনের জানালা খুলে গেল। আতঙ্কিত এক তরুণীর পল শোনা গেল!
এক্সকিউজ মি! আপনি কি এই লঞ্চের কেউ? আমি বললাম, হ্যাঁ। ম্যাডাম কী লাগবে বলুন? চা খাবেন? চা এনে দিব?
চা আমার সঙ্গে আছে। চা লাগবে না। আপনি এক মিনিটের জন্যে কেবিনে আসবেন? আমি প্ৰচণ্ড ভয় পাচ্ছি।
সাঁতার জানেন না?
সাঁতার কেন জানতে হবে? লঞ্চ কি ড়ুবে যাবে নাকি?
হ্যাঁ ড়ুববে। তবে সাঁতার জেনেও লাভ নেই। তারপরেও গাপপুর-গুপপর করে কিছুক্ষণ ভেসে থাকা।
প্লিজ আপনি কেবিনে এসে কিছুক্ষণ বসুন।
আপনি একা?
জি আমি একা। আমি আমার মামার বাড়ি বরগুনা যাচ্ছি। সবাই বলছিল বাই রোডে যেতে। আমি ইচ্ছা করে লিঞ্চে যাচ্ছি। অনেকেই আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। আমি কাউকে আনি নি। আমার আত্মীয়স্বজনরা সারাক্ষণ বকবক করে। ওদের বকবকানি শুনতে ভালো লাগে না।
ওদের না। এনে ভালো করেছেন। দলবল নিয়ে মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না। কবি রবীন্দ্ৰনাথ এইজন্যেই বলেছেন, একলা মরো, একলা মরোরে।
উনি এক মরতে বলেছেন?
উনি একলা চলতে বলেছেন। মৃত্যুও তো অনির্দিষ্টর দিকে চলা।
লঞ্চ কি সত্যি ড়ুববে?
ঝড় উঠলেই ড়ুববে। ঝড় এখনো ওঠে নি। ঝড় উঠলেই দেখবেন লঞ্চ ডানদিকে কান্ত হয়ে ভূস করে ড়ুবে যাবে। আপনার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা আছে? ভিডিও ক্যামেরা থাকলে লঞ্চ ড়েবার প্রক্রিয়াটা ভিডিও করে রাখতে পারেন। ভিডিও করার সময় বঁটা দিকে থাকবেন। খেয়াল রাখবেন লঞ্চ ড়ুববে ডানদিকে।
ডানদিকে কত হবে কেন?
কারণ লিঞ্চের লোকজন ডানদিকে মালামাল বোঝাই করেছে।
প্লিজ ভেতরে এসে কিছুক্ষণ বসুন। প্লিজ। আমার কাছে চার্জ লাইট আছে। চার্জলাইট জ্বালাচ্ছি।
আমি কেবিনে ঢুকলাম। পাশাপাশি দুটা বিছানা। আমি মেয়েটির মুখোমুখি বসলাম। প্রথমবারের মতো তার দিকে ভালোমতো তাকলাম। কিছুক্ষণের জন্যে আমার বাকরুদ্ধ হলো।
নদের চাঁদের সঙ্গে এই মেয়ের দেখা হলে তিনি বলতেন,
বাড়ির কাছে শানে বাঁধা চারকোনা পুসকুনি
সেই ঘাটোতে তোমার সঙ্গে সাঁতার দিব আমি।।
অন্দরমহলে আমার ফুলের বাগান
দুইজনে তুলব ফুল সকাল বিহান।।
চন্দাহার পরাইয়া নাকে দিব নথ।
নূপুরে সোনার ঝুনঝুনি বাজবে শত শত।।
এই মেয়ে নদের চাঁদের মহুয়ার চেয়েও সুন্দর। মহুয়ার চেহারায় নিশ্চয়ই গ্রাম্য ভাব ছিল। এই মেয়ে টাকশালের নতুন রুপার টাকার মতো ঝকঝাক করছে।
অতি রূপবতীদের চেহারায় কোথাও-না-কোথাও কিছু ত্রুটি থাকে। আমি ক্ৰটি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এমন কি হতে পারে মেয়েটার একটা দাঁত গেজা? কান ছোট বড়? নাকের ভেতর থেকে লোম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে!
রূপবতী বলল, আপনি ট্যারা নাকি?
না। আমি একটা ভিডিও নাটকে সুযোগ পেয়েছি। নাটকের চরিত্র সুন্দর মেয়ে দেখলেই ট্যারা হয়ে যায়। প্রাকটিসের ওপর আছি। আপনাকে দেখে ট্যারা হওয়া প্ৰস্তুত করলাম। আপনার ভয় কি ক ক ক কমেছে?
তোতলাচ্ছেন্ন কেন?
আমি যে চরিত্রটা করছি সে যে শুধু ট্যারা, তা-না। তোতলাও।
ভালো কথা, আপনি করেন কী?
প্যাসেঞ্জারদের চা-পানি খাওয়াই। কেবিন ঝাঁট দেই। আপনি কি রাতে খাবার খাবেন? আগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে।
আমি টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছি। বিশাল বড় টিফিন ক্যারিয়ারে করেক হাবার দিয়েছে, আমার মনে হয় লঞ্চের অর্ধেক মানুষ খেতে পারবে। আপনার নাম জানা হয় নি। আপনার নাম কী?
হিমু।
আমার নাম তৃষ্ণা। আমি বাংলাদেশে থাকি না! Ph.D করছি। Physics-এ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন।
থিসিসের বিষয় কী?
থিসিসের বিষয় বললে কি বুঝবেন?
বোঝার কথা না, তারপরেও বলুন।
হিগস কণা। কখনো নাম শুনেছেন?
হিগস হচ্ছে ঈশ্বরের কণা, এই কথা শুনেছি। তবে নামকরণ ভুল। সব কণাই ঈশ্বরের কণা। আপনার নাকে সামান্য সর্দির ইশারা দেখতে পাচ্ছি। সর্দি কণাও ঈশ্বরের কণা।
তৃষ্ণা নাক মুছতে মুছতে বলল, আপনি কি সত্যি লঞ্চের বয়?
তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই লঞ্চ প্রবলভাবে দুলে উঠল। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। মনে হয় বড় কোনো ঘূর্ণনে পড়েছে। তৃষ্ণা বলল, কী সর্বনাশ! হচ্ছেটা কি?
আমি বললাম, তেমন কিছু হচ্ছে না, লঞ্চ ঘুরছে। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে সব কিছুই ঘুরে। সূর্য ঘুরে, পৃথিবী ঘুরে, ইলেকট্রন ঘুরে, লঞ্চ কেন ঘুরবে না? তৃষ্ণা! শাড়িতে আপনাকে খুবই সুন্দর লাগছে, তবে আপনি শাড়ি পাল্টে শার্ট-প্যান্ট পরে নিন।
কেন?
লঞ্চ ভুবলে শাড়ি পরে সাঁতার কাটা মুশকিল।
এইসব আপনি কী বলছেন? সত্যি কি লঞ্চ ড়ুববে?
ড়ুববে। আমি একটা লাইফ বেল্ট জোগাড় করে নিয়ে আসি। লাইফ বেল্ট নিয়ে কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন। লঞ্চ ড়ুবে যাওয়ার পর লাইফ বেল্ট নিয়ে বের হবেন। এর মধ্যে খাওয়াদাওয়া করে নিন।
Oh God! Oh God!
Oh God, Oh God করবেন না। বরং ও আলাহ ও আল্লাহ করুন। আল্লাহপাক নানান ধরনের ভাষা দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন ভাষায় তাঁকে ডাকা পছন্দ করেন।
আপনি অবশ্যই লঞ্চের বয় বেয়াক্কা কেউ না। প্লিজ। আপনার পরিচয় দিন।
কঠিন সমস্যায় ফেললেন।
কঠিন সমস্যা হবে কেন?
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষ তার পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে, এখনো পরিচয় পায় নি। যেদিন সে তার পরিচয় পাবে সেদিনই সৰ্বজ্ঞানের সমাপ্তি।
আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ।
প্লিজ আরেকটা সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যান। আমার পাশের কেবিনে এক হাসবেন্ড-ওয়াইফ উঠেছেন। হাসবেন্ডের অনেক বয়স। স্ত্রী কমবয়েসী। ওয়া কেবিনে উঠেই দরজা বন্ধ করেছেন। আর দরজা খুলছেন না। মাঝে মাঝে ঐ কেবিনে একটা মুরগি ডেকে উঠে, তখন মহিলা ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন। আমি কয়েকবার ডাকাডাকি করেছি, কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
মুরগি ডাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। রহস্যভেদের ব্যবস্থা করছি। আমি একটা চক্কর দিয়ে আসি তারপর দরজা ভেঙে এদের বের করার ব্যবস্থা করুব।
দরজা ভাঙতে হবে কেন?
দরজা না ভাঙলে এরা বের হবে না। এরা মোটেই স্বামী-স্ত্রী না। অসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যে কেবিন ভাড়া করেছে। সারা রাত আমোদ-ফুর্তি করতে করতে যাবে। ভোরবেলা পৌঁছবে বরিশাল। এরা দুজন কেবিন থেকে নামবে না। সারা দিন কেবিনে থাকবে। খাওয়াদাওয়া করবে। রাতে ঢাকা ফিরবে। লঞ্চের সঙ্গে এই বন্দোবস্ত।
আপনি জেনে বলছেন, নাকি অনুমানে বলছেন?
জেনেই বলছি। সারেঙের অ্যাসিসটেন্ট হাবলু মিয়ার সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ ভাব হয়েছে। সে-ই বলেছে। তিন নম্বর কেবিনের এক প্রফেসর সাহেবও এই চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছিলেন। তার ছাত্রী সঙ্গে যাবে। শেষ মুহুর্তে ছাত্রী আসে নি। প্রফেসর সাহেব মুখ ভোতা করে বসে আছেন। তার ভাড়ার টাকা পুরোটাই জলে গেছে। টাকা শুধু যে জলে গেছে তা না, তিনি নিজেও জলে যাবেন এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কালের চিৎকার পত্রিকার চলমান লঞ্চ সাংবাদিক হিসেবে কোথায় কী ঘটছে দেখা দরকার। আমি ভ্রমণে বের হলাম। তৃষ্ণা মেয়েটি ভয় পেতে থাকুক। ভয় ভাঙানোর জন্য যথাসময়ে তার কাছে যাওয়া যাবে। তৃষ্ণা ছাড়া লঞ্চের আর কাউকে উীত দেখলাম না। সবাই স্বাভাবিক অৰ্দ্ধাচরণ করছে। লঞ্চ মোহনায় ঘুরপাক খাচ্ছে—এটা যেন কোনো ব্যাপার না।
এখন কালের চিৎকার প্রতিবেদকের প্রতিবেদন।
আনসার বাহিনী
আনসার বাহিনীর চার সদস্যের তিনজন টাকা নিয়ে পলাতক। একজন পাবলিকের কাছে ধরা খেয়েছে। তাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে তাকে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। যিনি তাকে পানিতে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন তার নাম রুস্তম। মধ্যমবয়সী গাটাগোট্টা মানুষ। কুৎকুতে চোখ। চিবুকে ছাগলা দাড়ি। রুস্তম বরিশাল ট্রাকচালক সমিতির কোষাধ্যক্ষ। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনলাম।
প্ৰাণপ্রিয় ভাইয়েরা আমার। আনসার বাহিনী আমাদের রক্ষক হয়ে হয়েছে ভক্ষক। ছিনতাইয়ের টাকা উদ্ধার করে নিজেরা গাপ করে দিয়েছে। ভেবেছে পার পাবে? পার পাবে না। একজন ধরা খেয়েছে, তাকে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। সে যদি সাঁতার দিয়ে কুলে উঠতে পারে এটা তার ভাগ্য। যদি কুলে উঠতে না পারে, যদি সলিল সমাধি হয় সেটাও তার ভাগ্য। বলেন, আল্লাহু আকবার।
দুর্বল ভঙ্গিতে কয়েকজন মিলে বলল, আল্লাহু আকবার।
রুস্তম হুংকার দিয়ে বলল, তবে আপনারা যদি মনে করেন। আমি একা তাকে পানিতে ফেলব আপনারা ভুল করেছেন। আমরা সবাই মিলে পানিতে ফেলব। এই জন্যেই কবি বলেছেন, সবে মিলে করি কাজ হারিজিাতি নাহি লাজ। জনতার আদালত তৈরি হয়েছে। জনতার আদালতে সবার বিচার হবে। অপরাধী যে-ই হোক তাকে পানিতে ফেলা হবে। বলুন, আল্লাহু আকবার।
আবার দুর্বল ধ্বনি, আল্লাহু আকবার। রুস্তম রণাহুংকার দিয়ে বলল, আপনাদের গলায় জোর নাই। মুরগির বাচ্চাও তো আপনাদের চেয়ে উঁচা গলায় কক কক করে। বুলন্দ আওয়াজ দেন, আল্লাহু আকবার।
আগের চেয়েও ক্ষীণ আওয়াজ উঠল, আল্লাহু আকবার।
অপরাধী
ছিনতাইকারী শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। তবে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে মার খায় নি। এতেই খুশি। লঞ্চ-বাস-ট্রেনের কামরায় ধরা পড়া ছিনতাইকারীর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এরা পালিয়ে যেতে পারে না বলে মার খেতে খেতে শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে মারা যায়। কিছু আছে বিড়ালের মতো কঠিন প্রাণশক্তি, এরা লুল হয়ে বেঁচে থাকে। লুলা হওয়ার কারণে ভিক্ষার সুবিধা হয়। ভিক্ষুক শ্রেণীতে লুলা স্বামীর অনেক কদর। আর্মি অফিসার এবং ইঞ্জিনিয়াররা রূপবতী স্ত্রী পায়। লুলা ভিক্ষুকরাও রূপবতী ভিক্ষুক স্ত্রী পায়।
চায়ের দোকানের মালিক এখনো ধরা খায় নি। সে চা বিক্রি করে যাচ্ছে। লাশের চায়ের ব্যাপারই মনে হয় চাপা পড়ে গেছে। তবে আমি নিশ্চিত যথাসময়ে বিষয়টা উঠবে।
চা-ওয়ালা নিজের মনে বিড়বিড় করছে—পানিতে ফেলব। তর বাপের পানি!
রুস্তম বলল, ব্রাদার কিছু বলেছেন?
না কিছু বলি নাই।
যা বলার আওয়াজে বলবেন। বিড়বিড়ানি বন্ধ। আপনার বিষয়েও সিদ্ধান্ত
হবে।
আমার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?
পাবলিকেরে লাশের চা খিলাইছেন। পাবলিক আপনেরে ছাড়বে না।
চা-ওয়ালা বলল, পাবলিকের মারে আমি.।
রুস্তম বলল, হারামির পুত কী বলেছে আপনারা শুনছেন? জাগ্ৰত পাবলিক, আপনারা শুনছেন?
হুনলাম।
শুধু শুনবেন? ব্যবস্থা নিবেন না?
অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।
সামান্য হুটাপুটির পরেই চা-ওয়ালা ধরা খেয়ে গেল। তার স্থান হলো ছিনতাইকারীর পাশে। ছিনতাইকারী নিচু গলায় বলল, কিছুক্ষণ রঙতামাশা করে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওস্তাদ কোনো চিন্তা নাই।
চা-ওয়ালা বলল, তুই চুপ থাক বদমাইশ। ওস্তাদ ডাকবি না, আমি তোর ওস্তাদ না।
ছিনতাইকারী আসল এক ওস্তাদ লঞ্চে আছে। তার খোঁজ পাইলে রুস্তম যে আছে নতুন লিডার হইছে হে পিসাব করে লুঙ্গি ভিজায়ে দিবে।
অসল ওস্তাদ কে? উনার নাম আতর। আতর মিয়া।
নাম তো আগে শুনি নাই। ও আচ্ছা আচ্ছা শুনেছি। নাম শুনেছি। সে লঞ্চে কী জন্যে?
আছে কোনো মতলব! আমি জিগাই নাই। দেখা হয়েছে, সালাম দিয়েছি। উনি বলেছেন, ভালো আছ? আমি বলেছি, জি ওস্তাদ।
পীর সাহেব এবং পুলিশ বাহিনী
পুলিশ বাহিনী আগের জায়গাতেই আছে। তাদের সামনে দুটা হারিকেন। একটায় তেল শেষ। দপদপ করছে, যে-কোনো সময় নিভবে। ওসি সাহেব দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকানো বন্ধ করেছেন। কোনো একটা ঘটনা মনে হয় ঘটেছে। ওসি সাহেবের মুখ পাংশুবর্ণ।
আমি বললাম, স্যার কেমন আছেন?
ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। বিরক্ত চোখে তাকালেন। পীর সাহেব বললেন, স্যারের অবস্থা কাহিল। জ্বিন কফিল উনার পিছে লাগছে।
কী করছে সে?
দেয়াশলাইয়ের মাথা ভাঙছে। ভাঙা মাথা এখন স্যারের কানের ভেতরে। জ্বিন কফিলারে আমার মতো ভালো কেউ চিনে না। সে এখন কী করব। শুনেন। ভাঙা মাথার মধ্যে ফায়ারিং করবে। ধুম কইরা আগুন জ্বলবে।
তাহলে তো বেকায়দা অবস্থা।
সাংবাদিক ভাই ধরেছেন ঠিক। অবস্থা বেগতিক। আমি সূরা বাকারা পড়ে ঞ্জিনরে এখনো সামলায়া রাখার চেষ্টা নিতেছি। কতক্ষণ পারব জানি না। দোয়া রাখবেন।
অবশ্যই দোয়া রাখব।
এদিকে জ্বিন খবর দিয়েছে বিরাট ঝড় উঠবে, লঞ্চভুবি হবে। জানমালের বেশুমার ক্ষতি হবে।
দুটি হারিকেনের একটি দপ করে নিভে গেল। ওসি সাহেব চমকে উঠলেন। এতটা কেন চমকালেন বোঝা গেল না।
সাংবাদিক ভাই সাঁতার জানেন?
তা জানি। তবে এই সাঁতারে কাজ হবে না। পীর সাহেব বললেন, সাংবাদিক ভাই অস্থির হবেন না, পানিতে ড়ুবে মৃত্যু এক অর্থে আল্লাহপাকের খাস রহমত।
বলেন কী?
শহীদের দরজা পাবেন। পানিতে ড়ুবে মৃত্যু হলেই শহীদের দরজা। বেহেশতে চলে যাবেন। আপনার সেবার জন্য থাকবে সত্তরজন হুর; গোলমান কতজন পাবেন সেই বিষয়ে কিছু বলা নাই, তবে বেশুমাির পাওয়ার কথা। এখন চেষ্টা করে দেখেন পানিতে ড়ুবে মরুতে পারেন। কি না। কাছে আসেন, কানে কানে একটা কথা বলি।
আমি কাছে এগিয়ে যেতেই ওসি সাহেব ধমক দিলেন, যেখানে আছেন। সেখানে থাকেন। কাছে আসবেন না। আমি তারপরেও এগিয়ে গেলাম। পীর সাহেব ফিসফিস করে বললেন, আমি পানিতে বাপ দেওয়ার ধান্ধায় আছি। ঝাপ একা দিব না, ওসি সাহেবকে নিয়ে ঝাঁপ দিব। বুদ্ধি ভালো করেছি না?
হুঁ।
ইচ্ছা করলে এখনই ঝাঁপ দিতে পারি, অপেক্ষায় আছি।
কিসের অপেক্ষা?
কানের ভেতরে দেয়াশলাইয়ের মাথা ফাটুক মজা দেখি। কানের ভেতরে ফায়ারিং হলে ওসি সাহেব নিজেই পানিতে বাপ দিবে। আমাকে ধাক্কা দিতে হবে না।
ওসি সাহেব বললেন, অনেক কথা হয়েছে, আর না। বিদায়। বিদায়। ওসি সাহেবের গলায় আগের জোর নাই। তিনি খানিকটা পুতিয়ে গেছেন।
ডিরেক্টর শাকুর এবং তার বন্ধু
এই দুজন মূল রঙ্গমঞ্চে অনুপস্থিত। তাদের এক কোনায় বিছানা পেতে আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখা গেল। ডিরেক্টর সাহেবের হাতে মোবাইল ফোন। দুই বন্ধু গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সুলতানার কর্মকাণ্ড দেখছে। মিডলক্লাস মানসিকতার নমুনা। ঝামেলা থেকে দূরে সরে ব্যক্তিগত আনন্দে সময় কাটানো।
আমি চলে গেলাম। একতলার নিচের মালঘরে। দুনিয়ার ড্রাম জড়ো করা। শত শত বস্তা। বস্তায় পানি পড়ছে, ভিজছে। কী আছে বস্তায় কে জানে। লাইফ বেল্ট পাওয়া গেল না।
হিমু ভাই, কিছু খুঁজেন?
আমি চমকে তাকলাম। টিনের ড্রামের উপর যে বসে আছে তাকে চিনলাম না। মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ে নীল গেঞ্জিতে লেখা—
Life starts at forty.
লেখার নিচে নগ্নবক্ষা এক থাই তরুণী। তরুণী চোখ টিপ দিয়ে তাকিয়ে আছে।
ভাইজান আমাকে চিনেছেন?
আমি আতর। এখন চিনেছেন? আতর মিয়া।
চিনলাম। গেঞ্জি তো পরেছ জবরদস্তি। আতর মিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, এই জিনিস মানুষ পরে! বাধ্য হয়ে পরেছি। লোকজন আমার দিকে তাকায় না গেঞ্জির মেয়েটার দিকে তাকায়ে থাকে। আমারে কেউ চিনে না।
তুমি পলাতক?
জে। র্যাবের হাত থেকে বাঁচার জন্য সুন্দরবন চলে যাচ্ছি। মাসখানিক থাকব। র্যাব ঠান্ডা হলে ফিরব। আমাদের কাছে খবর আছে মাসখানিকের মধ্যে র্যাব ঠান্ডা হবে।
সুন্দরবনে যে যােচ্ছ তোমাকে তো বাঘে খেয়ে ফেলবে।
ক্রসফায়ারের চেয়ে বাঘ ভালো। হিমু ভাই! সুন্দরবন যাবেন? সপ্তাহখানিক থাকলেন। ফরেস্টের বাংলোয় থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। ফরেস্টের লোকজন দেখভাল করে। তাদের আদর যত্নও ভালো। ফ্রেশ হরিণের মাংস সাপ্লাই করে। ব্ল্যাব বাঁ পুলিশ যখন আসে তখন বনবিভাগ এডভান্স খবর দেয়। আমরা ডিপ ফরেস্টে চলে যাই।
তুমি কি আগেও ছিলে সুন্দরবনে?
কয়েকবার ছিলাম। র্যাবের যন্ত্রণায় মাঝে মধ্যে যেতে হয়। হিমু ভাই! আপনাকে পেয়েছি। এখন আর ছাড়ব না। সেবা করব। আপনাকে সেবা করা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি বললাম, হরিণের মাংস ছাড়া সুন্দরবনে আর কী পাওয়া যায়?
ফ্রেন্স চিংড়ি খাবেন। চাষের চিংড়ি না। ভাঙ্গন মাছ আস্ত ভেজে দিবে। মাখনের মতো মোলায়েম। সামুদ্রিক রিটা কখনো খেয়েছেন? সামুদ্রিক রিটা খাবেন, সারা জীবন মনে থাকবে। হিন্দু এক বাবুর্চি আছে। নাম হরি ভট্টাচার্য। তার হাতে হরিণের মাংস অপূর্ব। মাংসটা মধু দিয়ে মাখায়ে দুদিন বাসি করে তারপর রান্না। আহা কী জিনিস! হিমু ভাই। এখন বলেন, লঞ্চে আপনার কোনো সেবা লাগবে? সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চের দখল নিব।
একা?
আমারে চিনেন না হিমু ভাই? আমার কি দোকা লাগে? টাকা নিয়ে তিন আনসার পালায়েছিল। এদের ধরে টাকা উদ্ধার করেছি। তিনটাকে বাথরুমে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছি। ওসি সাহেবকে পঞ্চাশ হাজার দিয়েছি। উনি আর শব্দ করবেন না। ঝিম ধরে থাকবেন। রুস্তম নামে একটা ফালাফালি করতেছে, তাকে একটা থাবড়া দিয়ে কনট্রোল নিজের হাতে নিব। তার আগে বলেন, আপনার কোনো সার্ভিস লাগবে?
না।
আমাকে শুধু একটা খবর দেন, লঞ্চটা কি ড়ুববে? লঞ্চ ড়ুবে যাবে, আপনে এডভান্স খবর পাবেন না-এটা কখনো হবে না।
লঞ্চ ড়ুববে।
আতর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সামান্য সমস্যা হয়ে গেল। যাই হোক অসুবিধা নাই। আপনি আছেন কোথায়?
কেবিনে। কেবিন নাম্বার চার।
পাঁচ নাম্বার কেবিনে ফুর্তি করার জন্য এক হারামজাদা মেয়ে নিয়ে আছে। খবর পেয়েছেন?
হুঁ।
জাতি কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল করেছেন?
হুঁ।
লঞ্চ ড়ুবে গেলে সেটা সম্ভব হবে না।
আমি বললাম, এরা দুজন দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আপাতত এদের বের করার ব্যবস্থা করো।
আতর বলল, চলেন যাই। বের করি। হালকা পাতলা দরজা। এক লাখি দিলেই ভেঙে হবে চাইর টুকরা।
আতর আমার সঙ্গে কেবিনের দিকে রওনা হলো। এখন আতর প্রসঙ্গে বলি। বায়তুল মোকাররমের সামনে আতর মিয়ার একটা আতর এবং তসবির দোকান আছে। দোকানোর নাম–
দি নিউ মদিনা আতার হাউস
দি নিউ মদিনা অতির হাউসে কাটনে করে ছোটখাটো অন্ত্রের লেনদেন হয়। আতর মিয়ার সব অ্যাসিসটেন্টের নাম পুলিশের সন্ত্রাসী তালিকায় আছে। আতরের নাম নেই। আতর মিয়ার কথা হচ্ছে-কোনো ইনসান আমার হাতে খুন হয় নাই। মানুষ হলেই ইনসান হয় না। মানুষের মতো দেখতে অনেক হায়ওয়ান ঘুরে বেড়ায়। এরা অফ হয়ে গেলে জগতের উপকার হয়।
আতর মিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়ের কাহিনীতে কোনো নাটকীয়তা নাই। সময় পেলে সেই গল্প করব। আজ সময় নেই। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
আচ্ছ, ঠিক আছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই গল্পটা করি। সেদিনও এরকম ঝড়বৃষ্টি। মানুষের যেমন ডিপ্রেশন হয় সাগর-মহাসাগরেরও ডিপ্রেশন হয়। বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেশন। সাত নম্বর বিপদ সংকেত। ঢাকায় বৃষ্টি, দমকা বাতাস। কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজালাম। বৃষ্টির পানি বরফের চেয়েও ঠান্ডা। শরীর হিম হয়ে গেছে। এক কাঁপা গরম চা খেতে পারলে ভালো হতো। চায়ের দোকানের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি—দি নিউ মদিনা আতর হাউস থেকে একজন হাতের ইশারায় আমাকে ডাকল। কাছে গেলাম। সেই লোক সন্দিগ্ধ চোখে আমাকে দেখতে লাগল। একসময় বলল, আপনার পাঞ্জাবি হলুদ?
আমি বললাম, হ্যাঁ বৃষ্টিতে ভিজে কমলা হয়ে গেছে।
বুঝতে পারছি। দূর থেকেই নিউ মদিনী হাউস দেখা যায়। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন কেন?
গরম চা খুঁজছি।
হুঁ। হয়েছে। গরম চা। পেমেন্ট নিয়ে যান। ঘরে ঢুকেন।
আমি ঘরে ঢুকলাম। লোক গলা খাকারি দিয়ে বলল, আমার নাম আতর মিয়া। আপনার সঙ্গে আগে মুখোমুখি দেখা হয় নাই। আজ দেখা হলো। আপনাদের সঙ্গে ব্যবসা করে আরাম পেয়েছি। এই প্যাকেটে দুই লাখ পঁচিশ আছে। আমি গুনে দিয়েছি তারপরেও শুনে নিন।
আমি টাকা গুনতে পারি না। আপনি গুনেছেন এই যথেষ্ট। বেশি গুনালে টাকা কমে যায়।
আতর মিয়া বলল, টাকার প্যাকেটটা পলিথিন দিয়ে মুড়ে দেই। পকেটে রেখে দিন, বৃষ্টিতে ভিজিবে না।
আমি বললাম, আমার পাঞ্জাবির পকেট নাই।
পকেট নাই কেন?
পকেট থাকলেই পকেটে টাকা-পয়সা রাখতে হয়। দিগদারি। আমি দিগদারি পছন্দ করি না।
করেন দিগদারির কাম আর দিগদারি পছন্দ করেন না?
আমি বললাম, গরম এক কাপ চা খাওয়ান আমি চলে যাব। টাকা থাকুক আপনার কাছে।
টাকা নিবেন না?
না।
কবে নিবেন?
টাকা আমার না, আমি নিব না। যার টাকা সেও নিবে না। সে ধরা খেয়েছে। এটা আমার অনুমান।
টাকা আপনার না?
সাংকেতিক কথা গরম চা কীভাবে বলেছেন?
এমনি বলেছি। মনে এসেছে বলেছি।
গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি গরম চা বলেন কী? পিয়েন্টে পয়েন্টে মিলে গেছে।
আতর মিয়া বিম ধরে গেল। আতর মিয়া একটি কথাও বলল না। চা আনল। চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। তখন তার মোবাইলে একটা টেলিফোন এল। সেইশারায় আমাকে দাঁড়াতে বলল। আমি দাঁড়ালাম। টেলিফোন শেষ করে আতর বলল, আপনার কথা সত্য। উনি ধরা খেয়েছেন।
আমি বললাম, পুরুষের জন্মই হয়েছে ধরা খাওয়ার জন্য। কেউ স্ত্রীর হাতে ধরা খায়, কেউ পুত্র-কন্যার হাতে ধরা খায়। কেউ ধরা খায় প্রেমিকার কাছে। আবার কেউ কেউ র্যাবের কাছে ধরা খায়।
আতর মিয়া বলল, আপনি কই থাকেন? আপনার ঠিকানা কী?
কেন?
যোগাযোগ রাখতাম।
কোনো প্রয়োজন নাই। হঠাৎ হঠাৎ আপনার সঙ্গে দেখা হবে সেটাই তো ভালো।
আতরের সঙ্গে পরে আরও দুইবার দেখা হয়েছে। শেষবার দেখা হয় মধ্যরাতে।
মধ্যরাত খুবই বিস্ময়কর সময়। তখন পেত্নী মারে ঢ়িল। মধ্য দুপুর থাকে ভূতের হাতে, মধ্য রাত পেত্নীর হাতে।
পেত্নী টিল মারতে থাকুক আমি ঘটনাটা বলি। কাওরান বাজারের সামনে দিয়ে আসছি। মাছের আড়াতে এক বেচারি বলল, হিমু ভাই না? যান কই?
আমি বললাম, কোথাও যাই না। হাঁটতে বের হয়েছি।
একটা ইলিশ মাছ নিয়া যান। আজ ভালো ইলিশ আসছে। দেড় কেজি, দুই কেজি।
ইলিশ মাছ দিয়ে আমি করব কী?
ভাইজা খাবেন আর কী করবেন। টাটকা ইলিশ। এমন টাটকা ইচ্ছা করলে কঁচাও খাইতে পারেন। কঁচা ইলিশ কোনোদিন খাইছেন?
না।
আমার অনুরোধ রাখেন, একটা পিস হইলেও কাঁচা খায়া দেখেন। লবণের ছিটা দিবেন, কাগজি লেবু চিপ্যা লেবুর রস দিবেন। কচকচায়া খাবেন। এই হিমু। ভাইরে সবচেয়ে বড় মাছটা গাঁইথা দে।
আমি বিশাল এক ইলিশ হাতে নিয়ে হাঁটছি। আমার পেছনে পেছনে দুটা কুকুর আসছে। রাজধানীর কুকুর বলশালী হয়। এরা যথেষ্ট বলশালী। হাঁটার মধ্যে জংলিভাব আছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লে ওরাও খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি বললাম, তোরা কি কাঁচা ইলিশ খাবি?
দুজনই ঘড়ঘড় শব্দ করল। কুরের ভাষা বুঝত না পারার কারণে কী বলল বুঝতে পারলাম না।
আরও খানিকটা এগুতেই মাইক্রোবাসের লেখা পেলাম। মাইক্রোবাসের ইঞ্জিনের কোনো সমস্যা হয়েছে। ড্রাইভার বনেট খুলে ইঞ্জিন ঠিক করার চেষ্টা করছে।
ড্রাইভারের পাশে চিন্তিত মুখে শুটিকা টাইপের এক লোক টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ একটু পরপর নিভে যােচ্ছ। আমি তাদের পাশে দাঁড়ালাম। কুকুরের ঘড়ঘড় শব্দ শুনে দুজনই ফিরে তৃ কাল।
মাইক্রোবাসের ভেতর অত্যন্ত বলশালী একজ বসা। সে ঘাড় সোজা করে বলল, এই লোক কী চায়?
আমি বললাম, আমি কিছু চাই না। আপনার গাড়ি থেকে কড়া আতরের গন্ধ আসছে। আমার কুকুর দুটা আ ক্লার গন্ধে অস্থির হয়ে গেছে।
কুকুর দুটা একসঙ্গে কলজে, শুকিয়ে যাওয়ার মতো আওয়াজ করল। টর্চ হাতে ড্রাইভারের পাশের লোক হঠাৎ দৌড় দিল। তার দেখাদেখি ড্রাইভার। কেউ দৌড়ালে জংলি কুকুর তার পেছনে পেছনে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। দুটা কুকুরই ছুটে গেল। একজন শুটকা লোক কে কামড়ে ধরলে, আরেকজন ড্রাইভারকে। তাদের চিৎকার শুনলাম, বাঁচান আমাদের বাঁচিন।
আমি ডাকলাম, তোরা ফিরে আয়। শুটিকা লোক ফুটপাতে পড়ে রইল। কুকুর দুটা ফিরে এল।
মাইক্রোবাসে বসা লোক ভীত গলায় বলল, আপনি কী চান?
আমি বললাম, আপনি গাড়ি; বস্তাভর্তি করে কাউকে নিয়ে যাচ্ছেন। যাকে নিয়ে যাচ্ছেন তার গা থেকে আতরের গান্ধ বের হচ্ছে। আমার ধারণা তার নাম আতর মিয়া। আপনার পরিকল্পনা কী? বস্তা বাংলাদেশ চায়না ফ্রেন্ডশিপ বীজ থেকে পানিতে ফেলা? বস্তায় ইট কি ভরা আছে? আপনি তো ভগাই বিরাট ঝামেলায় আছেন। গাড়ি নষ্ট। লোকবলও কমে গেল। সঙ্গে মোবাইল ফোন আছে না? টেলিফোন করে লোক আনবার ব্যবস্থা করুন। অন্য গাড়ি আনুন। এই ধরনের জটিল কাজে সবসময় ব্যাকআপ ব্যবস্থা থাকতে হয়।
গাড়ির ভেতর থেকে ভোঁ ভোঁ শব্দ পাওয়া গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টহল পুলিশ আসতে দেখা গেল। আমি মাইক্রোবাসে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইসাহেব, পুলিশ আসতেছে। আমার মনে হয় আপনার উচিত দৌড় দিয়ে পালানো। আতর মিয়াকে ধরার অনেক সুযোগ পাবেন।
মাইক্রোবাসের দরজা খুলল। ঐ লোক বের হলো। কেড়ে দৌড় দিল। পেছনে পেছনে কুকুর দুটা ছুটে গেল। সেও ধরাশায়ী হলো।
মানুষের বিপদ দেখে পুলিশ এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা ঘটল না। পুলিশ দুজনও উল্টোদিকে দৌড় দিল।
বস্তার ভেতর থেকে আতর মিয়াকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হলো। আতর মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হিমু ভাই। আপনি মানুষ না অন্য কিছু! এখন থেকে আমি আপনার কেনা গোলাম।
কুকুর দুটিাকে ইলিশ মাছ উপহার দিয়ে আমি কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটা দিলাম। মধ্যযুগে মুনিবরা কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটত। যুগের অভ্যাস বদলায় না। এই যুগেও আমি কেনা গোলাম নিয়ে হাঁটছি।
তৃষ্ণার কাছে ফিরে এসেছি
তৃষ্ণার কাছে ফিরে এসেছি। সে ভোল পাল্টেছে। শাড়ির বদলে জিন্সের প্যান্ট, গাঢ় হলুদ রঙের ফুলহাতা জামা। গলায় হলুদ পাথরের মালা। আগেরবার চোখের পাতা নীল ছিল। এখন হলুদ। এর মধ্যে চোখে রঙ করাও শেষ।
মেয়েরা ভয়ঙ্কর দুর্যোগেও সাজ ঠিক রাখতে ভোলে না।
আতর মিয়া আমার সঙ্গে নেই। সে নাকি পাঁচ মিনিট পরে আসবে। রুস্তমকে টাইট দিতে পাঁচ মিনিট লাগবে। পুরো টাইট দিবে না। স্কুর দুই প্যাঁচের টাইট। ঘাঁচ ঘাচং।
আমাকে দেখে তৃষ্ণা কেবিন থেকে বের হয়ে এসে কোমল গলায় বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
জীবনানন্দ দাশ। আমাদের নানানভাবে প্রভাবিত করেছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন?-বাক্যটি নানানভাবে ব্যবহৃত হয়। প্ৰতিবারই শুনতে ভালো লাগে।
আমি বললাম, ভয় লাগছে?
তৃষ্ণা বলল, ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখে ভয় কমেছে। সত্যি কমেছে। আপনি আর যেতে পারবেন না। এখানে থাকতে হবে।
পাশের কেবিনের মেয়ের কান্না থেমেছে?
হ্যাঁ, তবে মাঝে মাঝে ফোঁপানোর শব্দ হচ্ছে। এবং যথারীতি মোরগ ডাকছে।
আমি বললাম, মহা বিপদের সময় পশুপাখি ডাকাডাকি করে শুনেছি, মোরগ মনে হয়। সেই কারণেই ডাকছে।
কেবিনের ভেতর মোরগ আসবে কেন?
তাও কথা।
বাঁ-পাশের কেবিনের দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বের হলেন। তাঁর গায়ে আলজেরিয়া ফুটবল দলের জার্সির মতো ক্লিপিং সুন্টুট। মুখে ফ্রেঞ্চকাটি দাড়ি। ভদ্রলোক ভয়ে চিমশা মেরে গেছেন। তাঁর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িগোঁফ ঝুলে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হচ্ছে বলতে পারেন?
আমি বললাম, ঝড় হচ্ছে।
ঝড় হচ্ছে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমাদের করণীয় কী?
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা ছাড়া তেমন কিছু করণীয় নেই। গণ তওবার আয়োজন হচ্ছে। তওবায় সামিল হতে পারেন। তওবা পড়ানোর জন্যে যোগ্য মাওলানার সন্ধানে কিছুক্ষণের মধ্যে বের হব। ইচ্ছা করলে আপনিও আমার সঙ্গে আসতে?ilo। In Search of Godo-র মতো In Search of মাওলানা।
You are talking nonsense!
অতি সত্য কথা বলেছেন।
লঞ্চ কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য কী করছে? লঞ্চের মালিকপক্ষের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
মালিকপক্ষের এখন আর কেউ নাই। আমরা সবাই মালিক আমাদের এই লঞ্চের রাজত্বে। মালিকের খোঁজখবর না করে একটা কাজ করতে পারেন। কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে একটা দোয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। যা ঘটবে ঘুমের মধ্যে ঘটবে। দোয়াটা হচ্ছে—আল্লাহুমা বি ইছমিকা আমতু ওয়া আহইয়া। এর অর্থ হে আল্লাহু! তোমার নামেই আমি মৃত্যুর কোলে অর্থাৎ নিদ্রায় যাইতেছি এবং জীবিত হইব। তবে এই দফায় জীবিত হওয়ায় সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ফাজলামি করছেন? আমি কে আপনি জানেন? আমি ডক্টর জিলুর খান। হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব লালমাটিয়া।
ঢাকা শহরে এখন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছড়াছড়ি। ধানমণ্ডির কোনো কোনো গলিতে তিনটা-চারটা করে ইউনিভার্সিটি। মাঝারি সাইজের বাড়ি ভাড়া করে। ইউনিভার্সিটি বানানো হয়। বাড়ির গ্যারাজ হয়। ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের অফিস। সেই অফিসে এসি থাকে। বেশির ভাগ সময় এসি থেকে গরম বাতাস বের হয়। ফ্যান চললে ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের আরাম হতো, কিন্তু এসি-তে যে ইজ্জত ফ্যানে তা নেই।
আমি বললাম, স্যার ভালো আছেন? ভেতরে এসে বসুন। লঞ্চ দুলছে, যেকোনো সময় আপনি পড়ে যাবেন। যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা দেখেও ভয় লাগছে। রেলিং ধরে দাঁড়ান।
তুমি কি লঞ্চের কেউ?
জি স্যার। আমি যাত্রীদের চা, পান-সিগারেট এইগুলা কেবিনে কেবিনে দেই। আমাকে কেবিন বয় বলতে পারেন। রাতের খানা কি খাবেন? এনে দিব? মেন্যু হলো—
ডাল-খাসি
ইলিশ মাছ ইলিশ
মাছের ডিম ডিম
সবজি
মসুর ডাল।
ডক্টর জিলুর খান বস্তিওয়ালা ভাইদের ভাষায় চলে গেলেন। খ্যাক খ্যাক করে বললেন, হারামজাদা কেবিন বয়। তুই ফাইজলামি শুরু করেছিস কী জন্যে? যা মালিকপক্ষের কাউকে ডেকে আন।
স্যার! এইটা আমার ডিউটিতে পড়ে না। তারপরেও যেতাম। লঞ্চে মালিক পক্ষের একজন আছেন। তিনি অসামাজিক কর্মে ব্যস্ত আছেন। তাঁকে ডাকার সাহস আমার নাই, কারণ তার সঙ্গে একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। সারেঙ আছেন। উনার ব্রেইন কাজ করছে না। উনি শুধু বলছেন, যার গৈ, চানপুর যার গৈ। যার গৈ কথাটার অর্থ হচ্ছে—চলে যায়। চানপুর যার গৈ অৰ্থাৎ চাঁদপুর চলে যায়। লঞ্চ যখন ড়ুবে যাবে তখন তিনি বলবেন, লঞ্চ যার গৈ। শ্রাবণ যার গৈ মানে হচ্ছে শ্রাবণের দিন চলে যায়।
ডক্টর জিল্লুর খান বললেন, হারামজাদা। থাপড়ায়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দেব।
তৃষ্ণা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। মনে হয় আমার কথাবার্তায় মজা পাচ্ছিল। সে বলল, আপনি অকারণে গালাগালি করছেন কেন?
ডক্টর জিলুর খান বললেন, গালাগালি করা অবশ্যই ঠিক হচ্ছে না। এই কুত্তার বাচ্চাকে আমি লাখি দিয়ে পানিতে ফেলব। সেটাই হবে সঠিক কাজ।
প্রফেসর সাহেব বাক্য শেষ করার আগেই আতর মিয়া কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দরজা কোনটা ভাঙব?
আমি বললাম, পাশেরটা।
আতরের প্রচণ্ড লাথিতে দরজা ভেঙে গেল। কেবিনে চামচিকার মতো এক প্রৌঢ়, তার পাশে সম্পূর্ণ নগ্ন এক তরুণী। তরুণী আচমকা দরজা খোলায় হকচকিয়ে গেছে। গা ঢাকার কাপড় খুঁজছে। এইসব ক্ষেত্রে যা হয়—কাপড় পাওয়া যাচ্ছে না। মার্ফিস ল কাজ করছে। মার্ফি সাহেবের সূত্র বলে, যখন যেটা প্রয়োজন তখন তুমি তা পাবে না। যখন প্রয়োজন নেই, তখন সেই জিনিসই চোখের সামনে পড়ে থাকবে। কেবিনের ভেতর কোনো মোরগ বা মুরগি দেখা গেল না।
অধ্যাপক সাহেব নগ্ন তরুণী দেখে যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। চোখের পাতা ফেলা সাময়িক বন্ধ রেখেছেন।
আমি আমার গায়ের চাদর বের করে প্রৌঢ়ের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, চাদরটা দিয়ে ঢেকে দিন।
আতর মিয়া বলল, ঐ শিয়ালের বাচ্চা বাইর হ। ফুর্তি অনেক হইছে। ফুর্তি শেষ। বাইর হে কইলাম। এক্ষণ বাইর না হইলে ঘেটি চিপ দিয়া বাইর করব।
গাল ভাঙা চামচিকা মানব বের হয়ে এল। আতর মিয়া ভাঙা দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, সিস্টার, শইল ভালোমতো ঢাকেন। কেয়ামত শুরু হইছে। আর আপনে নেংটিা বসা। এইটা কোনো কথা!
প্রফেসর সাহেব, আতর মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি হঠাৎ এসে কী শুরু করছেন! Who are you?
আতর বলল, ঝিম ধইরা খাড়ায়া থাক। কথা বললে থাপ্পড় খাবি।
তুমি চেনো আমি কে?
চিনার প্রয়োজন নাই। কিয়ামতের দিন কেউ কাউরে চিনবে না। আইজ কিয়ামত। আপনি আমারে চিনেন না, আমিও আপনারে চিনি না।
ফ্রেঞ্চকাট বললেন, কেয়ামত হোক বাঁ না-হোক আমাদের ভদ্রতা শালীনতা বজায় রাখতে হবে।
আতর বলল, এই দেখ আমার ভদ্রতা।
প্রচণ্ড থাপ্নড়ের শব্দ হলো। ডক্টর জিল্লুর খান হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকে গেলেন। দৃশ্যটিতে নিশ্চয়ই কিছু হাস্যরস ছিল, তৃষ্ণা হেসে ফেলল। মানুষ ভয়ঙ্কর সময়েও হাসতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনজন রাশিয়ান সৈনিক নাজিদের হাতে ধরা পড়ল। তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। যে কমান্ডার গুলি করার নির্দেশ দিবেন, তিনি হঠাৎ বরফে পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। রাশিয়ান সৈন্য দুজন হো হো করে হাসতে লাগল। তাদের মৃত্যু হলো হাসতে হাসতে।
আতর মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হিমু ভাই! আপনি এই চামচিকারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি একটা চক্কর দিয়া আসি। আইজি রাইতটা যাবে চক্করের উপরে। দুইটা আতরের শিশি পকেটে নিয়া বাইর হইছি, সাথে যন্ত্রপাতি নাই। একটা যন্ত্রের সন্ধান পাইছি। লিঞ্চ মালিকের পোলার লাইসেন্স করা যন্ত্র। ঐটা উদ্ধার করা বিশেষ প্রয়োজন।
আতর মিয়া নিমিষে উধাও হয়ে গেল। আমি চামচিকা মানবকে বললাম, ভাই আছেন কেমন?
চামচিকা মানবের মোবাইল বেজে উঠেছে। রিং টোন হিসাবে আছে মোরগের ডাক। এতক্ষণে মোরগ রহস্যের সমাধান হলো। চামচিকা মানব মোবাইলে বিড়বিড় করে কিছু কথা বলে মোবাইল পকেটে রেখে দিল। তাকে মোটেই বিব্রত মনে হলো না। থলথলে ভূড়ির নাদুসনুদুস প্রৌঢ়। গায়ের পাঞ্জাবিটা সিস্কের। সে যে পান চিবুচ্ছে তা আগে লক্ষ করি নি। মুখ থেকে জর্দার কড়া গন্ধ আসছে। সে আয়োজন করে রেলিং-এর বাইরে পানের পিক ফেলল।
আমি বললাম, আপনার নাম কী?
রশীদ খান।
আমি বললাম, রশীদ ভাই ভালো আছেন?
রশীদ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে থমথমে গলায় বলল, দরজা যে ভেঙেছে সে কে? তার নাম আতর। বায়তুল মোকাররমে তাঁর একটা আতরের দোকান আছে। দোকানোর নাম দি নিউ মদিনা আতার হাউস।
রশীদ বলল, আমি যদি ঐ শুয়োরের বাচ্চার জান কবজ না করি আমার নাম রশীদ খান না। আমার নাম শুয়োর খান।
আমি বললাম, জানি কবজ করে আজরাইল। আপনি কি আজরাইল?
আমি আজরাইল না। আমি গাৰ্মেন্টের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে বাংলাদেশে আজরাইল ভাড়া পাওয়া যায়।
ভাড়াটে আজরাইল দিয়ে কাজ হবে না। ঢাকা শহরের ভাড়াটে আজরাইল কষ্ট্রোল করে আতর মিয়া। আপনার সঙ্গে তো মোরগ টেলিফোন আছে। মোরগ। ফোনে আপনার ভাড়াটে যে-কোনো আজরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাদের জিজ্ঞেস করুন, আতর মিয়াকে চেনে কি না।
আমি কী করব না করব সেটা আমার ব্যাপার। আপনি বলার কে?
আপনার ভালোর জন্য বলছিরে ভাই। আতর মিয়ার বিষয়ে ঠিক ধারণা থাকলে আপনারই সুবিধা। ভুল চাল দিয়ে বিপদে পড়বেন। আতর মিয়ার চড় খেয়ে একজন হামাগুড়ি পর্যায়ে চলে গেল। সে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে। এই যাত্রায় উঠে দাঁড়াতে পারবে এরকম মনে হচ্ছে না।
তৃষ্ণা খিলখিল করে হাসছে। এমন আনন্দময় হাসি শুধু কিশোরীরাই হাসতে পারে।
রশীদ খানের পকেটে মোবাইল ফোন বাজছে। মোরগ কোকার কো করেই যাচ্ছে।
আমি বললাম, ভাই মোরগটা ঠান্ডা করুন। দেরি করলে মোরগ ডিম পেড়ে দিতে পারে। আপনার পরিচিত আজরাইলীদের একজন টেলিফোন করেছে।
আপনাকে বলেছে কে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি জানি।
আমার হাসিতে ভদ্রলোক বিভ্রান্ত হলেন। তৃষ্ণাও খানিকটা বিভ্রান্ত হলো। মানুষকে বিভ্রান্ত করা মজার ব্যাপার। প্রকৃতি এই বিষয়টা সবসময় করে। মানুষকে রাখে বিভ্রান্তির ভেতর।
রশীদ টেলিফোন ধরেছেন। নিচুগলায় কথা বলছেন। নিচুগলার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। তৃষ্ণাও পাচ্ছে, সে চকচকে চোখে বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রশীদ বললেন, আতর মিয়া বলে কাউকে চেনো? একটা চোখ বড়। একটা ছোট। থুতনিতে কাটা দাগ।
জবাবে ওপাশ থেকে কী বলা হলো তা আমরা শুনলাম না, তবে রশীদ খানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, বলো কী! না না, আমি কোনো ঝামেলায় যাব না। ঝামেলায় যাওয়ার আমার প্রয়োজন কী? আচ্ছা রাখি।
রশীদ খান হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আবহাওয়া যথেষ্ট শীতল। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা, তারপরেও রশীদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আমি বললাম, আপনার কেবিনে যে মেয়েটা আছে সে কে?
আমার স্ত্রী।
তাহলে যান, কেবিনে ফিরে যান। ভাবির সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করুন। সময় বেশি নাই, লঞ্চ ড়ুবে যাবে। একসঙ্গে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেওয়ার একটা ব্যাপারও আছে।
রশীদ নড়লেন না। যেখানে ছিলেন সেখানে বসে রইলেন। তার পকেটের মোরগ আবার ডেকে উঠল, কোঁকর কোঁ।
আমি বললাম, আপনার আসল স্ত্রী টেলিফোন করেছেন। টেলিফোন ধরুন। মহা বিপদের বিষয়টা তাকে জানান।
তৃষ্ণ বিক্ষিত গলায় বলল, আপনি কে টেলিফোন করেছেন তা ধরতে পারেন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, মাঝে মাঝে পারি। সবসময় না।
যে টেলিফোন করেছে তার নামও কি বলতে পারেন?
বেশিরভাগ সময় পারি না, তবে এখন বলতে পারব। যে মহিলা টেলিফোন করেছেন তার নাম ময়না।
রশীদ খান ভয়াবহ চমক খেলেন। একবার বড় ধরনের চমক খেলে পরপর আরও দুবার খেতে হয়। এই জন্যেই প্রবচন দানে দানে তিনদান। রশীদ খান দ্বিতীয় চমক খেলেন। আতর আবার ফিরে এসেছে। তার সঙ্গে এক তরুণী। তরুণী ভয়ে আতঙ্কে থারথার করে কাঁপছে।
জোগাড় করেছি। লঞ্চের মালিকের পুলা ডাইল খায়া বমি কইরা বমির উপর পইড়া ছিল। আমি বললাম, পিস্তল কই রাখছেন, বাইর করেন। দেরি করবেন। না। দেরি করলে পেটে পাড়া দিয়া বাকি বমি বাইর করব। বলেই পেটে পাড়া দিলাম। সাথে সাথে জিনিস চলে আসল আমার হাতে। যন্ত্র ভালো, মেড ইন ইতালি।
আমি বললাম, সঙ্গের মেয়েটা কে?
আতর হাই তুলতে তুলতে বলল, এর নাম সীমা। প্রফেসর সাহেবের ছাত্রী। স্যারের সঙ্গে ভ্রমণের জন্য এসেছিলেন। সুযোগ বুঝে লঞ্চের মালিকের ছেলের কেবিনে উনাকে ঢুকায়ে দিল। যে ভ্রমণের জন্যে উনি এসেছিলেন, সেই ভ্ৰমণই উনার হয়েছে। স্যারুের বদলে লঞ্চ মালিকের ছেলে কন্দেরের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন।
সীমা ফুঁপিয়ে উঠল। আতর বলল, সিস্টার! আপনার সারা শরীর বমিতে মাখামাখি। আগে টয়লেটে যান। সাবান দিয়ে ভালোমতো সিনান করে স্যারের কাছে যান। বিদ্যা শিক্ষা নেন।
তৃষ্ণা বিস্মিত দৃষ্টিতে সীমার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা বলল, আপনার কাছে একসাট্রা ড্রেস না থাকলে আমার কাছ থেকে নিতে পারেন। আপনার গা থেকে বমির বিকট গন্ধ আসছে।
আমি বললাম, মেয়েটাকে কাপড় দিয়ে চল আমরা লঞ্চটা ঘুরে দেখি। এখানকার পরিস্থিতি ঠান্ড হোক।
তৃষ্ণা বলল, আপনি না বললেও আপনি যেখানে যাবেন আমি আপনার পেছনে পেছনে যাব। আজ রাতের জন্য আমি হব মেরীর little lamb. লঞ্চ দুলছে। ভীতিকর দুলুনি না, আরামদায়ক দুলুনি। বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। আমি তৃষ্ণকে নিয়ে পরিদর্শনে বের হয়েছি। তৃষ্ণার হাতে খেলনার মতো দেখতে ভিডিও ক্যামেরা। এই মেয়েটির ভয়ডর এখন যে চলে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে। মহা বিপর্যয়ের ছবি তুলতে পারার আনন্দেই এখন সে আনন্দিত।
তৃষ্ণা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, হিমু! আমরা মহা বিপদে আছি, কিন্তু আমার ভালো লাগছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে। আমি স্পিলবার্গের কোনো ছবিতে অভিনয় করছি। ছবির শেষ দৃশ্যে লঞ্চ ড়ুবে যাবে, আমরা দুজন একটা কাঠের মৃত্যুক্ত ধরে ভেসে থািকব।
আমি বললাম, অভিনেত্রী, মন দিয়ে শুনুন। হাঁটার সময় রেলিং ধরে হাঁটুন। আপনার ক্যামেরা কিন্তু ভিজে যাচ্ছে।
এটা ওয়াটারপ্রািফ ক্যামেরা, ভিজলেও কিছু হবে না। স্কুবা ডাইভিং-এ এই ক্যামেরা ব্যবহার হয়।
তাহলে তো কথাই নেই, লঞ্চ যখন ড়ুবে যাবে আপনিও ড়ুববেন এবং তখনো ছবি তুলবেন।
লঞ্চ ড়ুববে না। আমার মন বলছে ড়ুববে না। আমি আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখব। রিডার্স ডাইজেক্ট-এ একটা আর্টিকেলও লিখব। আপনি রিডার্স ভাইজেক্ট পড়েন?
না।
আমার একটা লেখা রিডার্স ডাইজেদ্ষ্টে ছাপা হয়েছিল। Life নামে ওদের একটা সেকশন আছে। সেখানে মজার মজার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঘটনা ছাপা হয়। আমারটাও ছাপা হয়েছিল। একশ ডলার পেয়েছিলাম। শুধু আমার নাম ভুল ছেপেছে। লিখেছে। Tritima, Bangladesh. রিডার্স ডাইজেস্ট্রটা আমার সুটকেসে আছে। আমি আপনাকে পড়তে দেব। পড়বেন তো?
পড়ব।
আপনার প্রবল ESP. ক্ষমতা। তাই না?
জানি না।
আমারও ESP ক্ষমতা আছে। যারা আমার ঘনিষ্ঠ, তারা আমার এই ক্ষমতার বিষয়ে জানে।
জানারই কথা।
আপনি আমার একটা কথাও বিশ্বাস করছেন না। আপনার উপর আমার রাগ লাগছে। এখানে একটু দাঁড়ান। আপনাকে জরুরি কিছু কথা বলব।
এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে আপনি ভিজে যাবেন। বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
আসুক। আমার কথা শুনলে আপনি কিন্তু ভয়ঙ্কর চমকবেন।
অনেকদিন চমকাই না। আপনার কথা শুনে চমকালে ভালো হবে। বড় ধরনের চমক লিভারের জন্য উপকারী।
তৃষ্ণা মুখ কঠিন করে বলল, আমার ESP. ক্ষমতা বলছে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। এই লঞ্চেই বিয়ে হবে। আমি পুরো বিষয়টা স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
কী দেখছেন?
আমি দেখছি লঞ্চ কান্ত হয়ে আছে। একজন বৃদ্ধ আমাদের বিয়ে পড়াচ্ছেন। তার চোখে সুরমা। বৃদ্ধকে দেখামাত্র আমি চিনব। আপনার ঠোঁটের কোণে হাসি। এর অর্থ আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।
অবশ্যই বিশ্বাস করছি। আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি।
তৃষ্ণা বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আপনার বিষয়ে কিছুই জানি না। তারপরেও আপনাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কেন জানেন?
না।
কারণ এই বিয়ে পূর্বনির্ধারিত। সবকিছুই যে পূর্বনির্ধারিত আধুনিক বিজ্ঞান এখন এই সত্য হজম করা শুরু করেছে।
আমি জানতাম না। আমি শুনেছি। Free wil।-এর কথা।
এই বিষয়ে আমরা বাসর রাতে তর্ক করব। বাসর হবে। আমার কেবিনে। আমার কাছে বেলিফুলের দুটা মালা আছে। আরও লাগবে। কী অদ্ভুত কো ইনসিডেন্স! সুটকেসে ফুল আঁকা একটা চাদর আছে। এখন চলুন আমরা বুড়োটাকে খুঁজে বের করি।
চলো।
আমরা বুড়োর সন্ধানে প্রথম গেলাম লঞ্চের সারেঙের ঘরে।
এর আগে সারেঙকে দেখেছি বিছানায় শোয়া। এখন দেখলাম বসা অবস্থায়। সারেঙের চোখ রক্তবর্ণ। সারেঙ তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পরিচিতজনের গলায় বলল, সকিনা! গম আছ নি? চানপুর যার গৈ।
তৃষ্ণা বলল, এই বুড়া না।
আমরা দ্বিতীয় বুড়োর সন্ধানে বের হলাম। এই বুড়ো আমার পরিচিত। তার কাছ থেকে চাদর নিয়েছিলাম। বুড়ো ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। তার দৃষ্টি নিজের হাতের লাঠির দিকে। জাহাজ দুলছে, জাহাজের সঙ্গে বৃদ্ধও দুলছে। মনে হচ্ছে বিশাল রকিং চেয়ারে সে বসা।
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, বাজান! আমার চাদর কই?
আমি বললাম, চাদর জায়গামতোই আছে।
শীত লাগতেছে। চাদরের প্রয়োজন ছিল।
আমি বললাম, ঝড় ঠিকমতো উঠুক, চাদর এনে রেলিং-এর সঙ্গে আপনাকে বেঁধে দিব। যাতে উড়ে গিয়ে পানিতে না পড়েন।
তৃষ্ণা বলল, আপনি কি ইনাকে চেনেন?
আমি বললাম, চিনি। ঝড়টা ঠিকমতো উঠলে জাহাজের যাত্রী সবাই সবাইকে চিনবে।
তৃষ্ণা বলল, আপনাকে অতি জরুরি কথাটাই জিজ্ঞাস করা হয় নি। আপনি কি ম্যারেড?
না।
দেখুন। আমার অবস্থা। বিয়ের সব ঠিকঠাক করে ফেলেছি, অথচ আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি, আপনি ম্যারেড কি না।
আমি বললাম, দুর্যোগের সঙ্গে স্বপ্নের মিল আছে। স্বপ্নে লজিক কাজ করে না। ভয়াবহ দুর্যোগেও লজিক কাজ করে না। দুর্যোগের দৃশ্যগুলিও হয় স্বপ্নের মতো ছাড়াছাড়া।
আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই তো?
না।
আমার বয়স কিন্তু বেশি। আটাশ রানিং। বাঙালি ছেলেরা শুনেছি অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। বাঙালি ছেলেদের অদ্ভুত মানসিকতা। তারা খুবই কমবয়েসী মেয়ে বিয়ে করতে চায় কিন্তু তাদের হতে হবে উচ্চশিক্ষিত। তাদের রূপ হতে হবে রাজকন্যাদের মতো। তাদের বাবার প্রচুর টাকা পয়সা থাকতে হবে। অথচ ছেলে কিন্তু ভ্যাগাবন্ড। আপনি কি ভ্যাগাবন্ড?
হ্যাঁ।
কী যন্ত্রণা! আমি যে জিনিস পছন্দ করি না। সবই আমার কপালে এসে জুটে।
বিয়েটা কি তাহলে বাতিল?
না। বাতিল কী জন্যে হবে? আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাতিল হলে আপনি খুশি হন। পাত্রী হিসেবে আপনি কি আমাকে অপছন্দ করছেন?
না। আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার।
কথাটার মানে কী?
আপনার জন্যে ফুলের মালা গাথার কাজটা আমি আগ্রহ নিয়ে করব।
কার কবিতা?
রবীন্দ্রনাথের।
শুনুন, কখনোই আমার সঙ্গে কবিতা কপচাবেন না। কবিতা হচ্ছে অলসের বিলাস। আমি অলস মানুষ পছন্দ করি না।
আচ্ছা।
তৃষ্ণা বলল, এই মুহূর্ত থেকে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আমিও তুমি করে বলব। এতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
না।
হিমু! তোমার মধ্যে আমি গা ছাড়া ভাব দেখছি কেন? ঠিক করে বলো—গ্ৰী হিসেবে তুমি কি আমাকে পছন্দ করছি না? দয়া করে ঝেড়ে কাশ। আমার একটা গুণ শুনলে তুমি চমকে উঠবে। বলব?
বলো।
বেকারি। আমি ভালো পারি। কোর্স নিয়েছি।
বেকারি কী?
কেক পেষ্ট্রি এইসব বানানো। আমি যে ক্টেটে থাকি সেখানে কুকি বানানোর একটা কম্পিটিশন হয়। কুকি হলো বিঙ্কিট। আমি সেই কম্পিটিশনে অনারেবল মেনশন পেয়েছি।
চমৎকার। ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার।
এর মানে কী?
কবিতার লাইন।
বাঙালিদের রোমান্টিসিজম কয়েক লাইন কবিতা আবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ। আমার জন্যে খুবই বিরক্তিকর। আগে একবার বলেছি, এখন আরেকবার বলছি, দয়া করে। আমার সামনে কবিতা আবৃত্তি করবে না।
করব না।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ খুঁজে পাওয়া গেল। তৃষ্ণা চেঁচিয়ে বলল, ঐ তো উনি! আমি ইনাকেই স্বপ্নে স্পষ্ট দেখেছি।
তৃষ্ণা দেখাচ্ছে খুনের আসামি পীর কুতুবিকে। আমি বললাম, উনার হাতে হাতকড়া পরানো। স্বপ্নেও কি তাই দেখেছি?
স্বপ্লে হাতকড়া দেখি নি। হাতকড়া কেন?
উনি তিনটা খুন করেছেন। তাঁকে বরিশাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। আমি উনার একটা মিনি ইন্টারভ্যু নিতে চাইলে উনি কি রাজি হবেন?
অবশ্যই রাজি হবেন। ইন্টারভুদ্য দেওয়ার জন্যে উনি মুখিয়ে আছেন।
আমাদের বিয়ের কাজি হবেন কি না তা আগে জেনে নেই?
জানি না।
তৃষ্ণ পীর সাহেবের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, আচ্ছা শুনুন। আপনি কি একটা বিয়ে পড়াতে পারবেন? আমরা দুজন বিয়ে করব, কাজি পাচ্ছি না।
পীর সাহেব বললেন, বিয়ে পড়াতে পারব। কিন্তু এখন পারব না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিয়ে পড়ানো যায় না। এই মোসালা অনেকেই জানে না। ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, ঝড়-তুফান-এসবের মধ্যে বিয়ে হবে না।
কেন?
এগুলা হচ্ছে রোজ কেয়ামতের ছোট ছোট নমুনা। রোজ কেয়ামতে যেমন বিয়ে হবে না, এখনো হবে না। ঝড়তুফান কামুক, বিয়ে পড়ায়ে দিব! দেনমোহর ঠিকঠাক করুন। আপনার হাতে ক্যামেরা না?
জি।
এই রকম একটা ক্যামেরা আমার স্ত্রীর ছিল। শৌখিনদার মেয়ে ছিল। খামাখা ছবি তুলত। জ্বিন কফিল যখন তারে খুন করে তখনো তার হাতে ক্যামেরা। আমার স্ত্রী ছবি তোলার মধ্যে ছিল। জ্বিন কফিল তার ঘরে ঢুকেছে। এইটাও সে ক্যামেরায় ধরেছে। আজিব মেয়েছেলে।
তৃষ্ণা কিছু বুঝতে না পেরে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, জ্বিন কফিলের বিষয়টা তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।
পীর সাহেব বললেন, এই দুনিয়ায় কিসিম দুইটা। জ্বিন এবং ইনসান। বুঝায়। বলার কিছু নাই।
আমি বললাম, আপনার স্ত্রীর ক্যামেরায় কি জিনের ছবি উঠেছে?
উঁহু, আমার ছবি উঠেছে। জ্বিন আমার রূপ ধরে তার ঘরে ঢুকেছে। জিনের এই ক্ষমতা আছে। আপনারা দুজন এখন যান, এশার নামাজের সময় পার হয়ে গেছে। এখন নামাজ আদায় করব। সামান্য দেরি হয়েছে। ওসি সাহেবের কানে ফায়ারিং হবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। ফায়ারিং এখনো হয় নাই। মন বলতেছে নামাজে দাঁড়াব আর ফায়ারিংটা হবে। জ্বিন কফিলের বদমাইসি। একটা মজার জিনিস দেখতে চাই, সে আমারে দেখতে দিবে না।
তৃষ্ণা বলল, ফায়ারিং কী? ইনার কথাবার্তা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাতাসের প্রবল ধাক্কায় লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়ে গেল। পীর কুতুব বিকট ধ্বনি দিলেন-আল্লাহু আকবর!
ঝপাং শব্দ হলো, পীর কুতুবি ওসি সাহেবকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুলিশদের মধ্যে যে ব্যাপক চাঞ্চল্য আশা করেছিলাম, তা দেখা গেল না। একজন শুধু পানিতে ছয় ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোও নিভে গেল। টর্চ বৃষ্টির পানিতে ভিজেছে। কিছুক্ষণ আলো দিয়ে সে নিভে যাবে এইটাই নিয়তি।
ঘটনার আকস্মিকতায় তৃষ্ণা হতভম্ব। সে বিড়বিড় করে বলল, এরা তো ড়ুবে যাবে।
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পীর কুতুবি ড়ুববেন না। তিনি ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মোহনা পার হবেন। ওসি সাহেব ড়ুবে যাবেন। আমার ধারণা এর মধ্যে ড়ুবেও গেছেন।
তৃষ্ণা বিড়বিড় করে বলল, কী সর্বনাশ!
আমি বললাম, সর্বনাশ তো বটেই। তোমার কাজিও কিন্তু ভেসে চলে যাচ্ছে। কাজি যার গৈ। কাজি যার গৈ।
যারা গৈ যারা গৈ করছি কেন?
যারা গৈ হচ্ছে ভেসে চলে যাচ্ছে।
তাতে তোমার এত আনন্দ কেন? মুসলমানদের বিয়েতে কাজিও লাগে না। আমি বইতে পড়েছি কবুল কবুল বললেই হবে।
তৃষ্ণর কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির শব্দ হলো।
পুলিশ চারজন লাফ দিয়ে উঠল। তাদের মুখ ফ্যাকাসে। গুলি কী বস্তু পুলিশ সবচেয়ে ভালো জানে। গুলির শব্দে আতঙ্কে তারাই সবার আগে অস্থির হয়।
তৃষ্ণা বলল, গুলি কোথায় হয়েছে?
পুলিশের একজন বলল, আমার বন্দুক থেকে মিস ফায়ার হয়ে গেছে ম্যাডাম।
তৃষ্ণা বলল, আপনা-আপনি গুলি হয়ে গেছে মানে কী? মানুষ মারা যেতে পারত।
যার বন্দুক থেকে গুলি হয়েছে সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আল্লাহপাকের হুকুম ছাড়া কারও মৃত্যু হবে না। আপা। চিন্তার কিছু নাই।
আমরা তাকিয়ে আছি কুতুবির দিকে। কুতুবি কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চের আড়ালে চলে গেলেন।
পুলিশদের একজন হাঁপ ছাড়ার মতো করে বলল, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা!
লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এখন আতর মিয়ার হাতে
লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ এখন আতর মিয়ার হাতে। তার ক্ষমতার উৎস ভীত এবং ক্ষুধার্ত যাত্রী। বিপদে মানুষের ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তি কমতে থাকে। লঞ্চ ডানদিকে কাত হয়েছে, যে-কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। সেদিকে নজর না দিয়ে যাত্রীরা খেতে বসে গেছে। আজ রাতের খাওয়া ফ্রি। আতর মিয়ার সে রকমই নির্দেশ! খাওয়া নিয়ে ভালো হৈচৈ হচ্ছে। নতুন করে ডিম ভাজা হচ্ছে। অনেকেই ডিম ভাজা খাবে। কাঁচামরিচে ঝাল নাই কেন—এই নিয়েও তৰ্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বেঞ্চে সবার জায়গা হয় নি। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতে প্লেট নিয়ে খাচ্ছে! মুরগির গিলা-কলিজার একটা লুকানো হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই নিয়ে উল্লাস হচ্ছে। যাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, তারাও এক হাতা করে গিলা-কলিজা নিচ্ছে।
এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফাঁসির আসামিরাও শেষ খাবার আগ্রহ নিয়ে খায়। কোন আইটেম কীভাবে রাঁধতে হবে তাও বলে দেয়। সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ মাছ অল্প আঁচে কড়া করে ভাজতে হবে। মাছ থেকে যে তেল উঠবে সেই তেল এবং সরিষার তেল আলাদা করে বাটিতে দিতে হবে। ইলিশ মাছের সঙ্গে রসুনের কোয়া থাকতে হবে।
ক্ষমতাচুত রুস্তম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার দৃষ্টি আতর মিয়ার দিকে। আতর মিয়া তার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আবার পকেটে রেখে দিয়েছে। রুস্তম বুঝতে পারছে না পিস্তলটা আসল নাকি খেলনা। আজকাল খেলনা পিস্তলগুলি অবিকল আসলের মতো বানাচ্ছে। হাতে না নেওয়া পৰ্যন্ত আসল নকল বোঝার উপায় নেই। রুস্তমের কাছে মনে হচ্ছে নকল। নকল না। হলে পকেটে লুকিয়ে রাখত না। সারাক্ষণ হাতে রাখত।
নতুন কোনো চাল দিয়ে আতর মিয়ার হাত থেকে ক্ষমতা কীভাবে নেওয়া যায় তা-ই রুস্তমের একমাত্র চিন্তা! মাথায় তেমন কোনো বুদ্ধি আসছে না।
লঞ্চের রেস্টুরেন্টের সামনে কিছু জায়গা খালি করা হয়েছে। এটাই এখন মঞ্চ বাঁ জনতার আদালত। মঞ্চে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আতর মিয়া।
আতর বলল, ভাইব্রাদার সবাই মন দিয়ে শুনেন। আমরা মহা বিপদে আছি। মাইনাস টু ফর্মুলা ঘটে গেছে। পীর সাহেব এবং ওসি সাহেব পানিতে পড়ে গেছেন। আপনারাও প্রস্তুত হয়ে যান। লঞ্চ অচল। শুরু হয়েছে ঝড়। এই ঝড় এখনো পাতলা। পাতলা ভাব থাকবে না। ঘন হবে। একতলায় বড় বড় সেগুন কাঠের টুকরা আছে। সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করবেন। দুজন দুজন করে একটা টুকরা বেছে নিবেন। হামলা হামলি বন্ধ। এক টুকরা পানিতে ফেললাম, পঞ্চাশজন তাতে ঝাপায়ে পড়বেন—তা হবে না। ক্লিয়ার?
কেউ কোনো শব্দ করল না।
রুস্তম বলল, আমার একটা কথা আছে।
আতর বলল, কী কথা?
আপনি এক নির্দেশ দিবেন, সেই নির্দেশে সবাই কাজ করবে তা তো হবে না। একটা কমিটি হবে। নির্দেশ যাবে কমিটির মাধ্যমে।
কমিটিটা করবে। কে?
জনগণ করবে। কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে একজন থাকবে, বিএনপির একজন থাকবে। সুশীল সমাজ থেকে একজন থাকবে। নকল পিস্তল নিয়ে ফলাফলি করলে নেতা হওয়া যায় না।
আতর বলল, চুপ! আরেকটা শব্দ করলে গুল্লি। এই দেখা পিস্তল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখ আসল। আমি নকলের কারবার করি না।
গুলি করবেন?
অবশ্যই করব। আমার চোখের দিকে তাকা। তাহলেই বুঝবি আমি যা বলি স্বতা-ই করি; যা বলি না। তাও করি।
রুস্তম সমর্থন আদায়ের জন্যে এদিক-ওদিক তাকাল। সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। সমর্থন পাওয়া গেল না। রুস্তম বলল, আপনি আপনার মতো কাজ করেন। আমি লঞ্চের ডেকে আছি। তেমন কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন।
আতর বলল, কানো ধর। কানে ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যা। আর আসবি কানো ধরব?
কানে ধরব।
অবশ্যই কালে ধরবি।
যাত্রীদের একজন বলল, কানো ধরতে বলছে কানে ধরে চলে যান। ঝামেলা করেন কী জন্য? আছি বিপদে এর মধ্যে শুরু করেছেন ঝামেলা।
যাত্রীদের একটা বড় অংশ বলল, কানো ধরা। কানো ধর।
রুস্তম কানে ধরতেই হো হো হাসির শব্দ উঠল। বিপদের সময় ছোটখাটো মজাও অনেক মজাদার মনে হয়। কানে ধরে লিডারশ্ৰেণীর একজন মানুষ যাচ্ছে। দেখতেই ভালো লাগছে। একজন হাততালি দিল। তার দেখাদেখি অন্যরাও হাততালি দিতে লাগল।
আতর মিয়া হুঙ্কার দিল, হাততালি দেওয়ার মতো কিছু হয় নাই। বলেন, আল্লাহু আকবার। গলার ব্লগ ফাটায়ে চিৎকার দিবেন।
বিকট চিৎকার শোনা গেল, আল্লাহু আকবার!
আতর বলল, এই লঞ্চে কিছু দুষ্ট লোক আছে। এইসব দুষ্ট লোকের কারণে আল্লাহপাক আমাদের উপর নারাজ হয়েছেন। দুষ্টরা সবাই এক এক করে আসবে। জীবনে বড় পাপ কী করেছে নিজের মুখে বলবে। তারপর তওবা করবে। রাজি?
বিকট আওয়াজ উঠল, রাজি।
সবার আগে আমরা প্রফেসর সাহেবকে দিয়ে শুরু করব। প্রফেসর সাহেব চার নম্বর কেবিনে আছেন। তাকে ধরে নিয়ে আসেন। কেবিনের সব যাত্রী এখানে চলে আসবে। আজি সব এক। কেবিনের যাত্রী ডেকের যাত্রী বলে কিছু নাই। পূর্ণ সমাজতন্ত্র। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই বলল, আলহামদুলিল্লাহ।
আতর বলল, মহা বিপদে লিড়ার লাগে। একজন। দুই-তিনজন লিডার মানে দুই-তিন রকম চিন্তাভাবনা। মহা বিপদে আমাদের একটাই চিন্তা—বাঁচতে হবে। ] চিৎকার দিয়ে বলেন, বাঁচতে হবে।
লঞ্চ কঁপিয়ে চিৎকার, বাঁচতে হবে! চিৎকারের কারণেই হয়তো লঞ্চ ডানদিক থেকে বাঁ দিকে কত হলো।
অধ্যাপক ডক্টর জিলুর খান পিএইচডি (গ্লাসগো) হতাশ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তাঁর ফ্রেঞ্চকািট আগেই খানিকটা ঝুলে ছিল, এখন আরও স্কুলে পড়ল। দুজন তাঁকে দুপাশ থেকে ধরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল।
জিলুর খান বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা আমার কাছে কী চান।
আতর মিয়া বলল, বড় বড় পাপ কী করেছেন সেটা বলবেন। তারপর তওবা করবেন।
Why?
সমাজের এইটাই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত না মানলে লিখি দিয়ে পানিতে ফেলে। দেওয়া হবে। এইটাও সমাজের সিদ্ধান্ত।
সমাজটা কী? আমরাই সমাজ। দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি বলেন।
আমি অপরাধ করার মানুষ না। টুকটাক মিথ্যা হয়তো বলেছি, এর বেশি কিছু না।
এর বেশি কিছু না?
অবশ্যই না।
তাহলে স্যার কিছু মনে করবেন না। আপনাকে এখন আমি লাখি দিয়ে পানিতে ফেলব। কেউ যেন মনে না করে সমাজ একজন নির্দোষ মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে। এই জ্ঞানী প্রফেসর অসামাজিক কার্যের জন্য তার এক ছাত্রী নিয়ে এসেছে। ছাত্রী নিজের মুখে কী ঘটনা ঘটেছে বলবে, তারপর সমাজ সিদ্ধান্ত নিবে। ছাত্রীর নাম সীমা। সীমা সিস্টার উপস্থিত আছেন। সিস্টার আসেন কিছু বলেন।
সীমা আতরের কাছে এগিয়ে গেল।
আতর বলল, আপনার ভয়ের কিছু নাই। আপনি আপনার স্যারের ফান্দে পড়েছেন। ভুল করেছেন। এখন বলেন। আপনি কি ভুল করেছেন?
সীমা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আমরা যদি প্রফেসর সাহেবকে পানিতে ফেলে দেই আপনার আপত্তি আছে? সীমা চুপ করে রইল।
আতর বলল, সিস্টার, আমরা আপনার স্যারকে দুদিক থেকে ধরে রাখব। আপনি ধাক্কা দিয়ে আপনার স্যারকে পানিতে ফেলবেন। পারবেন না?
সীমা ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। আতর বলল, চোখ বন্ধ করে পীর বদরের নামে এক ধাক্কা। যাত্রীরা মহা উৎসাহে বলা শুরু করল, ধাক্কা ধাক্কা ধাক্কা।
ডক্টর জিল্লুর বললেন, এটা কোনো মগের মুলুক না। এখানে বিচার-আচার আছে। ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া কোনো বিচার না।
আতর বলল, সাঁতার জানেন না। স্যার?
না।
পানিতে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। আপনি পানিতে নেমে সাঁতার শিখবেন। মাইনাস টু ফর্মুলা আপনাআপনি হয়েছে। আপনাকে দিয়ে হবে মাইন্যাস থ্রি ফর্মুলা।
যাত্রীরা মহা উৎসাহে চিৎকার শুরু করল, মাইনাস থ্রি। মাইনাস থ্রি।
ডক্টর জিলুর বললেন, এখানে বিচক্ষণ কেউ আছেন যিনি মাস হিস্টরিয়া বন্ধ করতে পারেন? প্লিজ হেলপ। প্লিজ।
তৃষ্ণা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। আতর মিয়া তোমার কথা শুনবে। আমি বললাম, এখনো সময় হয় নি।
তৃষ্ণা বলল, সময় কখন হবে? পানিতে ফেলে দেওয়ার পর?
হতে পারে।
মানুষ ধরে ধরে পানিতে ফেলবে। আর তুমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?
আমি বললাম, মানুষের একটাই ভূমিকা। দর্শকের ভূমিকা। প্রকৃতি মানুষকে তৈরি করেছে শুধুই দেখার জন্যে। আশেপাশে নানা ঘটনা ঘটবে, সে দেখবে।
তৃষ্ণা বলল, মানুষ ঘটনায় অংশগ্রহণ করবে না?
না করাই বাঞ্ছনীয়।
কোঁকর কোঁ করে মোরগ ডেকে উঠল। আমরা চমকে তাকালাম। রশীদ খানকে ধরে আনা হয়েছে। তার পকেটের মোরগ ডেকেই যাচ্ছে।
রশীদ বুদ্ধিমান মানুষ। কী ঘটনা আঁচ করতে পারছে। ধনবান মানুষরা নিজের ধন রক্ষা করার প্রবণতাতেই সর্ব সমস্যায় আপোষে চলে যায়। রশীদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে কী জন্যে ডেকেছেন বলুন।
আতর বলল, আপনি সারা জীবনে যা যা পাপ করেছেন এইসব আমরা শুনব।
রশীদ খান বললেন, আপনারা ভালো কথা শুনবেন। খারাপ কথা কেন শুনবেন? বরং আপনি দুটা ভালো কথা বলেন আমরা শুনি।
আতর খানিকটা হকচকিয়ে গেল। রশীদ খান বললেন, লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে এরকম একটা গুজব উঠেছে। এই গুজবের কারণে সবার মাথা এলোমেলো। লঞ্চ সত্যি সত্যি ড়ুবে গেলে আমরা কীভাবে সবাই বাঁচব এখন সেই চেষ্টা করা উচিত। কে কী পাপ করেছে এইসব নিয়ে আলোচনা না। পাপ তো সবাই করে। কেউ ছোট পাপ, কেউ বড় পাপ। পাপের বিচারের মালিক তো আপনি না। বিচার হবে রোজহাশরে। ঠিক বলেছি?
ড. জিলুর উঁচু গলায় বললেন, অবশ্যই ঠিক বলেছেন। Right words at the right time.
রশীদ খানের পকেটে আবারও কোঁকর কোঁ শুরু হয়েছে। তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, যা ব্যাট পানিতে ড়ুবে কোঁকর কোঁ করতে থাক।
তার এই নাটক ভালো কাজ করল। দর্শকদের অনেকেই হেসে উঠল। বোঝা যাচ্ছে রশীদ খান তার দিকের পাল্লা ভারী করছেন। মাস সাইকোলজি বলে, মহা বিপদে জনতার সিদ্ধান্ত অতি ক্ষুদ্র ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে বদলায়। বড় বড় ঘটনায় তেমন কিছু হয় না। মোবাইল পানিতে ফেলে দেওয়া ক্ষুদ্র ঘটনা কিন্তু তার প্রভাব বড়।
রশীদ খান বললেন, আমাদের মহা বিপদ। এর মধ্যে এক ভাইকে দেখি বন্দুক নিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। একে পানিতে ফেলবেন তাকে পানিতে ফেলবেন বলে হামকি-ধামকি। আরে ভাই, বন্দুক কি আপনার একার আছে? অন্যের নাই? আমি চারটা গার্মেন্টসের মালিক। আমি কোনো প্রকেটশন ছাড়া লঞ্চে উঠব? হামজা কই?
হামজা এগিয়ে এল। বাংলা সিনেমার ফাইটারদের মতো তার চেহারা। মাথা চকচক করে কমানো। গলায় রুমাল বাধা। পরনে জিন্সের শার্ট-প্যান্ট। রশীদ খান বললেন, আমার বডিগার্ড। এর পকেটে একটা লুগার পিস্তল আছে। পিস্তলটা আমার। লাইসেন্স করা। হামজা, পিস্তলটিা বের করে পাবলিককে দেখা।
হামজা ওস্তাদের আদেশ মান্য করল। ফ্যাসফ্যাস গলায় বলল, কারো উপর ফায়ারিং করতে যদি হয় ইশারা দিবেন।
রশীদ খান বললেন, এখন খুন-খারাবির সময় না। এখন জানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আমি সবার সহযোগিতা চাই। আপনারা আছেন আমার সঙ্গে?
বিকট ধ্বনি উঠল, আছি! আছি!
শিশু এবং মহিলাদের বাঁচানোর চেষ্টা আগে করতে হবে। টিনের কিছু কাটা ড্রাম আমি লঞ্চে উঠার সময় দেখেছি। শিশুদের এইসব ড্রামে তুলে দেওয়া হবে। তাদের বাবা-মা ড্রাম ধরে ভাসবেন।
রুস্তম আবার উদয় হয়েছে। তার চোখেমুখে আনন্দের ঝালকানি। আহত নেতার প্রত্যাবর্তন।
রশীদ খান বললেন, লঞ্চে আমি বেশকিছু অতি বৃদ্ধ যাত্রী দেখেছি। তাদের বিষয়ে কী করা যায় সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করছি। আপাতত তারা এক জায়গায় গোল হয়ে বসে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকুন। এই দোয়ার কারণে ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন। আমরাও ইনশাল্লাহ লঞ্চের পেট থেকে নাজাত পাব।
আতর মিয়া পিছিয়ে পড়েছে। পিছিয়ে পড়া ছাড়া গতি নাই। তার আবারও উদয় হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়, যদি না বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটে।
ঝড়-বৃষ্টি দুটাই সাময়িক কমেছে। সাময়িক বলছি কারণ আকাশে মেঘের স্তুপ বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাতেই মেঘের স্তুপের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
আমি এবং তৃষ্ণা এখন কেবিনে। কেবিনের দরজা খোলা। বাতাসে ৰূপাং করে একেকবার দরজা আছড়ে পড়ছে। আবার বন্ধ হচ্ছে।
তৃষ্ণা বলল, একের পর এক নাটক হচ্ছে। আমার কী যে অদ্ভুত লািগছে! আমি নিজে এক ঝড়ের কারণে কী পরিমাণ বদলেছি ভেবে অবাক হচ্ছি। কী রকম বদলেছি শুনতে চাও?
চাই।
আমি ক্লাস নাইনে যখন পড়ি তখনই ঠিক করেছি। জীবনে কখনো বিয়ে করুব না। এখন কী আশ্চর্য বর সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি।
বর বলছি কেন? বিয়ে তো এখনো হয় নি!
হয় নি, হবে। যে কাজি ভেসে চলে গেছে সে আবারও ভেসে ফিরে আসবে। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে। আমার সিক্সথ সেন্সের ব্যাপারটা তুমি তো বিশ্বাসই করো না। পীর কুতুধি ফিরে এলে বিশ্বাস হবে তো?
আমি বললাম, কেউ যদি প্রবলভাবে বিশ্বাস করে আমার এই ক্ষমতা আছে তাহলে প্রকৃতি তাকে সেই ক্ষমতা দিয়ে দেয়। কেউ যদি মনে করে আমার মিরাকল ঘটানোর ক্ষমতা আছে, তাহলে প্রকৃতি এই ক্ষমতা তাকে দিয়ে দেয়।
মিরাকল কিন্তু ঘটে। আমার জীবনে কয়েকবার ঘটেছে। শুনতে চাও?
চাই।
চা খেতে খেতে শুনবে? আমার ফ্রাস্কে চা আছে।
চা খাওয়া যেতে পারে।
তৃষ্ণা চা বানাতে বানাতে বলল, দুটা মিরাকল আমার জীবনে ঘটেছে। আজকেরটা হবে তৃতীয়।
আজকের কোন মিরাকল?
তৃষ্ণা জবাব দেওয়ার আগেই লঞ্চের সামনের দিক থেকে হৈচৈ, চেচামেচি শুরু হলো। আমরা দুজনই ছুটে বের হলাম। তৃষ্ণর হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তেমন কোনো দৃশ্য হলে ভিডিও করে ফেলবে।
ভিডিও করার মতোই দৃশ্য। কাঠের তক্তা ধরে দুজন ভাসছে। একজন পীর কুতুবি, অন্যজন ওসি সাহেব। বাতাসের ধাক্কায় তারা লঞ্চের দিকে ফিরে আসছে।
তৃষ্ণা বলল, ওরা দুজন যে কাঠের টুকরা ধরে ভেসে ভেসে আসছে এটাকে কি তুমি মিরাকল বলবে না?
আমার জবাব দেওয়ার আগেই পীর কুতুবির ক্লান্ত গলা শোনা গেল, জ্বিন কফিলের বদমাইশি। আমি সাঁতরায়া পাড়ে উঠতে পারতাম। বদ জ্বিন আমারে এক কাঠের টুকরা ধরায়া দিল। তাকায়া দেখি কাঠের টুকরার অন্যদিকে ওসি সাহেব।
তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই দুজনকে লঞ্চে তোলা হলো। ওসি সাহেব পানি খাব বলেই অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। পীর কুতুবি স্বাভাবিক গলায় বললেন, একটা গামছা দিয়ে কেউ আমার মাথাটা মুছায়ে দেন। আর এক কাপ হট টি দেন। দেশি বেনসন সিগারেট থাকলে ধরায়ে আমার ঠোঁটে দেন।
পীর কুতুবির প্রতিটি নির্দেশ পালিত হলো।
সবাই এই দুজনকে ঘিরে আছে। লঞ্চ ড়ুবে যাওয়ার চিন্তা এখন মাথায় নেই। মানুষ টেনশন বেশিক্ষণ নিতে পারে না। পীর কুতুবি এবং ওসি সাহেব কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সবার টেনশন দূর করেছেন।
পীর কুতুবি বললেন, ওসি সাহেবের শার্টের পকেটে হাতকড়ার চাবি আছে। চাবি দিয়ে হাতকড়া খুলেন। কতক্ষণ আর বান্ধা থাকব? হাত তুলে মোনাজাত করতে হবে। হাত বান্ধা অবস্থায় মোনাজাত কবুল হয় না।
কুতুবির হাতকড়া খুলে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, হাজেরান ভাই ও বোনেরা! এখন জিকিরা হবে। জিকির ছাড়া আমাদের উদ্ধার নাই। সবাই বামদিকে বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলবেন, আল্লাহ। হাত নামিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলবেন, ইহঁ। বড় পীর সাহেব আব্দুল কাদের জিলানি সাহেব এইভাবে জিকির করতেন।
জিকির শুরু হয়ে গেছে। আমি তৃষ্ণকে নিয়ে চলে আসব তখন দেখি ডিরেক্টর শাকুর ভাই চোখের ইশারায় আমাকে ডাকছেন। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। শাকুর ভাই বললেন, আপনার সঙ্গের মেয়েটা কে?
ওর নাম তৃষ্ণা।
চেহারা ছবি, ফিগার তো মারাত্মক।
কথা সত্য।
তাকে জিজ্ঞেস করে দেখেন তো ভিডিও নাটকে অভিনয় করবে। কি না। রাজি হলে পারুলির ক্যারেক্টর পেয়ে যাবে। নাটক চ্যানেল আইতে ইনশাল্লাহ প্রচার হবে। চ্যানেল আইয়ের একজন ক্যামেরা ক্রু আমার আপন মামাতো ভাই। তার মাধ্যমেই যোগাযোগ হবে।
আমি জিজ্ঞেস করে দেখব।
আপনার কি মনে হয়। রাজি হয়ে যাবে?
আমি বললাম, মহা বিপদে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। রাজি হয়ে যেতে পারে।
ভাই, একটু চেষ্টা চালান।
তৃষ্ণার কোলে ল্যাপটপ
তৃষ্ণার কোলে ল্যাপটপ। ভিডিও ক্যামেরায় যেসব ছবি তোলা হয়েছে তা ঢুকানো হচ্ছে ল্যাপটপে। সেখানেই এডিটিং হবে। হল্যান্ডের এক ভিডিও ফিল্ম ফেষ্টিবলে পাঠানো হবে। ফেষ্টিবলের নাম R Byte. সেখানে শুধু সত্যি ঘটনা নিয়ে বানানো ছবির প্রদর্শনী হয়। তৃষ্ণর ধারণা প্রথম পুরস্কার সে পেয়ে যাবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য দশ হাজার ইউরো।
আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে মহাবিপদ নিয়ে কিছু ইন্টারভ্যু নিয়ে আসা। ফাঁকে ফাঁকে এইসব ইন্টারভ্যু যাবে। ভিডিও ক্যামেরা কীভাবে চালাতে হয়, টেলিলেন্স কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সব শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ইন্টারভ্যু নেওয়া শুরু করেছি। প্রথমেই সারেঙের অ্যাসিসটেন্ট হাবলু।
হাবলু
হাবলু, ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে কথা বলো।
জি আচ্ছা।
তোমার কি ধারণা লঞ্চ ড়ুবে যাবে?
ড়ুবিতে পারে, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা হলে ড়ুববে। উনার ইচ্ছায় ভাইস থাকবে। আবার উনি ইচ্ছা করলে লঞ্চ আসমানে উড়াল দিবে।
আসমানে উড়াল দিবে?
অবশ্যই। স্যার, উড়ালপঙ্খি গান শুনছেন? ও আমার উড়ালপঞ্জিখরে ফিল্মের গান?
না।
শুনবেন? পুরাটা জানি।
এই সময় উড়ালপঞ্জিখ শোনাবে?
আপনে বললে শুনাব। ভিডিওতে একটা স্মৃতি থাকল।
পুরো গান শোনাতে হবে না। চার লাইন শোনালেই হবে।
হাবলু গানের চার লাইন গাইল! মুগ্ধ হয়ে শুনবার মতোই গান।
সারেং খালেক
বিস্ময়ের কথা সারেঙের জ্বর নেমে গেছে। এখন তিনি বিছানায় আধাশোয়া। তার হাতে সিগারেট। শরীর যে এখন সুস্থ তার বড় প্রমাণ হাতের সিগারেট। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নিতে পারে না।
কেমন আছেন?
আমি তো ভালোই আছি। লিঞ্চ যায় যায়।
এখন আমরা আছি কোথায় বলতে পারেন?
কিছুই বলতে পারি না।
কম্পাস নাই?
লঞ্চ যাচ্ছে দক্ষিণে। এটা বলার জন্য কম্পাস লাগে না। ঘুরপাক খেতে খেতে সাগরে গিয়ে পড়বে।
ডুববে না।
স্টিল বডি ড়ুববে কেন?
টাইটানিকেরও স্টিল বডি ছিল। টাইটানিক ড়ুবে গেছে।
টাইটানিক কী লঞ্চ আমি জানি না, তয় এই লঞ্চ ড়ুববে না। লঞ্চের একতলা মালামাল ভর্তি। বাতাসের ধাক্কায় লঞ্চ কান্ত হয়ে পড়বে না। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান। ঘুম থেকে উঠে দেখবেন সব ঠিকঠাক। আমি আঠার বছরের সারেং। পানির হিসাব, ঝড়ের হিসাব, লঞ্চের হিসাব আমার জানা।
আঠার বছরের সারেং-জীবনে কখনো লঞ্চ ড়ুবি হয় নি?
দুইবার হয়েছে। প্রথম ড়ুবল ছোট একতলা লঞ্চ। নাম এম এম এল মেঘনা!
মানুষ মারা গিয়েছিল?
মানুষ মারা যাবে না? যাত্রী যা উঠেছিল তার অর্ধেক সাফ। একজন ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে কাপ দিয়েছিল। তার কাছ থেকে ব্রিফকেস নেওয়ার জন্য সাত আটজন ঝাপ দিয়া পড়ল। জীবন বাঁচানোর দিকে নজর নাই ব্রিফকেস নিয়ে হাতাহাতি! সব তলায়া গেল, ব্রিফকেইস ভাইসা রইল। সেই ব্রিফকেইস পাইল আমারই অ্যাসিসটেন্ট কামরুজ্জামান। টাকা কত ছিল বলে নাই। লঞ্চের চাকরি ছেড়ে রাড়-সিমেন্টের দোকান দিয়েছে। গাবতলীতে তিনতলা বাড়ি করেছে। বিয়ে করেছে দুটা।
দ্বিতীয় দফার এক্সিডেন্টের বিষয়ে বলুন।
এইটা ছিল বড় এক্সিডেন্ট। দোতলা লঞ্চ। নাম এম ভি নাইলতাবাড়ি। এম ভি কী বুঝেন?
না।
এম ভি হলো মোটর ভেসিকেল আর এম এল মোটর লঞ্চ। এক্সিডেন্ট হয়েছে ঘন কুয়াশার কারণে। সাহেবরা এই কুয়াশারে বলে ফগ। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। এর মধ্যে লঞ্চ চলছে। লঞ্চের মালিক সঙ্গে আছেন। বরিশালে তাঁর নাকি জরুরি কাজ, পৌঁছাতেই হবে। তাঁর কারণেই এক ঘণ্টা আগে লঞ্চ ছেড়েছি। আমার বেকায়দা অবস্থা। ঘনঘন বদর বাবার নাম নিতেছি।
বদর বাবাটা কে?
খোয়াজ খিজির। উনার কারবার পানিতে। লঞ্চে এক নতুন জামাই বউ নিয়ে যাচ্ছে। ডেকে তারা আমোদ-ফুর্তির বাজার বসায়েছে। আমি তাদের এক নজর দেখেও এসেছি। বর যেমন সুন্দর তার স্ত্রীও সুন্দর। সচরাচর এরকম দেখা যায় না। বউ সুন্দর হলে জামাই হয় বান্দরের খালাত ভাই।
এক্সিডেন্টের কথা শুনেন। অন্ধকারের মধ্যে আজাদহা এক ট্যাংকার সামনে থেকে দিল ধাক্কা। লঞ্চ দুই ভাগ হয়ে গেল। ড়ুবে গেল দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে। সর্বমোট তিনশ ছাব্বিশজন মারা গেছে। ছয়-সাত বৎসর আগের কথা। সব পত্রিকায় উঠেছে। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকলে নিশ্চয় পড়েছেন।
জামাই বউ কি বেঁচে ছিল?
বউ বেঁচে ছিল। সাঁতার দিয়ে এক চরে উঠেছে। জামাই সাঁতার জানে না। প্ৰাণে বাঁচার জন্য বউকে জাপাটিয়ে ধরেছিল; বউ অতি চালাক মেয়ে, লাথি দিয়ে জামাইকে আগে সরায়েছে। শাড়ি গায়ে সাঁতার দেওয়া যায় না। শাড়ি খুলে সাঁতার শুরু করেছে।
আপনি এত কথা জানলেন কীভাবে? ঐ মেয়ে আর আমি একই চরে উঠেছিলাম। মেয়ের নাম সালমা। তাকে পরে বিবাহ করি।
ইনিই কি সকিনার মা?
জি না; সকিনার মা আমার প্রথম স্ত্রী। আমার তিন স্ত্রী। তিনজনের মধ্যেই আন্তরিক মিল মহব্বত। প্ৰথমজন সংসার দেখে, দ্বিতীয়জন রান্না দেখে। আর সালমা থাকে তার নিজের মতো।
আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ। আপনার দুই লঞ্চ পানির নিচে চলে গেল, আপনি টিকে রইলেন।
আমাকে ভাগ্যবান অবশ্যই বলা যায়। যে দুইবার লঞ্চড়ুবি হয়েছে সেই দুইবারই মক্কায় হজ করে এসেছি। আমি ডাবল হাজি।
শুনুন হাজি সাহেব! সবকিছু তিনবার করে ঘটে। এই জন্যেই কথা দানে দানে তিন দান। এই লঞ্চ ড়ুববে, আপনার তিন দান পূর্ণ হবে। হজ করতে যাবেন। আপনি, হবেন ট্রিপল হাজি।
ডাবল হাজি আমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন বলেই মনে হলো। তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
লঞ্চমালিকের কনিষ্ঠপুত্ৰ
কাদের সাহেব
কাদের সাহেবের নেশার ঘোর সামান্য কেটেছে। তিনি বিছানায় আধাশোয়া হয়ে বসা। চোখ সত্যিকার অর্থেই জবাফুলের মতো লাল। ঘরে বমি এবং এলকোহলের মিশ্রণে তৈরি বিষাক্ত গন্ধ।
ভিডিও ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে বললেন, হু ইউ?
বোঝা গেল তাঁর ইংরেজি জ্ঞান সীমাবদ্ধ এবং তিনি সীমাবদ্ধ ইংরেজি জ্ঞানেই কথা বলতে ভালোবাসেন।
আমি বললাম, স্যার আমি পত্রিকার লোক। আপনার একটা মিনি ইন্টারভ্যু নেব।
তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, Go Hell.
লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে এই খবর কি পেয়েছেন স্যার? সাঁতার নিশ্চয়ই জানেন? লুঙ্গি খুলে একটা প্যান্ট বাঁ পায়জামা পরে নিলে ভালো হয়। পানিতে লুঙ্গি খুলে গেলে বেকায়দা অবস্থা হবে। আমার অনুরোধ ড্রেসটা বদলান।
কাদের সাহেব ইংরেজি থেকে বাংলায় ফিরে এলেন। বিড়বিড় করে বললেন, হালারপুতে কয় কী? কথা শেষ করেই আবার বমির প্রস্তুতি নিলেন। বমি ভিডিও করার কিছু নেই। তারপরেও কিছুক্ষণ ভিডিও করলাম। মৃত্যু আতঙ্কে লোকজন বমি করছে—এই ফুটেজ তৃষ্ণা কাজে লাগাতে পারে।
কাদের সাহেব বললেন, এই হালারপুত ছবি তুলবি না। ছবি তুললে ফ্রেস বমি খাওয়ায়ে দিব।
ফ্রেস বা বাসি বমির কোনোটাই খাওয়া ঠিক হবে না ভেবে চলে এলাম।
ছিনতাইকারী
এখনো দড়ি বাঁধা অবস্থায়। চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি।
আমি বললাম, আছেন কেমন? আছি ভালোই কিন্তু আমার খাওন দেয় নাই। খাওয়া নাকি শেষ।
নতুন করে রান্না হবে।
ভাত রানতে পারে। চাউল আছে। হুদা ভাত খাব।
আপনি একাই খাওয়া পান নাই?
হ্যাঁ আমি বাদ পড়েছি।
আপনার সাথে চায়ের দোকানের মালিক বাধা ছিল, সে কোথায়?
জানি না কই। তারে ছেড়ে দিয়েছে, আমি একা আটকা আছি।
ছিনতাইয়ের কাজ কোথায় শিখেছেন?
নিজে নিজে শিখেছি। এর জন্য তো স্কুল-ইউনিভার্সিটি নাই।
ছিনতাই করে সবচেয়ে বেশি উপার্জন কবে করেছেন?
এইবারই করলাম। লাভ কী হয়েছে বলেন? সব নিয়ে গেছে। আনসাররা ভাগ বাটোয়ারা করে নিবে। এখন সাংবাদিক ভাই আপনি বলেন তারা ছিনতাইকারী না? টাকাটা তো তারা আমার কাছ থেকে ছিনতাই করল। ঠিক বলেছি না মিথ্যা বলেছি?
ঠিক বলেছেন। পড়াশোনা কতদূর করেছেন?
এসএসসি পাস দিয়েছিলাম। অংকে কত পেয়েছিলাম শুনলে ফাল দিয়ে পানিতে পড়ে যাবেন।
কত পেয়েছিলেন?
৭৮। আর দুই পেলে লেটার হয়ে যেত। আমার সামনে সিটি পড়েছিল। সলিলের। ক্লাসের ফাস্ট বয়। তার খাতা দেখে দেখে লিখেছি। একটা অংক, সে আর দেখায় না। আমি বললাম, মালাউনের বাচ্চা, খাতা দেখা। না যদি দেখাস ভুঁড়ি গলায়ে ফেলব।
খাতা দেখায়েছে?
না।
খাতা জমা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
তার ভূঁড়ি গালানোর ব্যবস্থা করেছিলেন?
না, মাফ দিয়েছি। ৭৮ তো কম না। লেটারের কাছাকাছি। বিয়ারিং লেটার বলা যায়।
সলিলের কোনো খোঁজ জানেন?
ইন্ডিয়া চলে গেছে। ওদের যাওয়ার জায়গা আছে। ঝামেলা হলেই ইন্ডিয়া। আমাদের কোনো উপায় নাই। আফসোস। সাংবাদিক ভাই, দেখেন না আমার কোনো ফুডের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
লঞ্চ তো কিছুক্ষণের মধ্যে ড়ুবেই যাবে। খাওয়া নিয়ে চিন্তা করে লাভ কী? আপনি তো সাঁতারও জানেন না যে কিছুক্ষণ সাঁতরাবেন।
আমি সাঁতার জানি না। আপনারে কে বলেছে?
অনুমানে বলছি।
আপনার অনুমান ঠিক আছে। একবার পুসকুনির পানিতে পড়ে মরতে বসেছিলাম। কে জীবন বাঁচায়েছে অনুমান করুন তো!
সলিল।
আপনার অনুমান সঠিক হয়েছে। মালাউনের বাচ্চা না থাকলে সেই দিনেই সব শেষ হতো।
সেটা কিন্তু খারাপ হতো না। তখন আপনি মারা যেতেন স্কুলের ছাত্র হিসাবে। এখন কলঙ্ক নিয়ে মারা যাবেন। ছিনতাইকারী হিসাবে মারা যাবেন।
সাংবাদিক ভাই আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না। নো টক। আপনার সঙ্গে কথা বলার আর সার্থকতা নাই।
পীর কুতুবি
নদী সাঁতরানোর কারণে উনার অবস্থা এখন কাহিল। জিকির শুরু করে দিয়ে উনি এখন হয় করে ঘুমুচ্ছেন। তার মুখের সামনে স্বাস্থ্যবান দুটা মাছি ভিনভন্ন করছে। দুটা মাছির মধ্যে একটার মতলব ভালো না। সে মনে হয় যে-কোনো মুহুর্তে কুতুবির মুখে ঢুকে যাবে। ওসি সাহের কুতুবির পাশেই শুয়ে আছেন। তিনি কি এখনো অচেতন নাকি চেতনা ফিরেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। দুজনের গায়ের ওপর কম্বল। এক কম্বলের নিচে দুজন দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।
ড. জিল্লুর খানের ছাত্রী সীমা
ক্যামেরা মুখের সামনে ধরলে সীমা পালিয়ে যাবে ভেবেছিলাম। সীমা চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি : সীমা কেমন আছ?
সীমা : (নিচুপ)
আমি : তুমি কি শুধু স্যারের সঙ্গেই প্রমোদ ভ্ৰমণে যাও, নাকি অন্যদের সঙ্গেও যাও?
সীমা : (চাপা অর্থহীন শব্দ করল)
আমি : বলা হয়ে থাকে প্রসটিটিশন বাংলাদেশে নেই বলে ট্যুরিজমে আমরা পিছিয়ে আছি। ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে তুমি এবং তোমার মতো মেয়েরা কী করতে পার এটা বলো। দেশের জন্যে সবার কাজ করতে হবে, তাই না?
সীমা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসে পড়ল। ইন্টারভ্যুর এখানেই সমাপ্তি।
আনসার বাহিনী প্ৰধান
আব্দুল খালেক
(জাতীয় ক্রীড়া প্ৰতিযোগিতায় পোলভল্টে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত)
আমি আব্দুল খালেক। জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। এখন আমার অবস্থা দেখেন ছাতার এক ভাঙা লঞ্চে ডিউটি পড়েছে। কারণ কী জানেন? আনসার এডজুটেন্টের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। উনি আমার সম্মানটা দেখলেন না, লঞ্চে ডিউটি দিয়ে এমন বিপদে ফেলেছেন। জীবন নিয়ে ফিরব তা মনে হয় না। নিজের হাতে ছিনতাইকারী ধরে এতগুলি টাকা উদ্ধার করেছি। সেই ঘটনা কেউ জানবে না।
না জানাই তো ভালো। ছিনতাইয়ের টাকা আপনারা ফেরত দেন নাই। আপনাদের হাত থেকেও টাকা ছিনতাই হয়েছে। আপনাদের একটা রাইফেলও পানিতে পড়ে গেছে বলে শুনেছি।
এইসব উড়া খবর কার কাছ থেকে পেয়েছেন?
আমরা সাংবাদিক মানুষ, খবর সংগ্ৰহ করাই আমাদের কাজ। শুনেছি আপনার রাইফেলাটাই নাকি মিসিং।
কে বলেছে?
আপনার রাইফেল কই?
সেই কৈফিয়োত আপনাকে দিব কেন? রাইফেল সেফ কাস্টডিতে আছে। ক্যামেরা বন্ধ করেন প্লিজ। আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না।
শেষ একটা কথা শুধু বলুন। জাতীয় ক্ৰীড়া প্রতিযোগিতায় আপনি স্বর্ণপদক বিজয়ী। তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশে কিছু বলুন।
আব্দুল খালেক গম্ভীর গলায় বললেন, খেলোয়াড়কে হতে হবে শারীরিকভাবে ফিট। তাকে সবসময় অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হবে। হারজিৎ নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। জয় এবং পরাজয় দুটাই হাসিমুখে গ্ৰহণ করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, জীবন হলো জয়-পরাজয়ের ফুল দিয়ে গাঁথা এক মালা।
আমি বললাম, মুখস্থ বলেছেন বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ। এক ফটো সাংবাদিক ভাই আমার জন্যে লিখে দিয়েছিলেন। মুখস্থ করে রেখেছি। টেলিভিশনেও একই কথা বলেছি। চ্যানেল আইয়ের খেলাধুলা অনুষ্ঠানে দুবার দেখায়েছে। বিকাল চারটায় একবার পরদিন সন্ধ্যাবেলায় আরেকবার।
স্বর্ণপদকটা কোথায়?
এটার কথা ভাই আর বলবেন না। বিরাট ঝামেলা হয়েছে। ক্যামেরাটা বন্ধ করেন। তারপর বলি।
আমি ক্যামেরা বন্ধ করলাম।
আব্দুল খালেকের মুখ এখন উজ্জ্বল। চোখ চকচক করছে।
আমার ছোট শ্যালিকার নাম রেশমা। সে আমার বিশেষ ভক্ত। আমি তাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করি। এর বেশি কিছু না। আমার স্ত্রী আবার অত্যন্ত সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মহিলা। আমরা দুজন একসঙ্গে নরমাল গল্পগুজব করছি দেখলেও সে উত্তেজিত হয়ে যায়, বোনকে অকথ্য ভাষায় গালাপালি করে।
স্বর্ণপদক নিয়ে বাসায় ফিরেছি, আমার স্ত্রী দাঁত তুলতে ডেনটিক্টের কাছে গিয়েছে। ঘরে আমি আর রেশমা। রেশমাকে স্বর্ণপদকটা দেখালাম। সে পদক হাতে নিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলল। ঘটনাটা দেখে এত আনন্দ পেলাম! রেশমাকে বললাম, এটা তুমি রেখে দাও। তোমাকে দিলাম।
এই ঘটনার ফলাফল কী বুঝতেই পারছেন। আমার স্ত্রী বঁটি নিয়ে গেছে রেশমাকে মারতে। এতবড় পদক পেয়েছি কোথায় আমোদ-ফুর্তি হবে তা না বঁটি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।
পদক এখন কার দখলে?
রেশমার দখলে। তার এক কথা—দুলাভাই আমাকে আদর করে দিয়েছেন, এটা আমি মরে গেলেও দিব না। প্রয়োজনে হাতের কব্জি কেটে দিব। তার কথায় যুক্তি আছে। আপনি কী বলেন?
যুক্তি আছে। পদকটা তো আপনার। আপনি যাকে ইচ্ছা দিবেন। আমার ভোট আমি দিব যাকে ইচ্ছা তাকে দিব। অনেকটা এইরকম।
এই তো আপনি বুঝেছেন।
রেশমার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে?
না। আমি বিপদে আছি শুনলেই কেঁদে বুক ভাসাবে। তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
ভাবিকে জানিয়েছেন?
মুটকিকে কিছু বলা না-বলা একই। তাকে কথা বললে এক্সট্রা একশ টাকা খরচ হবে।
কেন?
সে মুরগি ছদকা দিবে। একশ টাকার কমে মুরগি মিলে? তার স্বভাব হলো একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। সকালে উঠে মুরগি ছদকা। মুরগিতে কাজ হয় বলেন?
ঝড় যেভাবে উঠছে আমার মনে হয়। দুজনের সঙ্গে শেষ কথা বলে নেওয়া ভালো।
রেশমাকে সব জানাব আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুটকিকে জানানোর কিছু নাই।
ভাবি কি বেশি মোটা?
গ্র্যান্ডের কী জানি সমস্যা। প্রতিদিনই মোটা হচ্ছে। কোনো রিকশা তাকে নিতে রাজি হয় না।
পান ব্যবসায়ী তালেব মুনশি
আপনার টাকাই ছিনতাই হয়েছে?
জি।
এই নিয়ে আপনাকে কখনোই চিন্তিত দেখলাম না।
চিন্তু করে লাভ কী বলেন? আমি ধরে নিয়েছি। টাকাটা ব্যবসায়ে লোকসান হয়েছে।
টাকা ফেরত পাবেন বলে আপনার মনে হচ্ছে না?
কুমির যখন মুরগি গিলে তখন কি মুরগি পাওয়া যায়।
কুমিরের পেট কাটলে পাওয়া যায়। আমার ধারণা আপনি টাকাটা ফেরত পাবেন। লঞ্চ ড়ুবে গেলে টাকাটা কাজে লাগবে না এটাই যা সমস্যা।
তালেব মুনশি বললেন, কারোর না। কারোর কাজে লাগবে। পানি থেকে ডেডবডি তুলবে। মানিব্যাগ টাকার সন্ধানে শরীর হাতাহাতি করবে। শুনেন সাংবাদিক ভাই? লঞ্চভুবি হয়ে বহু লোক মারা গেছে। তাদের ডেডবডি উদ্ধার হয়েছে। কারও কাছে মানিব্যাগ পাওয়া যায় নাই।
ঝড় হঠাৎ করেই প্রবল আকার ধারণ করল। একসঙ্গে চার-পাঁচজন আযানে দাঁড়িয়েছে। মহা বিপদের সময় আযান দিলে নাকি বিপদ কাটে।
আমি আযানের কিছু দৃশ্য ভিডিও করলাম। ফুটেজ হিসাবে তৃষ্ণার কাজে লাগবে। শেষ ইন্টারভ্যু নিতে গেলাম বুড়োমিয়ার।
বুড়ো লাঠি হাতে আগের জায়গাতেই বসে আছে। লঞ্চ দুলছে। লঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে সেও দুলছে।
বুড়ো মিয়া
আমি বুড়ো মিয়ার সামনে বসতে বসতে বললাম, এই নিন আপনার চাদর। এখন খুশি?
বুড়ো বলল, চাদর দিয়ে কী করব! লঞ্চ যাবে তলায়ে।
ভয় পাচ্ছেন?
ভয় পাব কোন দুঃখে? অনেকদিন বাঁচলাম। একজীবনে যা দেখার সবই দেখছি। খালি উড়োজাহাজে উঠি নাই।
এই নিয়ে কি আফসোস আছে?
সামান্য আছে।
রাতে তো কিছু খান নাই। ক্ষুধা লাগে নাই?
বেজায় ভুখ লাগছে। ভুখ কঠিন জিনিস। আপনারে বলতে লজ্জা নাই, আমার স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন শেষরাতে। দুপুরে এমন ভুখ লাগছে। কাউরে কিছু বলতে পারি না। বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন। কান্দাকাটি চলছে। শেষে না পাইরা বাজারে এক ভাতের হোটেলে ভাত খাইলাম। আমার মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে মজার খানা ছিল সেইটা।
আইটেম কী ছিল মনে আছে?
মনে অবশ্যই আছে। শিং, মাছ আলু দিয়া ব্লানছে। ইলিশ মাছের ডিম পটল দিয়ে। কঁঠালের বিচি। আর হিন্দল দিয়ে একটা ভর্তা বানায়েছে, এমন স্বাদের ভর্তা বেহেশতে আছে কি না কে জানে।
বেহেশতের খাওয়া খাদ্য কেমন হবে বলে আপনার ধারণা?
বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মুনশি মাওলানার কাছে শুনেছি। আমরার মতো গরিব মানুষের জন্যে খুব ভালো মনে হয় না।
মুনশি মাওলানার কাছে কী শুনেছেন?
ধরেন। আপনার সামনে দিয়ে সুন্দর একটা পাখি উইড়া যাইতেছে। সেই পাখির মাংস খাইতে ইচ্ছা হইল, তখনই পাখিটা রোস্ট হইয়া মুখের সামনে ঝুলতে থাকবে। আপনি মাংস খায়া হাড্ডি ফেলবেন সঙ্গে সঙ্গে সেই হাড্ডি পাখি হইয়া উইড়া যাবে।
চলুন খেতে যাই।
কই খাব?
খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
বৃদ্ধকে হাত ধরে তুলছি ঠিক তখনি আতর মিয়া উপস্থিত। তার ভাব-ভঙ্গি বিজয়ীর।
আতর বলল, হিমু ভাই ঘটনা শুনেছেন?
না।
রশিদ খানের অ্যাসিসটেন্ট হামজা দশ হাত পানির নিচে।
তুমি ফেলেছ?
নিজে নিজেই পা পিছলায়া পড়ছে।
ক্ষমতা এখন তোমার হাতে?
অবশ্যই। সত্য কথা বলতে কী, ক্ষমতা সবসময় আমার হাতেই ছিল। আর কেউ না বুঝুকি আপনার বুঝার কথা।
আমি হাসলাম। ক্ষমতাধর মানুষের সামনে কারণে অকারণে হাসতে হয়।
আতর বলল, এখন আপনারে শেষ বারের মতো জিগাই, লঞ্চ কি ড়ুবাব? সব খবর আপনি এডভান্স পান। এই খবর পাবেন না তা হবে না।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, এই খবর আমি এখনো পাই নাই। তবে ভাব ভঙ্গিতে মনে হয় ড়ুবে যাবে।
কী ভাব ভঙ্গি?
যেসব লঞ্চ, জাহাজ বা বিমানে প্রচুর শিশু থাকে সেগুলি বিচিত্র কোনো কারণে ক্ষতিগ্ৰস্ত হয় না। এই লঞ্চে শিশু নাই বললেই হয়। আমি মাত্র দুজন মাকে দেখেছি তাদের বাচ্চা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মা তাদের জড়িয়ে আছে বলে বাচ্চাগুলি মোটেই ভয় পাচ্ছে না।
আজিব দুনিয়া! ঠিক না হিমু ভাই? অবশ্যই আজিব দুনিয়া।
গণ তওবার সিদ্ধান্ত
গণ তওবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তওবা পড়াচ্ছেন পীর কুতুবি। কুতুবি বললেন, হিন্দু ভাইরাও সামিল হয়ে যান। মহাপ্রলয়ের দিনে হিন্দু-মুসলমান কিছু নাই, সব সমান। মানুষ মানুষে সম্পর্কও শেষ। অমুক আমার স্ত্রী, অমুক বোন এইসবও নাই। সবাই অজু করে আসেন। যাদের কাপড়াচোপড় নিয়া সন্দেহ আছে, তারা মাথায় তিন বালতি পানি ঢেলে আসেন। নাপাকি দূর হবে।
শরীফ খান বললেন, একজন ফাঁসির আসামি, তিনটা খুন করেছে, সে আমাদের তওবা পড়াবে এটা কেমন কথা! আর কেউ কি নাই?
পীর কুতুবি বললেন, আপনি পড়ান। আপনি তো আমার চেয়ে লোক ভালো। আপনার চেহারা ছবিও খারাপ না। আল্লাহপাকের কাছে চেহারা ছবির দাম আছে।
আমি নিয়মকানুন জানি না।
নিয়মকানুন আমি বলে দিব। সূরা ফাতেহা দিয়ে শুরু তারপর দরূদশরিফ পাঠ।
আমি দরূদ জানি না।
পীর কুতুবি বললেন, আমি বলব। আপনি শুনে শুনে বলবেন। পারবেন না? মঞ্চনাটকে যেমন হয়। আমি প্রমট করব আপনি মূল পাঠ গাইবেন।
না পারব না।
গণ তওবার আয়োজন চলছে। আমি চলে এসেছি তৃষ্ণার কেবিনে। কেবিনের দরজা-জানালা বন্ধ। টেবিলের ওপর মোমবাতি জ্বলছে। আমি বললাম, মোমবাতি কোথায় পেয়েছে?
তৃষ্ণা বলল, হাবলু নামের ছেলেটা দিয়ে গেছে। অদ্ভুত ছেলে। মহা বিপদের সময় তার মুখভর্তি হাসি। নকল হাসি না, আসল হাসি।
আমি বললাম, মহা বিপদের সময় অনেক মানুষই হাসে। তামাশা করে। মজার মজার গল্প করে। ফরাসি বিপ্লবের সময় কী হয়েছিল শোন। একজন অংকবিদ ছিল, নাম মেইনি। রাজপ্রাসাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে—এই কারণে গিলোটিনে তাঁর মাথা কাটা যাবে। তিনি গিলোটিনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। উৎসুক জনতা তাকে ঘিরে আছে। তিনি জনতার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন তারপর হাসিমুখে বললেন, আমি আপনাদের একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। ধাঁধার উত্তর যিনি দিতে পারবেন তার জন্যে পুরস্কার আছে। ভালো পুরস্কার।
সবাই চেঁচিয়ে উঠল, কী পুরস্কার?
মেইনি বললেন, আমার কাটা মাথাটা বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এই হলো পুরস্কার। চারদিকে হাসির ধুম পড়ে গেল। একসময় জনতা চেঁচাতে লাগল, উনকে ছেড়ে দিন। উনাকে ছেড়ে দিন।
তৃষ্ণা বলল, ছেড়ে দেওয়া হলো?
না। যথাসময় গিলোটিনে মাথা কেটে আলাদা করা হলো।
তৃষ্ণা বলল, মরবিড গল্প বাদ দাও। মজার গল্প করো। মহা দুর্যোগে মজার মজার গল্প করতে হয়। মরবিড সময়ে আনন্দের গল্প, আর আনন্দের সময়ে মরবিড় গল্প। চা খাবে?
না।
না বললে হবে না। ফ্লাস্কে চা আছে। এখন আমরা দুজনে মিলে চা খাব।
তুমি যে একগাদা খাবার এনেছ তার কি হবে?
যথাসময়ে খাবার খাব।
যথাসময়টা কখন?
তৃষ্ণা সহজ গলায় বলল, লঞ্চ যখন ড়ুবতে শুরু করবে তখন।
আমি বললাম, লঞ্চ ড়ুববে?
তৃষ্ণা বলল, হ্যাঁ ড়ুববে। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে। আচ্ছা এই প্রসঙ্গ থাক এখন বলো, তুমি কি কখনো কোনো মেয়েকে বলেছ, I love you?
না।
বলো নি কেন? বলার মতো কাউকে পাও নি?
পেয়েছি কিন্তু এই বাক্যটি বলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমার বাবা বলে গেছেন দুটি বাক্য কখনোই বলা যাবে না। একটা হলো, I love you. আরেকটা হলো। hate you. তাঁর মতে, দুটি বাক্যের অর্থ একই।
তোমার বাবা কী করতেন?
তিনি কিছুই করতেন না। তাঁর একটা স্কুল ছিল। তিনি স্কুলের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন। আমি সেই স্কুলের একমাত্র ছাত্র। আমার যা কিছু শিক্ষা সবই বাবার কাছ থেকে।
তাঁর স্কুলের নাম কী?
মহাপুরুষ বানানোর স্কুল। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন।
কী বলছি এসব? মহাপুরুষ বানানো যায়?
বাবার ধারণা, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের মতো মহাপুরুষও বানানো যায়।
তৃষ্ণা বলল, মহাপুরুষরা কী করেন?
মহাপুরুষদের কাজ তো একটাই। মাঝে মাঝে বাণী দেন। ভক্তদের সুন্দর কথা বলেন।
তুমি দয়া করে একটা বাণী দাও।
মহাপুরুষ হতে পারি নি কাজেই বাণী নেই।
তৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলল, পুরো বাণী না দিলে অর্ধেক দাও।
আমি বললাম, একজন ড়ুবন্ত মানুষের চেতনা থাকে ভাসন্ত।
এর মানে কী?
আমি বললাম, মহাপুরুষদের বাণীর কোনো স্পষ্ট অর্থ থাকে না। সবই অস্পষ্ট এবং ধোঁয়াটে। যে যার মতো অর্থ করে নেয়। তুমি তোমার মতো অর্থ করে নাও।
তৃষ্ণা বলল, আমি কি আমার সামনে বসে থাকা মহাপুরুষের হাতে হাত রাখতে পারি?
আমি কিছু বলার আগেই দরজা ধাক্কা দিয়ে আতর ঢুকল। বাতাসের ঝাপটায় মোমবাতি নিভে গেল। আতর শান্ত গলায় বলল, খারাপ খবর আছে।
আমি বললাম, লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে?
হুঁ।
আমি বললাম, তাহলে আমরা ডিনার সেরে ফেলি। তৃষ্ণা তুমি টিফিন কেরিয়ার আতরের কাছে দাও। খাবার গরম করে আনুক। এই ফাঁকে আমরা চা খাব।
আতর বিক্ষিত গলায় বললেন, এখন খানা খাবেন? খানা মুখে রুচবে?
অবশ্যই রুচবে। দুর্যোগের সময় ক্ষুধা বেশি পায়। মুখের টেস্টবাড়ি খুব এনার্জেটিক থাকে।
আতর টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে গেল। তৃষ্ণা বলল, তুমি কি টাইটানিক ছবিটা দেখেছ?
আমি না-সূচক মাথা নাড়ুলাম।
তৃষ্ণা বলল, ঐ ছবিতে দেখেছি টাইটানিক যখন ভুবছে তখন মিউজিশিয়ানরা অদ্ভুত সুন্দর মিউজিক করছিল।
আমি বললাম, ছবিতে করছিল। বাস্তবে ওরা প্ৰাণ বাঁচানোর জন্যে ছোটাছুটি করছিল।
তৃষ্ণা বলল, আমাদের জীবন ছবির মতো হলে ভালো হতো। তাই না?
তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে বাতাস বৃষ্টি দুইই থেমে গেল। তৃষ্ণা মোমবাতি জ্বালাল। বাতির শিখা কাঁপছে না। স্থির হয়ে আছে।
তৃষ্ণা বলল, অবাক কাণ্ড। ঝড় থেমে গেছে।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, লক্ষণ খুবই খারাপ। প্রবল বিপর্যয়ের আগে আগে প্রকৃতি শান্ত পরিবেশ তৈরি করতে ভালোবাসে। হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা পড়ার আগের সময়টা ছিল অপূর্ব সুন্দর। কন্যা-সুন্দর আলোয় শহর ভেসে যাচ্ছিল। গাছে গাছে পাখি ডাকছিল। মিষ্টি বাতাস বইছিল।
তোমাকে কে বলেই?
বোমার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একজন জাপানির আত্মকাহিনী থেকে জেনেছি।
কাজেই আমরা ড়ুবছি?
হ্যাঁ। তবে আমাদের হাতে সময় আছে। আমরা ভালো মতো ডিনার শেষ করব। যা ঘটার তারপর ঘটবে।
হাবলু এসে ঢুকল। তার মুখভর্তি হাসি।
আমি বললাম, ঘটনা কিরে হাবলু?
হাবলু সব দাঁত বের করে বলল, লঞ্চ ড়ুবতাছে স্যার। একতলায় কোমর পানি। কান্নাকাটির ধুম পড়ছে।
আমি বললাম, খুব আনন্দ পাচ্ছ, তাই না হাবলু? হাবলু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তৃষ্ণা বলল, হাবলু সাঁতার জানো?
হাবলু বলল, জে-না। বলেই খিকখিক করে হাসি।
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা
আমরা খেতে বসেছি।
খাবার আয়োজন ফাষ্ট ক্লাস ডেকে। কেবিন থেকে হাবলু এবং তৃষ্ণ খাবার নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে তেরজন অভুক্ত মানুষ পাওয়া গেছে।
ঝড়ের প্রকোপ একটু কম। এত আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। খবর পাওয়া গেছে ড়ুবন্ত চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলা ফেটে গেছে। লঞ্চে পানি উঠছে। দুটা চাপকল ব্যবহার করে পানি সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যে হাৱে পানি বের হচ্ছে তারচেয়ে বেশি পানি ঢুকছে। ছোটবেলার চৌবাচ্চার অংক। কেউ ঠিকমতো হিসাব করতে পারলে কতক্ষণে লঞ্চ ড়ুবে যাবে তা বের করে ফেলতে পারবে। অংক করার মুড়ে কেউ নেই, তবে ড. জিম্বুর রহমান ব্যাপারটা দেখছেন। কী হারে লঞ্চ ড়ুবছে সেটা মনে হয় তিনি জানেন। তাঁর ছাত্রী পাশেই আছে। ড. জিলুর মাঝে মধ্যেই হতাশ চোখে ছাত্রীর দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছে। আগের বৈরী ভাব এখন আর নেই।
রশীদ খান এবং রুস্তম। এই দুজনও চাপকলের তদারকিতে আছে। একটা চাপকল রুস্তম কিছুক্ষণ চাপছে, সে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রশীদ খান চাপছেন। তবে দুজনেরই কল চাপার দিকেই আগ্রহ। আতর মিয়ার নির্দেশ, দুজনের একজন যখন কল চাপবে না। সে তখন কানো ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
আতর মিয়ার হাতে এখন পূর্ণ ক্ষমতা। ক্ষমতাধররা ক্ষমতার ব্যবহার করতে ভালোবাসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর হাতে রাশিয়ান আর্মির আর্টিলারির এক বিগ্রেডিয়ার ধরা পড়েছিলেন। তাকে বলা হলো কুকুরের মতো জিভ বের করে রাখতে। যেই মুহুর্তে জিভ মুখের ভেতর ঢুকবে সেই মুহূর্তেই তাকে গুলি করা হবে। ব্রিগেডিয়ার জিভ বের করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
ডিরেক্টর শাকুর এবং তার বন্ধু বড় একটা কাঠের তক্তা জোগাড় করেছে। দুজন সেটা আগলে রাখছে, কাউকে আশপাশে ঘিরতে দিচ্ছে না। কিছু মানুষ আছে মহা বিপদে আনন্দে থাকে। এরাও মনে হচ্ছে সেরকম।
আমাদের খেতে বসার সঙ্গে লাষ্ট সাপারের কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছি। নিউ টেস্টামেন্টে বলা হচ্ছে যিশুখ্রিষ্ট শেষ খাবার খেতে বসেন উপরের তলায় (আমরা ডেকে খেতে বেসেছি!) নিচতলা থেকে খাবার নিয়ে আসছিল তাঁর দুজন অনুসারী (ডেক থেকে খাবার আনছে হাবলু এবং তৃষ্ণা)। যিশুখ্রিস্টের সদস্য সংখ্যা ছিল তের। আমরাও তেরজন। যিশুখ্রিস্টের সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন মহিলা। আমাদের মধ্যে যেমন তৃষ্ণা। নিউ টেস্টামেন্ট খাবারের বর্ণনায় মাছের কথা উল্লেখ করেছে। আমাদের খাবারে মাছ আছে। তৃষ্ণা আস্ত একটা ইলিশ মাছ ভেজে এনেছে। লুকের বর্ণনায় (২২:৭-৩৮) তখন বাইরে আবহাওয়া ছিল খারাপ। খেতে বাসা তেরজনের মধ্যে একজনের হাতে ছিল বাঁকা লাঠি।
বুড়ো মিয়ার হাতে একটা বাঁকা লাঠি। বুড়ো মিয়া সবাইকে একটা ধাঁধা। দিয়েছেন। তাঁর ধাঁধাটি এরকম—এক বৃদ্ধা আজরাইলের হাত থেকে বাঁচতে চায়। সে একটা কৌশল বের করল যেন আজরাইল তাকে খুঁজে না পায়। কৌশল কাজ করল। আজরাইল তাকে খুঁজে পেল না। কৌশলটা কী?
তৃষ্ণা বলল, আমি এই গল্পটা জানি। কৌশলটা কী বলতে পারব। তাতে অন্যদের মজা নষ্ট হবে। দেখা যাক অন্যরা কেউ পারে কি না। আমি আপনাকে কানে কানে কৌশলটা বলি।
তৃষ্ণা বৃদ্ধের কানে কানে কিছু বলল। বৃদ্ধ আনন্দিত গলায় বলল, আম্মা, হইছে। আম্মার বেজায় বুদ্ধি। এই ধাঁধার উত্তর কেউ দিতে পারে না। আপনে পারছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই কৌশল বের করার চিন্তায় অস্থির। সবচেয়ে অস্থির আতর মিয়া। সম্ভবত কৌশল জানার প্রয়োজন তারই সবচেয়ে বেশি।
আতর মিয়া বসেছে ঠিক আমার পাশে। সে ইলিশ মাছ খাচ্ছে না। মাছ খেলেই তার গলায় কাটা ফুটে। তা সে যে মাছই হোক। একবার নাকি পাবদা মাছ খেয়েও তার গলায় কাটা ফুটেছিল।
আমি বললাম, গলায় মাছের কাঁটা ফুটা নিয়ে একটি কথা ইন্দোনেশিয়ায় চালু আছে। কথাটা শুনতে চাও?
চাই।
দুষ্ট লোকদের গলাতেই সবসময় কাটা ফুটে। এটা নাকি প্রকৃতির নিয়ম। গলায় কঁটা বিধিয়ে সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেওয়া তুমি দুষ্ট।
আতর বলল, এটা একটা ভুল কথা।
হতে পারে ভুল কথা।
আমি সবার সামনে ইলিশ মাছ খাব। দেখবেন কাটা ফুটবে না। পরীক্ষা হয়ে যাবে।
সবাই তাকাচ্ছে আতর মিয়ার দিকে। আতর অনেকখানি মাছ খেয়ে হাসিমুখে বলল, কাঁটা লাগে নাই।
তৃষ্ণা বলল, এই মাছটি এমনভাবে রান্না হয়েছে যেন কোনো কাটা না থাকে। তারপরেও আপনার গলায় কাটা ফুটেছে। আপনি ভাব করছেন কাটা ফুটে নি। হুদা-ভাত খান, কাঁটা চলে যাবে। আমরা মহা বিপদে আছি, লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে— এইসময় আমরা কেন ভান করব? সবাই সত্যি কথা বলার চেষ্টা করব।
আতর মিয়া শুধু ভাত মাখিয়ে গেলার চেষ্টা করছে। শুধু ভাত গেলা কঠিন কর্ম। তাকে লজ্জিত এবং বিব্রত মনে হচ্ছে। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। গলার কাটা নামানোটাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ বিষয় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
লাস্ট সাপারে তেরজনের মধ্যে একজন কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করে নি। আমাদের মধ্যে সেই একজনও আছেন। তিনি হচ্ছেন পীর হাবীব কুতুবি। এখন আর পুলিশরা তার পেছনে নেই। সবাই নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। ফাঁসির আসামি কোথায় তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
হাবিব কুতুবি খাদ্য গ্রহণ করছেন না। কারণ তিনি রোজা। আমি বললাম, রাতের বেলা কিসের রোজা? পীর সাহেব বললেন, সৌদি টাইমিংয়ে এখন দিন। আমি সেই টাইমে রোজা রেখেছি। আপনাদের কাছে বিষয়টা কি পরিষ্কার হয়েছে?
কেউ জবাব দিল না। পীর হাবিব বললেন, সময় হলো অন্তরের মধ্যে। অন্তরে আপনি যে সময় নির্ধারণ করবেন, আপনের সময় সেইটাই।
তৃষ্ণ বলল, আলোচনা ফিলসফির দিকে চলে যাচ্ছে। আপনি সাধারণ কথাবার্তা বলুন, যাতে আমরা সবাই বুঝতে পারি।
আতর মিয়া বিরক্ত গলায় বলল, আপনি থাকেন বাংলাদেশে, রোজা রাখেন। সৌদি টাইমিংয়ে—এটা কেমন কথা! কত বড় সৌদি পীর হয়েছেন আমাকে দেখান। গলার কাটা নামায়ে দেন।
পীর হাবিব বললেন, আপনার গলার কাঁটা আমি কেন জ্বিন কফিলও নামাতে পারবে না। কারণ আপনার গলায় কাঁটা বিধে নাই। কাঁটা বিধেছে আপনার অন্তরে। অন্তরের কাঁটা আপনাকেই সরাতে হবে। অন্য কেউ পারবে না। দুষ্ট লোকের অন্তরে কাঁটা থাকে।
আতর মিয়া বলল, আপনি তো খুন করেছেন তিনটা। আপনার অন্তরে কাঁটা নাই?
এইখানে ভুল করেছেন। খুন আমি করি নাই। খুন করেছে জ্বিন কাফিল।
তৃষ্ণা বলল, এইসব হাস্যকর কথাবার্তা এখন বলবেন না। আমরা গল্পগুজব করছি, আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি। গল্প শুনুন, আনন্দে থাকার চেষ্টা করুন।
আমি আনন্দেই আছি। মনে মনে জিগির করতেছি, এতেই আমার আনন্দ। খাওয়া শেষ করেন তারপর আমার সঙ্গে জিগিয়ে সামিল হন।
লাঠি হাতে বুড়ো মিয়া বলল, আমি যে আপনাদের একটা মিমাংসা দিছিলাম তার সমাধান কি দিব?
আমি বললাম, মিমাংসাটা নিয়ে আমরা সবাই চিন্তা করছি। এখন না বললেই ভালো।
তৃষ্ণা বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা সবাই এই পর্যন্ত জীবনে সবচেয়ে ভালো কাজ কী করেছি সেটা বলি। পীর কুতুবিকে দিয়ে শুরু করি। আপনি বলুন।
পীর কুতুবি বললেন, সত্যি কথা বলতে কী, আমি তেমন কোনো ভালো কাজ করি নাই। জ্বিন কফিল করেছে। সে আমার স্ত্রী এবং দুই শালিকাকে খুন করেছে। এই ভালো কাজের জন্য সে বেহেশতবাসী হবে।
আমি বললাম, মানুষের বেহেশত আর জিনের বেহেশত কি আলাদা? নাকি একই বেহেশতে আমরা থাকব?
পীর কুতুবি বললেন, তফসিরে বাইজাবিনে অর্থাৎ সূরায়ে জিনের তফসিরে আছে জিনদের দোজখ শীতল। সেখান থেকে মনে হয় আমাদের এবং জিনদের বেহেশত দোজখ আলাদা।
তৃষ্ণা বলল, আতর মিয়া আপনি বলুন। এক জীবনে ভালো কাজ কী করেছেন?
আতর বলল, প্রফেসর সাবরে কানে ধরে খাড়া করাইয়া থুইছি—এইটাই আমার ভালো কাজ। পাছায় লাথি দিয়া পানিতে ফেললে উন্নতমানের ভালো কাজ হইত। কী আর করা!
তৃষ্ণা বলল, আপনার কাঁটা কি এখনো আছে? আতর বলল, আগে ভাবছিলাম কাঁটা একটা ফুটছে। এখন মনে হইতেছে দুইটা।
সবাই হেসে উঠল। আমরা আনন্দ পেতে শুরু করেছি। লাস্ট সাপারের শুরুতে সবাই আনন্দেই ছিলেন।
আনন্দভঙ্গ হয় খাবার শুরুর কিছুক্ষণ পর। লাস্ট সাপারে রেডওয়াইন দেওয়া হয়েছিল। রেডওয়াইনের অভাব অনুভব করছি। আমি তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কাছে কি রেডওয়াইনের একটা বোতল আছে?
তৃষ্ণা বলল, আমার কাছে রে ওয়াইনের বোতল থাকবে কেন?
তুমি সারা জীবন বিদেশে থেকেছ, এইজন্যে বললাম। সেখানে তো খাবার হিসেবে রেডিওয়াইন খাওয়া হয়।
তুমি বিদেশে যাও নি তো এই জন্যেই বিদেশ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। বাঙালিরা সেখানে অত্যন্ত কনজারভেটিভ জীবনযাপন করে। পুরুষরা দাড়ি রাখে না, তবে মেয়েরা হিজাব পরে। হঠাৎ রেডওয়াইনের বিষয় এল কেন? তুমি কি ওয়াইন খাও?
না। তবে আজ খেতে ইচ্ছা করছে।
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কাছে খুব দামি এক বোতল রেডওয়াইন আছে। স্পেনের তৈরি। কেন কিনেছিলাম জানি না। মনে হয় তুমি খেতে চাইবে ভেবে কিনেছি।
আমি বললাম, হতে পারে। সবকিছু যদি প্রিডিটারমিনড হয় তাহলে আমি যে আজ রাতে ওয়াইন খেতে চাইব এটাও পূর্বনির্ধারিত।
বুড়ো মিয়া বিরক্ত গলায় বল, আম্মুজি, আপনার কথাবার্তা কিছু বুঝতেছি না! আমি যে মিমাংসা দিলাম। তার কী উত্তর? —
আমরা খাচ্ছি। লিঞ্চ ড়ুবিছে। কৃষ্ণা ওয়াইনের বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বলল, হাউ এক্সাইটিং!
কী সুন্দর যে তাঁকে লাগছে। আমি মনে মনে বললাম, মুখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
তৃষ্ণা চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি! আমি মাঝে মাঝে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি।
নিচ থেকে বিকট হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। মনে হয় লঞ্চ তলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
===============
প্রকাশকের মন্তব্য
লেখক যে জায়গায় উপন্যাস শেষ করেছেন, সেখানে উপন্যাস শেষ হয় না। লঞ্চ কি আসলেই ড়ুবেছে? যদি ড়ুবে গিয়ে থাকে তাহলে হিমুর কী হয়েছে? তৃষ্ণার পরিণতি কী?
এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা লেখকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, হিমু এখন আমার গ্রিপে নেই। সে অনেকটাই পাঠকের সম্পত্তি। উপন্যাসের শেষটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে লঞ্চ ড়ুবিয়ে সবাইকে মেরে ফেলতে পারেন। আবার কেউ ইচ্ছা করলে উদ্ধারকারী জাহাজ আনতে পারেন।
আবার কেউ তাদের ধারণায় যারা দুষ্ট তাদের মেরে ফেলে ভালোদের বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। তবে তৃষ্ণার মরে যাওয়াই ভালো। সে বেঁচে থাকলে হিমুর পেছনে ফেউ-এর মতো লেগে থাকবে। সেটা ঠিক হবে না।
আমরা জুমায়ূন আহমেদকে উপন্যাসের শেষ অংশ লিখে দেওয়ার জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ করার পর তিনি বলেন, আমার অতি প্রিয় ঔপন্যাসিক জন স্টেইনবেক বলেছেন, একটি ভালো গল্প হলো কবিতার মতো, যার শেষ থাকে না। এরপর তিনি চার লাইন কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটি Michelal Drayton-এর
Since there is no help, come let us kiss and part.
Nay, I have done; you get no more of me.
And am glad, yes glad with all my heart,
that thus so cleanly I myself can be free.