বিয়ে ঠিকঠাক করে ফেলেছেন?
কয়েকটা মেয়ে দেখা হয়েছে-এর মধ্যে একটাকে তোর ফুপুর পছন্দ হয়েছে। মেয়ের নাম হল—চোখ ।
মেয়ের নাম চোখ?
হ্যাঁ, চোখ। আজকাল কি নামের কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে! যার যা ইচ্ছা নাম রাখছে।
চোখ নাম হবে কীভাবো! আঁখি না তো?
ও হ্যাঁ, আঁখি। সুন্দর মেয়ে-ফড়ফড়ানি টাইপ। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তিনটা কথা বলে। বাদলের সঙ্গে মানাবে। একজন কথা বলে যাবে, একজন শুনে যাবে।
মেয়ে আপনার পছন্দ না?
তোর ফুপুর পছন্দ। পুরুষমানুষের কি সংসারে কোনো say থাকে? থাকে না। পুরুষরা পেপার–হেড হিসেবে অবস্থান করে। নামে কর্তা, আসলে ভর্তা। তুই বিয়ে না করে খুব ভালো আছিস। দিব্যি শরীরে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছিস। তোকে দেখে হিংসা হয়। স্বাধীনতা কী জিনিস তার কী মর্ম সেটা বোঝে শুধু বিবাহিত পুরুষরাই। উঠিরে হিমু।
আচ্ছা।
বাদলের প্রসঙ্গে যা বলছি মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
ও আচ্ছা, তোর অসুখের ব্যাপারটাই তো কিছু জানলাম না। কী অসুখ?
ঠাণ্ডা লেগেছে।
ঠাণ্ডা লাগল কীভাবে?
ফুটপাতে চান্দর-গায়ে শুয়েছিলাম। চোর চাদর নিয়ে গেল।
ফুটপাতে ঘুমাচ্ছিলি?
জি।
ঘরে ঘুমাতে আর ভালো লাগে না?
তা না–
শোন হিমু, বাদলের কাছ থেকে দূরে থাকবি। মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
টাকা-পয়সা কিছু লাগবে? লাগলে বল, লজ্জা করিস না! ধর, পাঁচ শ টাকা রেখে দে। অষুধপত্র কেনার ব্যাপার থাকতে পারে।
আমি নোটটা রাখলাম। ফুপ চিন্তিত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলেন। ছেলে আমার ফঁাদে পড়ে যদি আবার ফুটপাতে শয্যা পাতে! কিছুই বলা যায় না।
হাসপাতাল আমার বেশ পছন্দ হল? হাসপাতালের মানুষগুলির ভেতর একটা মিল আছে। সবাই রোগী। রোগযন্ত্রণায় কাতর। ব্যাধি সব মানুষকে এক করে দিয়েছে। একজন সুস্থ মানুষ অপরিচিত একজন সুস্থ মানুষের জন্যে কোনো সহমর্মিতা বোধ করবে: না, কিন্তু একজন অসুস্থ মানুষ অন্য একজন অসুস্থ মানুষের জন্যে করবে।
হাসপাতালে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে না। সকালে নাশতা আসছে। দুবেলা খাবার আসছে। দুনম্বরি ব্যবস্থাও আছে। জায়গামতো টাকা খাওয়ালে স্পেশাল ডায়েটের ব্যবস্থা হয়। ডাক্তারদের অনেক সংস্থাটংস্থা আছে। করুণ গলায় তরুণ ডাক্তারদের কাছে অভাবের কথা বলতে পারলে ফ্রি অষুধ তো পাওয়া যায়ই, পথ্য কেনার টাকাও পাওয়া যায়।
রোগ সেরে গেছে, তার পরেও কিছুদিন হাসপাতালে থেকে শরীর সারাবার ব্যবস্থাও আছে! খাতাপত্রে নাম থাকবে না-কিন্তু বেড থাকবে। এক-একদিন এক-এক ওয়ার্ডে গিয়ে ঘুমাতে হবে।
ছেলেমেয়ে নিয়ে গত সাত মাস ধরে হাসপাতালে বাস করছে এমন একজনের সন্ধানও পাওয়া গেল। নাম ইসমাইল মিয়া। স্ত্রীর ক্যানসার হয়েছিল, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে মাসখানিক চিকিৎসা করাল। সেই থেকে ইসমাইল মিয়ার হাসপাতালের সঙ্গে পরিচয়।। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার নিয়ে সে হাসপাতালে পার হয়ে গেল। স্ত্রী মরে গেছে। তাতে অসুবিধা হয় নি। বাচ্চার হাসপাতালের বারান্দায় খেলে। এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ঘোরে। কেউ কিছু বলে না। ইসমাইল মিয়া দিনে বাইরে কাজকর্ম করে (মনে হয় দুনম্বরি কাজ-চুরি, ফটিকাবাজি) রাতে হাসপাতালে এসে ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করে। ঘুমানোর একটা ব্যবস্থা করে।
ইসমাইল মিয়ার সঙ্গে পরিচয় হল। অতি ভদ্র। অতি বিনয়ী। হাসিমুখ ছাড়া কথা বলে না। তার মধ্যে দার্শনিক ব্যাপারও আছে। আমি বললাম, হাসপাতালে আর কতদিন থাকবে?
ইসমাইল দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ক্যামনে বলি ভাইজান? আমার হাতে তো কিছু নাই।
তোমার হাতে নেই কেন?
সব তো ভাইজান আল্লাহ্পাকের নির্ধারণ। আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রেখেছে। আমি বালবাচ্চা নিয়া হাসপাতালে থাকব-এইজন্যে আছি। যেদিন নির্ধারণ করবেন। আর দরকার নাই—সেদিন বিদায়।
তা তো বটেই।
আল্লাহপাকের হুকুম ছাড়া তো ভাইজান কিছুই হওনের উপায় নাই।
তাও ঠিক।
সামান্য যে পিপীলিকা আল্লাহপাক তারও খবর রাখে। আপনার পায়ের তলায় পাইরা দুইটা পিপীলিকার মৃত্যু হবে তাও আল্লাহপাকের বিধান। আজরাইল আলাইহেস সালাম আল্লাহ্রপাকের নির্দেশে দুই পিপীলিকার জানি কবজ করবে।
ও আচ্ছা।
এইজন্যেই ভাইজান কোনো কিছু নিয়া চিন্তা করি না। যার চিন্তা করার কথা সেই চিন্তা করতেছে। আমি চিন্তা কইরা কী করব।
কার চিন্তা করার কথা?
কার আবার, আল্লাহ্বপাকের!
ইসমাইল মিয়া খুবই আল্লাহভক্ত। সমস্যা হচ্ছে তার প্রধান কাজ-চুরি। চুরির পক্ষেও সে ভালো যুক্তি দাঁড় করিয়েছে–
চুরিতে আসলে কোনো দোষ নাই ভাইজান। ভালুক কী করে? পেটে খিদা লাগলে মৌমাছির মৌচাক থাইক্যা মধুচুরি করে। এর জন্যে ভালুকের দোষ হয় না। এখন বলেন মানুষের দোষ হইব ক্যান।
বগার মা নামের এক বৃদ্ধার সঙ্গেও পরিচয় হল। সে ঝাড়ফুক করে। ঝাড়ার কাঠি নিয়ে রোগীদের ঝাড়ে। তাতে নাকি অতি দ্রুত রোগ আরোগ্য হয়। হাসপাতালে সৰ্বাধুনিক চিকিৎসার সাথে সাথে চলে ঝাড়ফুঁক।
এই বৃদ্ধ দশ টাকার বিনিময়ে আমাকেও একদিন ঝেড়ে গেলেন। আমি দশ টাকার বাইরে আরো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ঝাড়ার মন্ত্র খানিকটা শিখে নিলাম।
ও কালী সাধনা
বিষ্ট কালী মাতা।
উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিম।
রাও নাও — ঈশানে যাও
… … …
বগার মার সঙ্গে অনেক গল্পগুজব ও করলাম। জানা গেল বগা বলে তার কোনো ছেলে বা মেয়ে নেই। তাঁর তিনবার বিয়ে হয়েছিল। কোনো ঘরেই কোনো সন্তান হয় নি। কী করে তার নাম বগার মা হয়ে গেল তিনি নিজেও জানেন না।