ভালো।
এইটুকু বলে আমি দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারলাম, কিংবা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
হাসপাতালের তৃতীয় দিনে আমাকে দেখতে এলেন মেজো ফুপ-বাদলের বাবা। তার হাতে এক প্যাকেট আঙুর। একটা সময় ছিল যখন মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখতে যাবার সময় আঙুর নিয়ে যাওয়া হত। ফলের দোকানি আঙুর বিক্রির সময় মমতামাখা গলায় বলত–রুগীর অবস্থা সিরিয়াস?
এখন আঙুর এক শ টাকা কেজি-বারই বরং এই তুলনায় দামি ফল।
মেজো ফুপা আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, অবস্থা কী?
আমি জবাব দিলাম। কেউ রোগী দেখতে এসে যদি দেখে রোগী দিব্যি সুস্থ, পা মাচাতে নাচাতে হিন্দি গান গাইছে–তখন সে শকের মতো পায়; যদি দেখে রোগীর অবস্থা এখন-তখন, শ্বাস যায়—যায় অবস্থা, তখন মনে শান্তি পায়-যাক, কষ্ট করে আসাটা বৃথা যায় নি। কাজেই ফুপার প্রশ্নে আমি চোখমুখ করুণ করে ফেললাম, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এরকম একটা ভাবও করলাম।
জবাব দিচ্ছিস না কেন? অবস্থা কী?
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, ভালো। এখন একটু ভালো।
তোকে খুঁজে বের করতে খুবই যন্ত্রণা হয়েছে, কোন ওয়ার্ড, বেড নাম্বার কী কেউ জানে না।
একবার তো ভেবেছি ফিরেই চলে যাই। নেহায়েত আঙুর কিনেছি বলে যাই নি। আঙুর খেতে নিষেধ নেই তো?
জি না।
নে, আঙুর খা।
আমি টপটপ আঙুর মুখে ফেলছি আর ভাবছি।–ব্যাপারটা কী? আমি যে হাসপাতালে এই খোঁজ ফুপা পেলেন কোথায়? কাউকেই তো জানানো হয় নি। আমি বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না যে খবরের কাগজে নিউজ চলে গেছে–
হিমুর সর্দিজ্বর
জনদরদি দেশনেতা প্ৰাণপ্রিয় হিমু সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় তাঁকে দেখতে যান। কিছুক্ষণ তাঁর শয্যাপার্শ্বে থেকে তাঁর আশু আরোগ্য কামনা করেন। মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বনমন্ত্রী, তেল ও জ্বালানিমন্ত্রী, ত্রাণ উপমন্ত্রী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন–হিমু সাহেবের শারীরিক অবস্থা এখন ভালো। হিমু সাহেবের ভক্তবৃন্দের চাপে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন তাঁরা যেন হিমু সাহেবকে বিরক্ত না করেন। হিমু সাহেবের দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম। তাঁর শরীরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বুলেটিন প্রতিদিন দুপুর বারটায় প্রকাশ করা হবে।
আমি যে হাসপাতালে এই খবর তো আমার কাঁধের দুই ফেরেশতা ছাড়া আর কারোরই জানার কথা না! ধরা যাক খবরটা সবাই জানে, তার পরেও ফুপা হাসপাতালে চলে আসবেন এটা হয় না। এত মমতা আমার জন্যে বাদল ছাড়া আর কারোরই নেই। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা কী?
ফুপা, আমি যে হাসপাতালে এটা জানলেন। কীভাবে? পেপারে নিউজ হয়েছে?
পেপারে নিউজ হবে কেন? তুই কে? হাসপাতাল থেকে আমাকে টেলিফোন করেছে।
আপনার নাম্বার ওরা পেল কোথায়?
তুই দিয়েছিস।
আমার মনে পড়ল কোনো এক সময় হাসপাতালে ভর্তির ফরম তরুণী-ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন। তিনি নিজেই ফিলআপ করেছেন এবং আগ বাড়িয়ে অসুখের খবর দিয়েছেন।
খুব মিষ্টি গলার একজন মেয়ে—ডাক্তার আপনাকে খবর দিয়েছে, তাই না?
হুঁ। তোর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিল।
কী জানতে চাচ্ছিল?
তুই কী করিস না-করিস এইসব। তোর হলুদ পাঞ্জাবি, উদ্ভট কথাবার্তা শুনে ভড়কে গেছে আর কি! তুই আর কিছু পারিস বা না পারিস মানুষকে ভড়কাতে পারিস।
ডাক্তাররা এত সহজে ভড়কায় না। তারপর বলুন ফুপা আমার কাছে কেন এসেছেন?
তোকে দেখতে এসেছি আর কি।
আমাকে দেখতে হাসপাতালে চলে আসবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য না। ঘটনা কী?
বাদলের ব্যাপারে তোর সঙ্গে একটু কথা ছিল।
ফুপা ইতস্তত করে বললেন।
আমি শান্ত গলায় বললাম, বাদলকে নিয়ে তো আপনার এখন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সে কানাডায়। আমার প্রভাব বলয় থেকে অনেক দূরে। আমার হাত থেকে তাকে রক্ষা করার কোনো দায়িত্বও আপনাকে পালন করতে হচ্ছে না। নাকি সে কানাডাতেও খালিপায়ে হাঁটা শুরু করেছে?
ফুপা চাপা গলায় বললেন, বাদল এখন ঢাকায়।
ও আচ্ছা।
মাসখানিক থাকবে। তোর কাছে আমার অনুরোধ এই এক মাস তুই গা-ঢাকা দিয়ে থাকবি। ওর সঙ্গে দেখা করবি না।
গা-ঢাকা দিয়েই তো আছি। হাসপাতালে লুকিয়ে আছি।
হাসপাতালে তো আর এক মাস থাকবি না, তোকে নাকি আজ-কালের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।
আমাকে বাদলের কাছ থেকে এক শ হাত দূরে থাকতে হবে, তাই তো?
হ্যাঁ।
নো প্রবলেম।
শোন হিমু, আমরা চাচ্ছি ওর একটা বিয়ে দিতে। মোটামুটি নিমরাজি করিয়ে ফেলেছি। এখন তুই যদি ভুজং ভাজং দিস তা হলে তো আর বিয়ে হবে না। সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে হাঁটা দেবে।
আমি কোন ভুজং ভাজং দেব?
তোকে দিতে হবে না। তোকে দেখলেই ওর মধ্যে আপনাআপনি ভুজং ভাজং হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে তাকে নরম্যাল করেছি, সব জলে যাবে।
আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকুন।
কথা দিচ্ছিস?
হুঁ।
বাদল এয়ারপোর্টে নেমেই বলেছে—হিমুদা কোথায়? আমি মিথ্যা করে বলেছি, সে কোথায় কেউ জানে না।
ভালো বলেছেন।
মেসের ঠিকানা চাচ্ছিল–তোর আগের মেসের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি।
খুবই ভালো করেছেন, আগের ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে ঠক খাবে।
খোঁজ নিতে এর মধ্যেই গিয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে কী যে দুশ্চিন্তায় আছি! বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। চিন্তাভাবনা যা করার বৌমা করবে।