এখন মধ্যরাত।
আমি দাঁড়িয়ে আছি গলির সামনে। ঐ তো কুকুরগুলি শুয়ে আছে। ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যই আগের মতো–কোনো বেশিকম নেই। যেন আমি সিনেমাহলে বসে আছি। দেখা ছবি দ্বিতীয়বার আমাকে দেখানো হচ্ছে। ঐ রাতে কুকুরগুলির সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। কী কথা বলেছিলাম মনে পড়ছে না। কিছু মনে পড়ছে না।
পড়েছে। মনে পড়েছে। আমি বলে ছিলাম–তারপর, তোমাদের খবর কী? জোছনা কুকুরদের খুব প্রিয় হয় বলে শুনেছি, তোমাদের এই অবস্থা কেন? মনমরা হয়ে শুয়ে আছে।
না, এই বাক্যগুলি বলা যাবে না। কুকুররা এখন আর শুয়ে নেই। ওরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের শরীর শক্ত হয়ে আছে। তারা কেউ লেজ নাড়ছে না। তারা হঠাৎ চমকে উলটো দিকে ফিরল। এখন আর এদের কুকুর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাথরের মূর্তি। আমি যেন হঠাৎ প্রবেশ করছি–প্রাণহীন পাথরের দেশে, যে-দেশে সময় থেমে গেছে। লাঠির ঠকঠক শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আসছে, সে আসছে।
মাথার ভেতরটা টালমাটাল করছে। ফিসফিস করে কে যেন কথা বলছে। গলার স্বর খুব পরিচিত, কিন্তু অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে বলে চিনতে পারছি না। চাপা ও গম্ভীর গলায় কে যেন ডাকছে, হিমু— হিমু!
বলুন, শুনতে পাচ্ছি।
আমি কে বল দেখি!
বুঝতে পারছি না।
আমি তোর বাবা।
আপনি আমার বাবা নন। আপনি আমার অসুস্থ মনের কল্পনা। আমি প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছি বলেই আমার মন আপনাকে তৈরি করেছে। আমাকে সাহস দেবার চেষ্টা করছে।
এইগুলি তো তোর কথা না রে ব্যাটা। এগুলি মিসির আলির হাবিজাবি। তুই চলে আয়। চলে আয় বলছি।
না।
শোন হিমু। তুই তোর মার সঙ্গে কথা বল। এইবার আমি একা আসিনি। তোর মাকে নিয়ে এসেছি।
কেমন আছ মা?
অদ্ভূত করুণ এবং বিষন্ন গলায় কেউ-একজন বলল, ভালো আছি।
মা শোনো— তোমার চেহারা কেমন আমি জানি না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তুমি দেখতে কেমন। তুমি কি জান আমার জন্মের পরপর বাবা তোমার সব ছবি নষ্ট করে ফেলেন যাতে কোনোদিনই আমি জানতে না পারি তুমি দেখতে কেমন ছিলে?
এতে একটা লাভ হয়েছে না? তুই যে-কোনো মেয়ের দিকে তাকাবি তার ভেতর আমার ছায়া দেখবি।
মা, তুমি দেখতে কেমন?
অনেকটা কদম মেয়েটার মতো।
ওকে আমি দেখতে পাইনি।
জানি। হিমু শোন-তুই ঘরে ফিরে যা।
না।
তোর বাবা তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে–তার সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাবে।
লাঠির ঠকঠক আরও স্পষ্ট হলো। মার কথাবার্তা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। লাঠির শব্দ ছাড়া পৃথিবীতে এখন আর কোনো শব্দ নেই। দেখা যাচ্ছে–কুৎসিত ঐ জিনিসটাকে দেখা যাচ্ছে। সেও আমাকে দেখতে পেয়েছে–ঐ তো সে লাঠি উঁচু করল। চাঁদের আলোয় তার ছায়া পড়েনি। একজন ছায়াশূন্য মানুষ।
আমি পা বাড়ালাম। কুকুররা সরে গিয়ে আমার যাবার পথ করে দিল। আমি এগুচ্ছি। আর মাত্র কিছুক্ষণ, তার পরই আমি তার মুখোমুখি হবো। আচ্ছা, শেষবারের কি চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখব—আজ রাতের জোছনাটা কেমন?