কী দেহেন?
আমি চমকে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। বুপড়ির মতো জায়গায় মেয়েটা বসে। আছে। নিশিকন্যাদের একজন। যে-গাছের গুড়িতে সে হেলান দিয়ে আছে সেটা একটা কদমগাছ। আমার প্রিয় গাছের একটি। রুবিয়েসি পরিবারের গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম এনথোসেফালাস কাদাম্বা। গাছটা দেখলেই গানের লাইন মনে পড়ে—বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান।
আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, কী নাম?
সে থু করে থুথু ফেলে বলল, কদম।
আসলেই কি তার নাম কদম? না সে রসিকতা করছে, কদমগাছের নিচে বসেছে। বলে নিজের নাম বলছে কদম? বিচিত্র কারণে এ-ধরনের মেয়েরা রসিকতা করতে পছন্দ করে। পৃথিবী তাদের সঙ্গে রসিকতা করে বলেই বোধহয় খানিকটা রসিকতা তারা পৃথিবীর মানুষদের ফেরত দেয়।
তোমার নাম কদম?
হ।
যখন নারিকেল গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বস। তখন তোমার নাম কী হয়?
নারকেল?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। এখন আর তাকে নিশিকন্যাদের একজন বলে মনে হচ্ছে না। পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরীর মতো লাগছে, সে সন্ধ্যাবেলা একা একা বনে বেড়াতে এসেছে। হাসি খুব অদ্ভুত জিনিস। হাসি মানুষের সব গ্লানি উড়িয়ে নিয়ে যায়।
আমার নাম ছফুরা।
ছফুরার চেয়ে তো কদম ভালো।
আচ্ছা যান, আফনের জন্যে কদম।
একেক জনের জন্যে একেক নাম? ভালো তো!
আফনের ভালো লাগলেই আমার ভালো।
মেয়েটা গাছের নিচ থেকে উঠে এসে আমার পাশে বেঞ্চিতে বসে হাই তুলল। মেয়েটার মুখ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না, তার পরেও মনে হচ্চে দেখতে মায়াকাড়া। কৈশোরের মায়া মেয়েটি এখনও ধরে আছে। বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। কদম শাড়ি পরে আছে। শাড়ির আঁচলে বাদাম। সে বাদাম ভেঙে ভেঙে মুখে দিচ্ছে।
এটু পরে পরে আসমানের দিকে চাইয়া কী দেহেন?
চাঁদ উঠেছে কি না দেখি।
চাঁদের খোঁজ নিতাছেন ক্যান? আফনে কি চাঁদ সওদাগর?
কদম আবারও খিলখিল করে হাসল। আমি মেয়েটির কথার পিঠ কথা বলার ক্ষমতা
দেখে মুগ্ধ হলাম।
রাগ হইছেন?
রাগ হবো কেন?
এই যে আফনেরে নিয়া তামশা করতেছি।
না, রাগ হইনি।
আমার ভিজিট পঞ্চাশ টেকা।
পঞ্চাশ টাকা ভিজিট?
হ।
ভিজিট দেবার সামর্থ্য আমার নেই। এই দ্যাখো পাঞ্জাবির পকেট পর্যন্ত নেই।
পঞ্চাশ টেকা আফনের কাছে বেশি লাগতেছে?
না। পঞ্চাশ টাকা বরং কম মনে হচ্ছে–রমণীর মন সহস্ৰ বৎসরের সখা সাধনার ধন।
আফনের কাছে আসলেই টেকা নাই?
না।
সত্য বলতেছেন?
হ্যাঁ। আর থাকলেও লাভ হতো না।
ক্যান, মেয়েমানুষ আফনের পছন্দ হয় না?
হয়। হবে না কেন?
আমার চেহারাছবি কিন্তু ভালো। আন্ধাইর বইল্যা বুঝতেছেন না। যখন চাঁদ উঠবো–তহন দেখবেন।
তা হলে বসো— অপেক্ষা করো। চাঁদ উঠুক।
আপনের কাছে ভিজিটের টেকা নাই। বইস্যা থাইক্যা ফায়দা কী?
কোনো ফয়দা নেই।
আফনে এইখানে কতক্ষণ থাকবেন?
বুঝতে পারছি না, ভালমতো চাঁদ না ওঠা পর্যন্ত থাকব।
তাইলে আমি এটু ঘুরান দিয়া আসি?
আসার দরকার কী?
আচ্ছা যান আসব না। আমার ঠেকা নাই।
ঠেকা না থাকাই ভালো।
বাদাম খাইবেন?
না।
ধরেন খান। ভালো বাদাম। নাকি খারাপ মেয়ের হাতের জিনিস খান না?
কদম আচলের বাদাম বেঞ্চিতে ঢেলে দ্রুতপায়ে চলে গেল। আমি বসে বসে বাদাম খাচ্ছি। একটা হিসাবনিকাশ করতে পারলে ভালো হতো— আমি আমার একজীবনে কত মানুষের অকারণে মমতা পেয়েছি, এবং কতজনকে সেই মমতা ফেরত দিতে পেরেছি। মমতা ফেরত দেবার অংশগুলি মনে থাকে–মমতা পাবার অংশগুলি মনে থাকে না। কিছুদিন পর মনেই থাকবে না কদম-নামের একটি পথের মেয়ে নিজের অতি কষ্টের টাকায় কেনা বাদাম আমাকে খেতে দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন পথে নামব, ফুটপাতে শুয়ে-থাকা মানুষের দিকে তাকাব, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়বে–বস্তা-ভাই এবং বস্তা-ভাইয়ের পুত্ৰকে আমি একবার একটা মিপিং ব্যাগ উপহার দিয়েছিলাম।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। হলুদ রঙের কুৎসিত একটা চাঁদ। চাঁদটাকে সাজাবার সময় দিতে হবে। তার সাজ সম্পন্ন হোক, তারপর আমি বের হবো। এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি, তার পরেও চোখ থেকে ঘুম যাচ্ছে না। বেঞ্চিতে আবার শুয়ে থাকা যাক। আমি শুয়ে পড়লাম। মশা খুব উৎপাত করছে, তবে কামড়াচ্ছে না। বনের মশারা কামড়ায় না। পার্কের সব বাতি জ্বলে উঠেছে। গাছপালার সঙ্গে ইলেট্রিকের আলো একেবারেই মানায় না। ইলেকট্রিকের আলোয় মনে হচ্ছে গাছগুলির অসুখ করেছে। খারাপ ধরনের কোনো অসুখ।
আমি অপেক্ষা করছি।
কিসের অপেক্ষা? আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি অপেক্ষা করছি কদম-নামের মেয়েটার জন্যে। সে আসবে, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব। আলোর অভাবে তার মুখ ভালো করে দেখা হয়নি। এইবার দেখা হবে। সে কোথায় থাকে সেই জায়গাটাও তো দেখে আসা যায়। মেয়েটার নিজের কি কোনো সংসার আছে? পাইপের ভেতরের একার এক সংসার। যে-সংসার সে খুব গুছিয়ে সাজিয়েছে। পুরানো কালেন্ডারের ছবি দিয়ে চারদিক সাজানো। ছোট্ট ধবধবে সাদা একটা বালিশ। বালিশে ফুল-তোলা। অবসরে সে নিজেই সুই সুতা দিয়ে ফুল তুলে নিজের নাম সই করেছে–কদম।
না, কদম না। মেয়েটার নাম হলো ছফুরা। নামটা কি আমার মনে থাকবে? আজি মধ্যরাতের পর আবারও যদি ফিরে আসি ছাফুরা মেয়েটিকে খুঁজে বের করব। তাকে নিয়ে তার সংসার দেখে আসব। কথাগুলি ময়েটাকে বলে যেতে পারলে ভালো হতো। রাত বাড়ছে, মেয়েটা আসছে না। সে হয়তো আর আসবে না।
কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে কুয়াশা ক্রমেই ঘন হচ্ছে। আমি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালাম।