কী করেছে?
আরে, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা হোটেলের দরজা বন্ধ করে বসা। আমরা এতগুলি মানুষ এসেছি সেদিকে কোনো লক্ষই নেই। ডাইনিংহলে সবাই খেতে বসি, ও খবর পাঠায়–জ্বর জ্বর লাগছে। আসতে পারবে না। খাবার যেন পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমার পেটের ছেলে যে এত নির্লজ হবে ভাবতেই পারি না।
ফুপু!
বল কী বলবি?
সত্যি করে বলুন তো ওদের ভালোবাসা দেখে আনন্দে আপনার মন ভরে গেছে না? কী, কথা বলছেন না কেন? আপনাদের যখন বিয়ে হয়েছিল— আপনি এবং ফুপা–আপনারা কি এই কান্ড করেননি?
আমরা এত বেহায়া ছিলাম না।
আমার তো ধারণা আপনারাও ছিলেন।
তোর ফুপা অনেক বেহায়াপনা করেছে। বুদ্ধিকম মানুষ তো! বাদ দে।
না, বাদ দেব না। আপনারা কী ধরনের বেহায়াপনা করেছেন তার একটা উদাহরণ দিতেই হবে। জাস্ট ওয়ান।
হিমু!
জি ফুপু?
তুই এত ভালো ছেলে হয়েছিস কেন বল তো?
আমি কি ভালো ছেলে?
অবশ্যই ভাল ছেলে। তুই আমার একটা কথা শোন–ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে কর। তারপর তুই বউমাকে নিয়ে নানান ধরনের বেহায়াপনা করবি–আমরা সবাই দূর থেকে দেখে হাসব।
ফুপু রাখি? বলে আমি খট করে রিসিভার রেখে দিলাম। কারণ কথা বলতে বলতে ফুপু কেঁদে ফেলেছেন, এটা আমি বুঝতে পারছি–মাতৃশ্রেণীর মানুষের কান্নাভেজা গলার আহবান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়নি। সেই আহবান এই কারণেই শোনা ঠিক না।
মিসির আলি বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
আমি বললাম, জি না।
দেখে মনে হচ্ছে খুব শরীর খারাপ। আপনি কি কোনো কারণে টেনশান বোধ
করছেন?
স্যার, আজ পূর্ণিমা।
ও আচ্ছা আচ্ছা, বুঝতে পারছি। আপনি তা হলে ভয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন?
জি স্যার।
অপনি যদি চান–আমি অ্যাপনার সঙ্গে থাকতে পারি।
না, আমি চাচ্ছি না।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেছেন?
জি না।
আমার সঙ্গে চারটা খান। খাবার অবিশ্যি খুবই সামান্য। খিচুড়ি আর ডিমভাজা।
খবেন?
জি খাব।
হাতমুখ ধুয়ে আসুন। আমি খাবার সাজাই।
দুজনের মতো খাবার কি আছে?
হ্যাঁ আছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আজ সকালে ঘুম ভেঙেই মনে হলোদুপুরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আপনি আমার এখানে আসবেন। এইসব টেলিপ্যাথিক ব্যাপারের কোনো গুরুত্ব আমি দিই না-তার পরেও দুজনের খাবার রান্না করেছি। কেন বলুন তো?
বলতে পারছি না।
আমাদের মনের একটা অংশ রহস্যময়তায় আচ্ছন্ন। আমরা অনেক কিছুই জানি—তার পরেও অনেক কিছু জানি না। বিজ্ঞান বলছে—“Out of nothing, nothing can be created” তার পরেও আমরা জানি শূণ্য থেকেই এই অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি তৈরি হয়েছে যা একদিন হয়তো-বা শূন্যেই মিলিয়ে যাবে। ভাবলে ভয়াবহ লাগে বলে ভাবি না।
স্যার, আপনার খিচুড়ি খুব ভালো হয়েছে।
ধন্যবাদ। হিমু সাহেব!
জি স্যার?
আপনি যদি মনে করেন। ঐ জিনিসটার মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে না তা হলে বাদ দিন।
এই কথা কেন বলছেন?
বুঝতে পারছি না কেন বলছি। আমার লজিক বলছে–আপনার উচিত ভয়ের মুখোমুখি হওয়া, আবার এই মুহুর্তে কেন জানি মন সায় দিচ্ছেনা। মনে হচ্ছে মস্ত কোনো বিপদ আপনার সামনে।
আমি হাসিমুখে বললাম, এরকম মনে হচ্ছে কারণ আপনি আমার প্রতি একধরনের মায়া অনুভব করছেন। যখন কেউ কারও প্রতি মমতাবোধ করতে থাকে তখনই সে লজিক থেকে সরে আসতে থাকে। মায়া, মমতা, ভালোবাসা যুক্তির বাইরের ব্যাপার।
ভালো বলেছেন।
এটা আমার কথা না। আমার বাবার কথা। বাবার বাণী। তিনি তার বিখ্যাত বাণীগুচ্ছে তার পুত্রের জন্যে লিখে রেখে গেছেন।
আমি কি সেগুলি পড়ে দেখতে পারি?
হ্যাঁ পারেন। আমি বাবার খাতাটা নিয়ে এসেছি আপনাকে দিয়ে যাব। তবে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
আমি যদি কোনোদিন ফিরে না আসি আপনি খাতার লেখাগুলি পড়বেন। আর যদি কাল ভোরে ফিরে আসি, আপনি খাতা না-পড়েই আমাকে ফেরত দেবেন।
খুব জটিল শর্ত তো না।
না, শর্ত আপনার জন্যে জটিল না। আমার জন্যে জটিল।
মিসির আলি হাসলেন নরম গলায় বললেন, ঠিক আছে।
আমি খাওয়া শেষ করে, খাতা তার হাতে দিয়ে বের হলাম। ঘুম পাচ্ছে। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে লম্বা ঘুম দেব যখন জেগে উঠব তখন যেন দেখি চাঁদ উঠে গেছে।
আজ রাতের জোছনাটা কেমন
ঘুম ভেঙে একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমি কোথায় শুয়ে আছি? সবকিছু খুব অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে গহিন কোনো অরণ্যে শুয়ে আছি। চারদিকে সুনসান নীরবতা। খুব হাওয়া হচ্ছে–হাওয়ায় গাছের পাতা কাঁপছে। অসংখ্য পাতা একসঙ্গে কেপে উঠলে যে অস্বাভাবিক শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি হয় সেরকম শব্দ। ব্যাপারটা কী? আমি ধড়মড় করে উঠে বললাম। তাকালাম চারদিকে। না, যা ভাবছিলাম তা না।
আমি সোহরাওয়াদি উদ্যানের একটা পরিচিত বেঞ্চিতেই শুয়েছিলাম। গাছের পাতার শব্দ বলে যা ভাবছিলাম তা আসলে গাড়ি চলাচলের শব্দ। এতবড় ভ্ৰান্তিও মানুষের হয়?
আকাশে চাঁদ থাকার কথা না? কই, চাঁদ দেখা যাচ্ছে তো! পার্ক অন্ধকার। পার্কের বাতি কখন জ্বলবে? ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি পুৰ্ণিমার রাতে শহরের সব বাতি জ্বালায় না। চাঁদই তো আছে–সব বাতি জ্বালানোর দরকার কী? এরকম ভাব।
পূর্ণিমার প্রথম চাঁদ হলুদ বর্ণের থাকে। আকারেও সেই হলুদ। চাঁদটাকে খুব বড় লাগে। যতই সময় যায় হলুদ রঙ ততই কমতে থাকে। একসময় চাঁদটা ধবধবে সাদা হয়ে আবারও হলুদ হতে থাকে। দ্বিতীয়বার হলুদ হবার প্রক্রিয়া শুরু হয় মধ্যরাতের পর। আজ আমার যাত্রা মধ্যরাতে। আমি আবারও চাঁদ দেখার চেষ্টা করলাম।