হুদ হুদ পাখি বলেছিল সেবার রানির কথা। কুইন অব সেবা–বিলকিস।
হুদ হুদ পাখিটা দেখতে কেমন? কাক নয় তো?
কাকটা চায়ের কাপ উলটে ফেলেছে। তার ভাবভঙ্গিতে অপ্ৰস্তুত ভাব লক্ষ্য করছি। কেমন আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে–যেন বলার চেষ্টা করছে, Sir I am Sorry, extremely sorry. I have broken the cup. না, Broken the cup হবে না, কাপ ভাঙে নি, শুধু উলটে ফেলেছে। চায়ের কাপ উলটে ফেলার ইংরেজি কী হবে? রূপাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। শতাব্দী স্টোর থেকে কিছু টেলিফোন করে দিনের শুরুটা করা যাক।
শতাব্দী স্টোরের লোকজন আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনজন এসে জিজ্ঞেস করল, স্যার কেমন আছেন? একজন এসে অতি যত্নে মালিকের ঘরে নিয়ে বসাল। টেলিফোনের চাবি খুলে দিল। আমি বসতে বসতেই কফি চলে এল, সিগারেট চলে এল। পীর-ফকিররা যে কত আরামে জীবনযাপন করেন তা বুঝতে পারছি। শতাব্দী স্টোরে মালিক উপস্থিত নেই, কিন্তু আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
হ্যালো, এটা কি রূপাদের বাড়ি?
কে কথা বলছেন?
আমার নাম হিমু।
রূপা বাড়িতে নেই। বান্ধবীর বাসায় গেছে।
এত সকালে বান্ধবীর বাড়িতে যাবে কীভাবে! এখনও নাটা বাজেনি। রূপা তো আটটার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না।
বলেছি তো ও বাসায় নেই।
আপনি তো মিথ্যা বলছেন। আপনার গলা শুনেই বুঝতে পারছি আপনি একজন দায়িত্বশীল বয়স্ক মানুষ-আপনি দিনের শুরু করেছেন মিথ্যা দিয়ে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? আপনি চাচ্ছেন না, রূপা আমার সঙ্গে কথা বলুক। সেটা বললেই হয়–শুধু শুধু মিথ্য বলার প্রয়োজন ছিল না।
স্টপ ইট।
ঠিক আছে স্যার, স্টপ করছি। রূপাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলামআমার মনে হয় আপনাকে জিজ্ঞেস করলেও হবে। আচ্ছা স্যার, চায়ের কাপ উলটে ফেলার ইংরেজি কী?
খট করে শব্দ হলো। ভদ্রলোক টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তিনি এখন যা করবেন তা হচ্ছে টেলিফোনের প্লাগ খুলে রাখবেন, এবং হয়তো-বা মেয়েকে কোথাও পাঠিয়ে দেবেন। ভদ্রলোককে প্রচুর মিথ্যা কথা আজ সারাদিনে বলতে হবে। মিথ্যা দিয়ে যিনি দিনের শুরু করেন, তাকে দিনের শেষেও মিথ্যা বলতে হয়।
আমি ফুপুর বাসায় টেলিফোন করলাম। ফুপুকে পাওয়া গেল। তিনি রাগে চিড়বিড় করে জ্বলছেন।
কে, হিমু। আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে, শুনেছিস কিছু?
না, কী হয়েছে?
রশিদ হারামজাদাটাকে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম, সে টিভি, ভিসিআর সব নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। আমার আলমিরাও খুলেছে। সেখান থেকে কী নিয়েছে এখনও বুঝতে পারছি না।
মনে হয়। গয়না-টয়না নিয়েছে।
না, গয়না নিতে পারবে না। সব গয়না ব্যাংকের লকারে। ক্যাশ টাকা নিয়েছে। তোর ফুপার একটা বোতলও নিয়েছে। খুব দামি জিনিস নাকি ছিল। তোর ফুপা হায়-হায় করছে।
এই দেখো ফুপু, সব খারাপ দিকের একটা ভালো দিকও আছে। রশিদ আপনার চক্ষুশূল একটা জিনিসও নিয়ে গেছে।
ফজিলামি করিস না–পয়সা দিয়ে একটা জিনিস কেনা।
ফ্রিজে আপনাদের জন্যে চিতলমাছের পেটি রান্না করা ছিল না?
হ্যাঁ, ছিল। তুই জানালি কী করে?
সে এক বিরাট ইতিহাস। পরে বলব, এখন বলুন কক্সবাজারে কেমন কাটল।
ভালোই কাটছিল, মাঝখানে সাদেক গিয়ে উপস্থিত হলো।
মামলা-বিষয়ক সাদেক?
হ্যাঁ। দ্যাখ-না যন্ত্রণা! তাকে ঠাট্টা করে কী না কী বলেছি–সে সত্যি সত্যি মামলাটামলা করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। বেয়াই বেয়ানের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। ছি ছি!
তোমার বেয়াই বেয়ান কেমন হয়েছে?
বেয়াইসাহেব তো খুবই ভালো মানুষ। অসম্ভব রসিক। কথায়-কথায় হাসছিলেন। তোর ফুপার সঙ্গে তার খুবই খাতির হয়েছে। চারজনে মিলে নরক-গুলজার করেছে।
চারজন পেলেন কোথা? ফুপা আর তার বেয়াই দুজন হবে না?
এদের সাথে দুই ছাগলও তো আছে–মোফাজ্জল আর জহিরুল।
এই দুইজন এখনও ঝুলে আছে?
আছে তো বটেই। তবে দুটাকে যত খারাপ ভেবেছিলাম তত খারাপ না।
ভালো কাজ কী করেছে?
সাদেককে শিক্ষা দিয়েছে। আমি তাতে খুব খুশি হয়েছি। সাদেক সবার সামনে মামলা নিয়ে হৈচৈ শুরু করল, ওয়ারেন্ট নাকি বের হয়ে গেছে এইসব। আমি লজ্জায় বাঁচি না। কী বলব কিছু বুঝতেও পারছি না, তখন মোফাজ্জল এসে ঠাস্ করে সাদেকের গালে এক চড় বসিয়ে দিল।
সে কী!
খুবই আকস্মিক ঘটনা, আমি খুব খুশি হয়েছি। উচিত শিক্ষা হয়েছে। ছোটলোকের বাচ্চা–আমাকে মামলা শেখায়!
মোফাজল আর জহিরুল মনে হচ্ছে আপনাদের পরিবারে এন্ট্রি পেয়ে গেছে?
এন্ট্রি পাওয়ার কী আছে! সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, মায়া পড়ে গেছে এটা বলতে পারিস।
আমাদের সর্বনাশ করল। এই মায়া! আমরা বাস করি মায়ার ভেতর আর চেঁচিয়ে বলি আমাদেরকে মায়া থেকে মুক্ত করো।
জ্ঞানের কথা বলবি না হিমু চড় খাবি।
জ্ঞানের কথা না ফুপু। আমার সহজ কথা হচ্ছে মায়া সর্বগ্রাসী। এই যে রশিদ আপনার এত বড় ক্ষতি করল তার পরেও সে যখন মিডল ইষ্ট থেকে ফিরবে, জয়নামাজ, তসবি এবং মিষ্টি তেঁতুল নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবে, আপনি কিন্তু খুশিই হবেন। আপনি হাসিমুখে বলবেন–কেমন আছিস রে রশীদ?
ঐ হারামজাদা কি মিডল ইষ্ট যাচ্ছে?
হ্যাঁ।
তুই এতসব জানালি কি করে?
কী আশ্চর্য, আমি জানব না! আমি হচ্ছি হিমু।
তুই ফাজিল বেশি হয়েছিস। তোকে ধরে চাবকানো উচিত, হাসছিস কেন?
বাদল এবং আঁখি এরা কেমন আছে?
ভালোই আছে। কক্সবাজারে ওরা যে-কাণ্ডটা করেছে–আমার তো লজায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা।