আশরাফুজ্জামান শব্দ করে হাসলেন। আমি বললাম, হাসছেন কেন?
আপনার উদ্ভট কথাবার্তা শুনে হাসছি।
পৃথিবীটা ভয়ংকর উদ্ভট। কাজেই উদ্ভট কাণ্ডকারখানা–মাঝে মধ্যে করা যায়।
সবচে বড় কথা কী জানেন হিমু সাহেব? এখন বাজছে রাত বারোটা! তূর্ণা নিশিথা চলে গেছে।
আমার মনে হচ্ছে যায়নি। লেট করছে।
শুধু শুধু লেট করবে কেন?
লেট করবে–কারণ এই ট্রেনে চেপে এক অভিমানী পিতা আজ রাতে তাঁর কন্যার কাছে যাবেন। আমি নিশ্চিত আজ ট্রেন লেট।
অপনি নিশ্চিত?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। কারণ আমি হচ্ছি হিমু। পৃথিবীর রহস্যময়তা আমি জানি। ট্রেন যে আজ লেট হবে এই বিষয়ে আপনি বাজি ধরতে চান?
হ্যাঁ চাই। বলুন কী বাজি?
ট্রেন যদি সত্যি সত্যি লেট হয় তা হলে আপনি সেই ট্রেনে চেপে বসবেন।
আশরাফুজ্জামান সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কী করবেন। আমি বেবিট্যাক্সির সন্ধানে বের হলাম। দেরি করা যাবে না–অতি দ্রুত কমলাপুর রেলষ্টেশনে পৌঁছতে হবে। আন্তনগর ট্রেন অনন্তকাল কারোর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে না।
ট্রেন লেট ছিল।
আমরা যাবার পনের মিনিট পর ট্রেন ছাড়ল। চলন্ত ট্রেনের জানালা থেকে প্রায় পুরো শরীর বের করে আশরাফুজ্জামান সাহেব আমার দিকে হাত নাড়ছেন। তাঁর মুখভরতি হাসি, কিন্তু গাল আবারও ভিজে গেছে। ভেজা গালে স্টেশনের সরকারি ল্যাম্পের আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে চাঁদের আলো।
আজ পূর্ণিমা
ঘুম ভাঙতেই প্রথম যে-কথাটা আমার মনে হলো তা হচ্ছে–আজ পূর্ণিমা। ভোরের আলোয় পূর্ণিমার কথা মনে হয় না। সূর্য ডোবার পরই মনে হয়–রাতটা কেমন হবে? শুক্লপক্ষ, না কৃষ্ণপক্ষ? আমি অন্যান্যদের মতোই দিনের আলোয় চাঁদের পক্ষ নিয়ে ভাবি না, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার। আজ রাতের চাঁদের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আজ মধ্যরাতে আমি সেই বিশেষ গলিটার সামনে দাঁড়াব। লাঠিহাতের ঐ মানুষটার মুখেমুখি হবো। মিসির আলির ধারণা–সে আর কিছুই না, সাধারণ রোগগ্ৰস্ত একজন মানুষ। কিংবা এক অন্ধ— চাঁদের আলোয় লাঠিহাতে যে বের হয়ে আসে। চাঁদের আলো তাকে স্পর্শ করে না।
আমার ধারণা তা না। আমার ধারণা সে অন্যকিছু। তার জন্ম এই ভুবনে না, অন্য কোনো ভুবনে। সে-ভুবনের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তার জন্ম আলোতে নয়— আদি অন্ধকারে।
জানালার কাছে একটা কাক এসে বসেছে। মাথা ঘুরিয়ে সে আমাকে দেখছে। তার চোখে রাজ্যের কৌতূহল। আমি দিনের শুরু করলাম। কাকের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে।
হ্যালো মিস্টার ক্রো, হাউ আর ইউ?
কাক বলল–কা কা।
তার ধ্বনির অনুবাদ আমি মনে মনে করে নিলাম। সে বলছে, ভালো আছি। তুমি আজ এত ভোরে উঠেছ। কেন? কাঁথাগায়ে শুয়ে থাকো। মানবসম্প্রদায়ে তোমার জন্ম। তুমি মহাসুখীজনদের একজন। খাবারের সন্ধানে সকাল থেকে তোমাকে উড়তে হয় না।।
আমি বললাম, মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক দুঃখ আছে রে পাখি। অনেক দুঃখ।
দুঃখের চেয়ে সুখ বেশি।
জানি না। আমার মনে হয় না।
আমার মনে হয়–এই যে তুমি এখন উঠবে, এক কাপ গরম চা খাবে, একটা সিগারেট ধরাবে–এই আনন্দ আমরা কোথায় পাব! আমাদের তো মাঝে মাঝে চা খেতে ইচ্ছে করে!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তা-ই।
আমি বিছানা থেকে নোমলাম। দুৰ্বকাপ চায়ের কথা বলে বাথরুমে ঢুকলাম। হাতমুখ ধুয়ে নতুন একটা দিনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা। আজকের দিনটা আমার জন্যে একটা বিশেষ দিন। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত আমি পরিচিত সবার সঙ্গে কথা বলব। দিনটা খুব আনন্দে কাটাব। সন্ধ্যার পর দিঘির পানিতে গোসল করে নিজেকে পবিত্র করব— তারপর চাঁদের আলোয় তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। হাতে-মুখে পানি দিতে দিতে দ্রুত চিন্তা করলাম— কাদের সঙ্গে আমি কথা বলব–
রূপা
আজ তার সঙ্গে কথা বলব প্রেমিকের মতো। তাকে নিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটিও করা যেতে পারে। একগাদা ফুল কিনে তার বাড়িতে উপস্থিত হবো। রক্তের মতো লাল রঙের গোলাপ।
ফুপা-ফুপু
তাঁরা কি কক্সবাজার থেকে ফিরেছেন? না ফিরে থাকলে টেলিফোনে কথা বলতে হবে। কক্সবাজারে কোন হোটেলে উঠেছেন। তাও তো জানি না। বড় বড় হোটেল সবকটায় টেলিফোন করে দেখা যেতে পারে।
মিসির আলি
কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব। দুপুরের খাওয়াটা তার সঙ্গে খেতে পারি। তাকে আজ রাতের অ্যাপিয়েন্টমেন্টের কথাটা বলা যেতে পারে…
আচ্ছা, দিঘি কোথায় পাব? ঢাকা শহরে সুন্দর দিঘি আছে না? কাকের চোখের মতো টলটলে পানি?
স্যার চা আনছি। আমি চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। এক কাপ চা জানালার পাশে রেখে দিলাম।— মি. ক্রো যদি খেতে চান খাবেন।
আশ্চৰ্য, কাকটা ঠোঁট ডোবাচ্ছে গরম চায়ে। কক কিক করে কী যেন বলল। ধন্যবাদ দিল বলে মনে হচ্ছে। পশুপাখির ভাষাটা জানা থাকলে খুব ভালো হতো। মজার মজার তথ্য অনেক কিছু জানা যেত। পশুপাখির ভাষা জানাটা খুব কি অসম্ভব? আমাদের এক নবী ছিলেন না যিনি পশুপাখির কথা বুঝতেন? হযরত সুলাইমান আলায়হেস-সালাম। তিনি পাখিদের সঙ্গে কথা বলতেন। কোরআন শরিফে আছে–পিঁপড়েরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে। একটা পাখিও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিল, পাখির নাম হুদ হুদ। সূরা সাদে তার সুন্দর বর্ণনা আছে।
হুদ হুদ পাখি এসে বলল, আমি এমনসব তথ্য লাভ করেছি, যা আপনার জানা নেই। আর আমি সেবা থেকে আসল খবর নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম যে জাতির উপর রাজত্ব করছে। তার সবই আছে, এবং আছে এক বিরাট সিংহাসন।