খাওয়াদাওয়া করেছেন?
জি না। রান্না করিনি।
আপনার কন্যার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?
জি না। ওরা চিটাগাং গেছে। ওর শ্বশুরবাড়ি চিটাগাং।
যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে যায়নি?
আমাকে নেবার জন্যে লোক পাঠিয়েছিল, আমার যেতে ইচ্ছা করছিল না।
আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
কোথায় নিয়ে যাবেন?
তেমন কোথাও না। পথে-পথে হাঁটব। জোছনারাতে পথে হাঁটতে অন্যরকম লাগে,
যাবেন?
জি না।
পথে হাঁটতে হাঁটতে আপনি আপনার মেয়ের গল্প করবেন, আমি শুনব। তার সব গল্প শোনা হয়নি। যাবেন?
আচ্ছা চলুন।
আমরা পথে নোমলাম। ঠিক করে ফেললাম তাকে নিয়ে প্রচুর হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন— শরীর যতই অবসাদগ্ৰস্ত হবে মন ততই হালকা হবে।
হিমু সাহেব!
জি?
আপনি বোধহয় ভাবছেন আমি মেয়ের উপর খুব রাগ করেছি। আসলে রাগ করিনি। কারণ রাগ করব কেন বলুন, আমি তো আসলেই তার বিয়ে ভেঙেছি। উড়োচিঠি দিয়েছি, টেলিফোনে খবর দিয়েছি।
নিজের ইচ্ছায় তো করেননি। আপনার স্ত্রী আপনাকে করতে বলেছেন, আপনি করেছেন।
খুবই সত্যি কথা, কিন্তু আমার মেয়ে বিশ্বাস করে না। তার মার সঙ্গে যে আমার কথাবার্তা হয় এটাও বিশ্বাস করে না।
অল্প বয়সে সবকিছু অবিশ্বাস করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। বয়স বাড়লে ঠিক হয়ে যাবে।
আমার মেয়ের কোনো দোষ নেই। আমার আত্মীয়স্বজনরা ক্রমাগত তার কানে মন্ত্রণা দেয়। আমি যে কী ধরনের মন্দলোক এটা শুনতে শুনতে সেও বিশ্বাস করে।
ফেলেছে।
অপনি মন্দলোক?
ওদের কাছে মন্দ লোক। মেয়ে অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নিই না। নিজে নিজে হোমিওপ্যাথি করি। এইসব আর কী….
ওরা তো জানে না, আপনি যা করেন স্ত্রীর পরামর্শে করেন।
জানে। ওদের বলেছি, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করে না।
মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?
জি না।
আশ্চর্য তো!
আমি নিজেও খুব আশ্চর্য হয়েছি। আজ সন্ধ্যা থেকে ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলাম। সে থাকলে অবশ্যই কথা বলত। সে নেই।
আশরাফুজ্জামান সাহেব, এমনও তো হতে পারে যে তিনি কোনোকালেই ছিলেন না। আপনার অবচেতন মন তাকে তৈরি করেছে। হতে পারে না?
আশরাফুজ্জামান সাহেব জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন।
আশরাফুজ্জামান সাহেব!
জি?
খিদে লেগেছে?
জি।
আসুন খাওয়াদাওয়া করি।
আপনি খান। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখন বাসায় চলে যাব। আপনার সঙ্গে ঘুরতে ভালো লাগছে না। আপনাকে আমি পছন্দ করতাম। কারণ আমার ধারণা ছিল আপনি আমার স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করেন।
আপনার স্ত্রীকে বিশ্বাস করি বা না-করি— আপনাকে তো করি। সেটাই কি যথেষ্ট না?
।না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব হনহন করে এগুচ্ছেন। আমার খুব মায়া লাগছে। রাগ ভাঙিয়ে ভদ্রলোককে রাতের ট্রেনে তুলে দেয়া যায় না? তুর্ণা নিশিতায় তুলে দেব। সেই ট্রেন চিটাগাং পৌছায় ভোেররাতে। আশরাফুজ্জামান সাহেব ট্রেন থেকে নেমে দেখবেন। স্টেশনে তাকে নিতে মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবের সঙ্গে সব গল্পের সুন্দর সুন্দর সমাপ্তি থাকলে ভালো হয়। বাস্তবের গল্পগুলির সমাপ্তি ভালো না। বাস্তবের অভিমানী বাবারা নিজেদের অভিমান এত সহজে ভাঙে না। রূপকথার মতো সমাপ্তি বাস্তবে হয় না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব এক সেকেন্ড দাঁড়ান তো?
আশরাফুজ্জামান সাহেব দাঁড়ালেন। আমি দৌড়ে তাকে ধরলাম।
চলুন আপনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দি।
দরকার নেই। আমি বাসা চিনে যেতে পারব।
আপনার জন্যে বলছি না। আমি আমার নিজের জন্যে বলছি। আমার একটা সমস্যা হয়েছে, আমি একা একা রাতে হাঁটতে পারি না। ভয় পাই।
আশরাফুজ্জামান সাহেব শান্তগলায় বললেন, চলুন যাই।
আমরা হেঁটে হেঁটে ফিরছি, কেউ কোনো কথা বলছি না। আশরাফুজ্জামান সাহেবের গাল চকচক করছে। তিনি কাঁদছেন। কান্নাভেজ গালে চাঁদের ছায়া পড়েছে।
চোখের জলে চাঁদের ছায়া আমি এই প্রথম দেখছি। অদ্ভুত তো! ভেজা গালে চাদের আলো নিয়ে কি কোনো কবিতা হয়েছে? কোনো গান?
আশরাফুজ্জামান সাহেব!
জি।
মেয়ের উপর রাগ কমেছে?
ওর উপর আমার কখনো রাগ ছিল না। আচ্ছা হিমু সাহেব, আজ কি পূর্ণিমা?
জি না। আজ পূর্ণিমা না। পূর্ণিমার জন্যে আপনাকে আরও তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে।
মেয়েটা কষ্ট পাবে। মেয়েটা ভাববে তার উপর রাগ করে বিষ খেয়েছি।
তাকে সুন্দর করে গুছিয়ে একটা চিঠি লিখে যাবেন। ভালোমতো সব ব্যাখ্যা করবেন, তা হলেই হবে। তার পরেও কষ্ট পাবে। সেই কষ্ট দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
দীর্ঘস্থায়ী হবে না কেন?
আপনার মেয়ে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তার সংসারে ছেলেপুলে আসবে। কারও হাম হবে, কারোর হবে কাশি। ওদের বড় করা, স্কুলে ভরতি করানো, হোমওয়ার্ক করানো, ঈদে নুতন জামা কেনা, অনেক ঝামেলা। দোকানের পর দোকান দেখা হবে, ফ্রকের ডিজাইন পছন্দ হবে না। এত সমস্যার মধ্যে কে আর বাবার মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাবে!
আশরাফুজ্জামান সাহেব হেসে ফেললেন। সহজ স্বাভাবিক হাসি। মনে হচ্ছে তার মন থেকে কষ্টবোধ পুরোপুরি চলে গেছে।
হিমু সাহেব!
জি?
আপনি মানুষটা খুব মজার।
মজার মানুষ হিসেবে আপনাকে মজার একটা সাজেশান দেব?
দিন।
চলুন আমরা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাই। আপনি তূর্ণা নিশিথায় চেপে বসুন। অন্ধকার থাকতে থাকতে চিটাগাং রেলস্টেশনে নামবেন। নেমেই দেখবেন আপনার মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের চোখভরতি জল। সে ছুটে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরবে।