তারপর?
আপনি শুনলেন লাঠি ঠকঠক করে কে যেন আসছে। আপনি যদি স্বাভাবিক থাকতেন তা হলে কিন্তু লাঠির ঠকঠক শব্দ শুনে ভয়ে অস্থির হতেন না। লাঠি ঠকঠক করে কেউ আসতেই পারে। আপনি খুবই অস্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন বলেই এই কাণ্ডটা ঘটেছে। আপনার মস্তিষ্ক অসম্ভব উত্তেজিত। সে বিচিত্র খেলা শুরু করেছে। আপনার স্বাভাবিক দৃষ্টি সে এলোমেলো করতে শুরু করেছে। আপনি মানুষটা দেখলেন। চাদরগায়ে একজন মানুষ যার চোখ নেই, মুখ নেই। ঠিক না?
জি।
আমার ধারণা। আপনি অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া একজন অন্ধকে দেখেছেন। অন্ধ বলেই সে লাঠি-হাতে হাঁটাচলা করে। আপনাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাঠি উঁচু করল। আপনার দিকে। একজন অন্ধের পক্ষে আপনার উপস্থিতি বুঝতে পারা কোনো ব্যাপার না। অন্ধদের ইন্দ্ৰিয় খুব তীক্ষ্ণ থাকে। অবিশ্যি অন্ধ না হয়ে একজন কুণ্ঠরোগীও হতে পারে। কুণ্ঠরোগীও এমন বিকৃত হতে পারে। আমি নিজে কয়েকজনকে দেখেছি।
আমি বললাম, স্যার একটা কথা, আমি দেখেছি মানুষটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন তাকে খুব লম্বা দেখাচ্ছিল।
আপনি যা দেখেছেন তা আর কিছুই না, লাইট অ্যান্ড শেডের একটা ব্যাপার। গলিতে একটা মানুষকে দাঁড় করিয়ে আপনি বিভিন্ন জায়গা থেকে আলো গায়ে ফেলে পরীক্ষাটা করতে পারেন। দেখবেন আলো কোথেকে ফেলছেন, এবং সেই আলো ফেলার জন্যে তারা ছায়া কত বড় হচ্ছে তার উপর নির্ভর করছে তাকে কত লম্বা মনে হচ্ছে। একে বলে optical illusion–ম্যাজিসিয়ানরা optical illusion-এর সাহায্যে অনেক মজার মজার খেলা দেখান।
পুরো ব্যাপারটা আপনার কাছে এত সহজ মনে হচ্ছে?
জি মনে হচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত জটিল সূত্রগুলির মূল কথা খুব সহজ। আপনি যে আপনার মাথার ভেতর শুনলেন কে বলছে ফিরে যাও, ফিরে যাও–তার ব্যাখ্যাও খুব সহজ ব্যাখ্যা। আপনার অবচেতন মন আপনাকে ফিরে যেতে বলছিল।
আমি কি আপনার সব ব্যাখ্যা গ্ৰহণ করে নেব, না নিজে পরীক্ষা করে দেখব?
সেটা আপনার ব্যাপার।
আমার কেন জানি মনে হয় ঐ জিনিসটার মুখোমুখি দাঁড়ানো মানে আমার মৃত্যু—সে আমাকে ছাড়বে না।
তা হলে তো আপনাকে অবশ্যই ঐ জিনিসটার মুখোমুখি হতে হবে।
যদি না হই?
তা হলে সে আপনাকে খুঁজে বেড়াবে। আজ একটা গলিতে সে আছে। কাল চলে আসবে রাজপথে। একটি গলি যেমন আপনার জন্যে নিষিদ্ধ হয়েছে, তেমনি শুরুতে একটা রাজপথও আপনার জন্যে নিষিদ্ধ হবে, তারপর আরও একটা। তারপর একসময় দেখবেন শহরের সমস্ত পথঘাট নিষিদ্ধ হয়ে গেল। আপনাকে শেষ পর্যন্ত ঘরে আশ্রয় নিতে হবে। সেখানেও যে স্বস্তি পাবেন তা না–মাঝরাতে হঠাৎ মনে হবে। দরজার বাইরে ঐ অশরীরী দাঁড়িয়ে, দরজা খুললেই সে ঢুকবে…
আমি চুপ করে রইলাম।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আপনার বাবা বেঁচে থাকলে তিনি আপনাকে কী উপদেশ দিতেন?
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, আপনি যে উপদেশ দিচ্ছেন সেই উপদেশই দিতেন। আচ্ছা স্যার, আজ উঠি।
উঠবেন? আচ্ছা–কফির জন্যে ধন্যবাদ।
একটা কথা জিজ্ঞেস করি, মানুষের কি থট রিডিং আছে?
থাকতে পারে। পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের এই ক্ষমতা সম্ভবত আছে। ডিউক ইউনিভার্সিটিতে একবার একটা গবেষণা করা হয়েছিল। পঞ্চাশটা ইঁদুরকে দুটা থালায় করে খাবার দেয়া হতো। একটা থালায় নাম্বার এবং অন্যটার নাম্বার শূন্য। খাবার দেবার সময় মনে মনে ভাবা হতো শূন্য নাম্বার থালার খাবার যে-ইঁদুর খাবে তাকে মেরে ফেলা হবে। দেখা গেল শূন্য নাম্বার থালার খাবার কোনো ইঁদুর স্পর্শ করছে না। অথচ একই খাবার।
আপনার ধারণা ইঁদুর মানুষের মনের কথা বুঝত বলেই এটা করত?
হতে পারে।
আপনি থটরিডিং-এর ক্ষমতা আছে এমন কোনো মানুষের দেখা পাননি?
পেয়েছি। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি। নিশ্চিত হতে ইচ্ছাও করেনি। থাকুক-না কিছু রহস্য!
স্যার যাই।
আচ্ছা।
মিসির আলি সাহেব আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
আমি রাস্তায় নেমে দেখলাম সুন্দর জোছনা হয়েছে।
কোথায় যাওয়া যায়?
কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। পথে-পথে হাঁটতেও ভালো লাগছে না। ভ্রমণের নেশায় মাতাল ভূপৰ্যটকও কি একসময় ক্লান্ত হয়ে বলেন হাঁটতে ভালো লাগছে না? পরম শ্ৰদ্ধেয় সাধু যিনি প্রতি সন্ধ্যায় মুণ্ডিত মস্তকে বৎসদের নানান জ্ঞানের কথা বলেন। তিনিও কি একসময় ক্লান্ত হয়ে বলেন, আর ভালো লাগছে না? মানুষের শরীর যন্ত্রের দুটি তার একটিতে ক্ৰমাগতই বাজে–ভালো লাগছে, ভালো লাগছে— অন্যটিতে বাজে ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না। দুটি তার একসঙ্গেই বাজতে থাকে। একটি উঁচুস্বরে উঁচুসপ্তকে অন্যটি মন্ত্রসপ্তকে। কারও কারও কোনো একটি তার ছিঁড়ে যায়। আমার বেলায় কী হচ্ছে? ভালো লাগছে তারটি কি ছিঁড়ে গেছে?
ঘরে ফিরে যাব? চারদেয়ালে নিজেকে বন্দি করে ফেলব? সেই ইচ্ছাও করছে না। আমি আশরাফুজ্জামান সাহেবের সন্ধানে রওনা হলাম। তিনি কি কন্যার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছেন? মনে হয় না। অতি আদরের মানুষের অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষ বড়ই অভিমানী প্ৰাণী।
আশরাফুজ্জামান সাহেব বাসাতেই ছিলেন। আমাকে দেখে যন্ত্রের মতো গলায় বললেন, কেমন আছেন?
আমি বললাম, ভালো আছি। আপনি কী করছেন?
কিছু করছি না। শুয়ে ছিলাম।
শরীর খারাপ?
জি না, শরীর খারাপ না। শরীর ভলো।