হ্যাঁ, হয়েছে।
তা হলে আমাকে রান্নাঘরে যাবার অনুমতি দিন, আমি আপনার জন্যে কফি বানিয়ে নিয়ে আসি।
আসুন আমার সঙ্গে।
আমি মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরটা আমার পছন্দ হল। মনে হচ্ছে রান্নাঘরটাই আসলে তার লাইব্রেরি। তিনটা উঁচু বেতের চেয়ার, শেলফভরতি বই। রান্না করতে করতে হাত বাড়ালেই বই পাওয়া যায়। রান্নাঘরে একটা ইজিচেয়ারও আছে। ইজিচেয়ারের পায়ের কাছে ফুটরেস্ট। বোঝাই যাচ্ছে ফুটরেস্টে পা রেখে আরাম করে বই পড়ার ব্যবস্থা।
মিসির আলি চুলা ধরাতে ধরাতে বললেন, রান্নাঘরে এত বইপত্র দেখে আপনি কি অবাক হচ্ছেন?
জি না। আমি কোনোকিছুতেই অবাক হই না।
আসলে কী হয় জানেন? হয়তো চা খাবার ইচ্ছা হলো। চুলায় কেতলি বসালাম। পানি ফুটতে অনেক সময় লাগছে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে খুব খারাপ লাগে। তখন বই পড়া শুরু করি। চুলায় কেতলি বসিয়ে আমি একুশ পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে পানি ফুটে যায়। এই থেকে আপনি আমার বই বড়ার স্পিড সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন।
আমরা কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। মিসির আলি বললেন, আপনার গলায় কি মাছের কাঁটা ফুটেছে? লক্ষ্য করলাম অকারণে ঢোক গিলছেন।
আমি বললাম, জি।
শুধু শুধু কষ্ট করছেন কেন? কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন–মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে গেলেই ওরা চিমটা দিয়ে কাঁটা তুলে ফেলবে।
আমি কাঁটার যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করছি। মানুষ তো ক্যানসারের মতো ব্যাধিও শরীরে নিয়ে বাস করে, আমি কাঁটা নিয়ে পারব না?
মিসির আলি হাসলেন। ছেলেমানুষি যুক্তি শুনে বয়স্করা যে-ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি। দেখতে ভালো লাগে।
হিমু সাহেব!
জি স্যার?
আমি আপনার ভয় পাবার ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি।
রহস্যের সমাধান হয়েছে?
ভয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। এইটিই সঠিক ব্যাখ্যা কি
না তা প্ৰমাণসাপেক্ষ। ব্যাখ্যা শুনতে চান?
বলুন।
মিসির আলি কফির কাপ নামিয়ে সিগারেট ধরালেন। সামান্য হাসলেন। সেই হাসি অতি দ্রুত মুছেও ফেললেন। কথা বলতে শুরু করলেন শান্ত গলায়। যেন তিনি নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, অন্য কারোর সঙ্গে নয়। যেন তিনি যুক্তি দিয়ে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছেন–
হিমু সাহেব, আমার ধারণা যে–ভয়ের কথা। আপনি বলছেন–এই ভয় অতি শৈশবেই আপনার ভেতর বাসা বেঁধেছে। কেউ-একজন হয়তো এই ভয়ের বীজ। আপনার ভেতর পুতে রেখেছিল যাতে পরবর্তী কোনো একসময় বীজের অন্ধুরোদগম হয়। তীব্র ভয় আপনাকে আচ্ছন্ন করে।
অতি শৈশবের তীব্র ভয় অনেক অনেককাল পরে ফিরে আসে। এটা একটা রিকারিং ফনোমেনা। মনে করুন। তিন বছরের কোনো শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেল তাকে শেষমূহুর্তে পানি থেকে উদ্ধার করা হলো। সে বেঁচে গেল। পানিতে ডোবার ভয়ংকর স্মৃতি তার থাকবে না। সে স্বাভাবিকভাবে বড় হবে। কিন্তু ভয়ের এই অংশটি কিন্তু তার মাথা থেকে যাবে না। মস্তিস্কের স্মৃতি-লাইব্রেরিতে সেই স্মৃতি জমা থাকবে। কোনো কারণে যদি হঠাৎ সেই স্মৃতি বের হয়ে আসে তা হলে তার সমগ্ৰ চেতনা প্রচণ্ড নাড়া খাবে। সে ভেবেই পাবে না, ব্যাপারটা কী। আপনি কি শৈশবে কখনো পানিতে ডুবেছেন?
হ্যাঁ, চৌবাচ্চায় ডুবে গিয়েছিলাম।
ঘটনাটা বলুন তো!
ঘটনা আমার মনে নেই। বাবার ডায়েরি পড়ে জেনেছি। আমার বাবা আমাকে নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। মৃত্যুভয় কী এটা আমাকে বোঝানোর জন্যে তিনি একটা ভয়ংকর পরীক্ষা করেছিলেন। চৌবাচ্চায় ভরতি করে আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তার হাতে ছিল স্টপওয়াচ। তিনি সটপাওয়াচ দেখে পচাত্তর সেকেন্ড আমাকে পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলেন।
আপনার বাবা কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন?
একসময় আমার মনে হতো। তিনি মানসিক রোগী। এখন তা মনে হয় না। বাবার কথা থাক। আপনি আমার সম্পর্কে বলুন। আমি মানসিক রোগী কি না সেটা জানা আমার পক্ষে জরুরি।
অতি শৈশবের একটা তীব্র ভয় আপনার ভেতর বাসা বেঁধে ছিল। আমার ধারণা সেই ভয়ের সঙ্গে আরও ভয় যুক্ত হয়েছে। মস্তিস্কের মেমোরি সেলে ভয়ের ফাইল ভারি হয়েছে। একসময় আপনি সেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করেছেন। তখনই ভয়টা মূর্তিমান হয়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়েছে। সে চাচ্ছে না। আপনি তাকে অস্বীকার করুন।
স্যার, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন— ঐ রাতে আমি যা দেখেছি সবই আমার কল্পনা?
না। বেশির ভাগই সত্যি। তবে সেই সত্যটাকে কল্পনা ঢেকে রেখেছে।
বুঝতে পারছি না।
আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি। ঐ রাতে আপনি ছিলেন খুব ক্লান্ত। আপনার স্নায়ু ছিল অবসন্ন।
খুব ক্লান্ত ছিলাম, স্নায়ু অবসন্ন ছিল বলছেন কেন?
আপনার কাছ থেকে শুনেই বলছি। সারারাত আপনি হেটেছেন। জোছনা দেখেছেন। তারপর ঢুকলেন গলিতে। দীর্ঘ সময় কোনো-একটি বিশেষ জিনিস দেখায় ক্লান্তি আসে। স্নায়ু অবসন্ন হয়।
ঠিক আছে বলুন।
আপনাকে দেখে কুকুররা সব দাঁড়িয়ে গেল। একটি এগিয়ে এল সামনে, তা-ই না?
জি।
কুকুরদের দলপতি। আবার ঐ ভয়ংকর মূর্তি যখন এল তখন কুকুররা তার দিকে ফিরল। দলপতি এগিয়ে গেল সামনে। দেখুন। হিমু সাহেব, কুকুররা যা করেছে তা হচ্ছে কুকুরদের জন্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। তারা উদ্ভট কিছু করেনি। অথচ তাদের এই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডই আপনার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। কারণ আপনি নিজে স্বাভাবিক ছিলেন না। আপনার মধ্যে একধরনের ঘোর কাজ করা শুরু করেছে। শৈশবের সমস্ত ভয় বাক্স ভেঙে বের হয়ে আসা শুরু করেছে।