তা হলে আজ উঠি।
আচ্ছা যান। আপনারে যে-খেলা দেখলাম তার জন্যে নজরানা দিবেন না? একশো
টাকার নোটটা রেখে যান!
শুনছিলাম। আপনি টাকা পয়সা নেন না।
সবার কাছ থেকে নেই না। আপনার কাছ থেকে নিব।
কেন?
সেটা বলব না। সবেরে সবকিছু বলতে নাই। আচ্ছা এখন যান। একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি–আর না।
দেখবেন?
ময়লা-বাবা আবারও অপ্রকৃতিস্থের হাসি হাসতে শুরু করলেন। আমি একশো টাকার নোটটা তার পায়ের কাছে রেখে চলে এলাম। ময়লা-বাবার ব্যাপারটা নিয়ে মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। সবচে ভালো হতো যদি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা যেত। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। মিসির আলি-টাইপের মানুষ সহজে কৌতূহলী হন না। এরা নিজেদের চারপাশে শক্ত পাঁচিল তুলে রাখেন। পাঁচিলের ভেতর কাউকে প্রবেশ করতে দেন না। এ-ধরনের মানুষদের কৌতূহলী করতে হলে পাঁচিল ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হয়— সেই ক্ষমতা বোধহয় আমার নেই।
তবু একটা চেষ্টা তো চালাতে হবে। ময়লা-বাবার ক্ষমতাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে দেখা যেতে পারে। লাভ হবে বলে মনে হয় না। অনেক সময় নিয়ে মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি বিভ্রান্ত হবার মানুষ না, তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?
আমি জবাব দিচ্ছি না
কে?
আমি জবাব দিচ্ছি না, চুপ করে আছি। দ্বিতীয়বার কে বললে জবাব দেব। মিসির আলি দ্বিতীয়বার কে বলবেন কি না বুঝতে পারছি না। আগের বার বলেননি–সরাসরি দরজা খুলেছেন। আজ আমি মিসির আলি সাহেবের জন্যে উপহার নিয়ে এসেছি। এক পট ব্রাজিলিয়ান কফি। ইভাপেরেটেড মিল্কের একটা কোটা এবং এক বাক্স সুগার কিউবাস। কফি বানিয়ে চায়ের চামচে মেপে মেপে চিনি দিতে হবে না। সুগার কিউব ফেলে দিলেই হবে। একটা সুগার কিউব মানে এক চামচ চিনি। দুটা মানে দু-চামচ।
উপহার আনার পেছনে ইতিহাসটা বলা যাক। শতাব্দী স্টোরে আমি গিয়েছিলাম টেলিফোন করতে। এমনিতে শতাব্দী লোকজনদের ব্যবহার খুব ভালো, শুধু টেলিফোন করতে গেলে খারাপ ব্যবহার করে। টেলিফোন নষ্ট, মালিকের নিষেধ আছে, চাবি নেইনানান টালবাহানা করে। শেষ পর্যন্ত দেয়। তবে টেলিফোন শেষ হওয়ামাত্র বলে, পাঁচটা টাকা দেন। কল চার্জ। আজও তা-ই হলো। আমি হাতের মুঠা থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করলাম।
ভাংতি দেন।
ভাংতি নেই। আর শুনুন, আপনাকে টাকা ফেরত দিতে হবে না। এখন যে-কলটা করেছি। সেটা পাঁচশো টাকা দামের কল। আমার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছি, ওর নাম রূপা। আরেকটা কথা শুনুন ভাই–আমি যতবার আপনাদের এখান থেকে রূপার সঙ্গে কথা বলব ততবারই আপনাদের পাঁচশো করে টাকা দেব। তবে অন্য অন্য কলে আগের মতো পাঁচ টাকা। ভাই যাই?
বলে আমি হন।হন করে পথে চলে এসেছি— দোকানের এক কর্মচারী এসে আমকে ধরল। শতাব্দী স্টোরের মালিক ডেকেছেন। আমাকে যেতেই হবে, না গেলে তার চাকরি থাকবে না।
আমি মালিকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে ফিরে গেলাম। নিতান্ত অল্পবয়েসি একটা ছেলে। গোলাপি রঙের হাওয়াই শার্ট পরে বসে আছে। সুন্দর চেহারা। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক হিসেবে তাকে মানাচ্ছে না। তাকে সবচে মানাত যদি টিভি সেটের সামনে বসে ক্রিকেট খেলা দেখত এবং কোনো ব্যাটসম্যান ছক্কা মারলে লাফিয়ে উঠত।
শতাব্দী স্টোরের মালিক আমাকে অতি যত্নে বসাল। কফি খাওয়াল। আমি কফি খেয়ে বললাম, অসাধারণা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতোই অসাধারণ।
সে বলল, কোন কবিতা?
আমি আবৃত্তি করলাম
“পুরানো পেঁচারা সব কোটরের থেকে
এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে
মাঠের মুখের পরে,
সবুজ ধানের নিচে–মাটির ভিতরে
ইঁদুরেরা চলে গেছে–আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা,
শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা।“
শতাব্দী স্টোরের মালিক তাঁর এক কর্মচারীকে ডেকে বলল, ওনাকে সবচে ভালো কফি একটিন দাও, ইভাপেরেটেড দুধের একটা টিন, সুগার কিউব দাও।
আমি থ্যাংকস বলে উপহার গ্রহণ করলাম। তারপর ছেলেটা বলল, এখন থেকে দোকানে উনি এলে প্ৰথম জিজ্ঞেস করবে। ওনার কী লাগবে। যা লাগবে দেবে। কোনো বিল করতে পারবে না। উনি ঢোকামাত্র আমার ঘরে নিয়ে যাবে। সেখানে টেলিফোন আছে। উনি যত ইচ্ছা টেলিফোন করতে পারবেন।
ব্যবসায়ী মানুষ (তার বয়স যত অল্পই হোক) এমন ফ্রী পাশ দেয় না। আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। ছেলেটা বলল, আমি আপনাকে চিনি। আপনি হিমু। দোকানের লোকজন আপনাকে চিনতে পারেনি–ওদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। এখন বলুন আপনি কোথায় যাবেন। ড্রাইভার আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
ড্রাইভার আমাকে মিসির আলির সাহেবের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি কড়া নেড়ে অপেক্ষা করছি কখন মিসির আলি সাহেব দরজা খোলেন। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তে ইচ্ছা করছে না। সাধারণ মানুষের বাসা হলে কড়া নাড়তাম, এই বাসায় থাকেন। মিসির আলি–কিংবদন্তি পুরুষ। প্রথম কড়া নাড়ার শব্দেই তার বুঝে যাবার কথা কে এসেছে, কেন এসেছে।
দরজা খুলল। মিসির আলি সাহেব বললেন, কে? হিমু সাহেব?
জি স্যার।
মাথা কামিয়েছেন। আপনাকে ঋষি-ঋষি লাগছে।
আমি ঋষিসুলভ হাসি হাসলাম। তিনি সহজ গলায় বললেন, আজ এত সকালসকাল এসেছেন, ব্যাপার কী? রাত মোটে নটা বাজে। হাতে কী?
আপনার জন্যে সামান্য উপহার। কফি, দুধ, চিনি।
মিসির আলি সাহেবের চোখে হাসি বিলিক দিয়ে উঠল। আমি বলললাম, স্যার, আপনার রাতের খাওয়া কি হয়ে গেছে?