তাও ঠিক।
মেয়ের ছবি দেখবেন?
নিশ্চয়ই দেখব।
সব ছবি দেখতে সময় লাগবে। শত শত ছবি আমি তুলেছি। একসময় ফটোগ্রাফির শখ ছিল। এখনও আছে। নিয়ে আসব?
আনুন।
সব মিলিয়ে পঁচিশটা অ্যালবাম।
পঁচিশটা অ্যালবাম!
জি, একেক বছরের জন্যে একেকটা। আসুন আলবাম দেখি। আমি মেয়েকে বলেছি, মা শোন, এই বাড়ি থেকে তুই সবকিছু নিয়ে যা, শুধু অ্যালবামগুলি নিতে পারবি না।
আমরা অ্যালবাম দেখা শুরু করলাম। ছবির উপর দিয়ে শুধু যে চোখ বুলিয়ে যাব সে-উপায় নেই–প্রতিটি ছবি আশরাফুজ্জামান সাহেব ব্যাখ্যা করছেন–
যে-ফ্রকটা পরা দেখছেন, তার একটা সাইড ছেঁড়া আছে। মীরার খুব প্রিয় ফ্রক। ছিঁড়ে গেছে, তার পরেও পরবে। থুতনিতে কাটা দাগ দেখতে পাচ্ছেন না? বাথরুমে পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছিল। রক্তারক্তি কাণ্ড। বাসায় গাদ্দাফুল ছিল। সেই ফুল কচলে দিয়ে রক্ত বন্ধ করেছে।
আমরা ভোর চারটা পর্যন্ত সাতটা অ্যালবাম শেষ করলাম। অষ্টম অ্যালবাম হাতে নিয়ে বললাম, আশরাফুজ্জামান সাহেব, কাপড় পরুন তো!
তিনি চমকে উঠে বললেন, কেন?
আমি বললাম, আমার ধারণা আপনার কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে।
কী বলছেন এসব?
মাঝে মাঝে আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি।
আশরাফুজ্জামান সাহেব কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে উঠে গিয়ে পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন।
আমরা ভোর পাঁচটায় ধানমণ্ডিতে মেয়ের মামার বাড়িতে পৌঁছলাম। দেখা গেল আসলেই মীরার বিয়ে হয়ে গেছে। রাত দশটায় কাজি এনে বিয়ে পড়ানো হয়েছে।
আমি বলরাম, মেয়ের বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে, ব্যাপারটা কী?
মেয়ের মামা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, আপনি বাইরের মানুষ, আপনাকে কী বলব, না বলেও পারছি না–মেয়ের বিয়ে ভেঙে যেত তার বাবার কারণে। উনিই পাত্ৰপক্ষকে উড়ো চিঠি দিতেন। টেলিফোনে নিজের মেয়ের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে বিয়ে ভাঙতেন। বিয়ের পর মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাবে এটা সহ্য করতে পারতেন না। উনি খানিকটা অসুস্থ। আমরা যা করেছি উপায় না দেখেই করেছি।
আশরাফুজ্জামান সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। আমি তাকে রেখে নিঃশব্দে চলে এলাম। সকালবেলায় হাঁটার অন্যরকম আনন্দ।
ময়লা-বাবার আস্তানা কুড়াইল গ্রামে
ময়লা-বাবার আস্তানা কুড়াইল গ্রামে। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে রিকশায় দু-কিলোমিটার যেতে হয়। তারপর হন্টন। কাঁচা রাস্তা ক্ষেতের আইল সব মিলিয়ে আরও পাঁচ কিলোমিটার। মহাপুরুষদের দেখা পাওয়া সহজ ব্যাপার না।
বাবা হিসেবে তাঁর খ্যাতি এখনও বোধহয় তেমন ছড়ায়নি। অল্পকিছু ভক্ত উঠোনে শুকনোমুখে বসে আছে। উঠোনে চাটাই পাতা, বসার ব্যবস্থা। উঠেন এবং টিনের বারান্দা সবই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। যে-বাবা সারাগায়ে ময়লা মেখে বসে থাকেন তার ঘরদুয়ার এমন ঝকঝকে কেন–এই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই মনে আসে।
আমার পাশে একজন হাঁপানির রোগী। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। দেখে মনে হয়। সময় হয়ে এসেছে, চোখমুখ উলটে এক্ষুনি ভিরমি খাবে। আমি তাতে বিভ্রান্ত হলাম না।। হাঁপানি রোগীকে যত সিরিয়াসই দেখাক এরা এত সহজে ভিরমি খায় না। রোগী
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আপনার সমস্যা কী?
সমস্যা কিছু না, ময়লা-বাবাকে দেখতে এসেছি। আপনি রোগ সারাতে এসেছেন?
জি।
বাবার কাছে এই প্রথম এসেছেন?
জি।
আর কোনো বাবার কাছে যাননি? বাংলাদেশে তো বাবার অভাব নেই।
কেরামতগঞ্জের ন্যাংটা বাবার কাছে গিয়েছিলাম।
লাভ হয়নি?
বাবা আমার চিকিৎসা করেন নাই।
ইনি করবেন?
দেখি, আল্লাহপাকের কী ইচ্ছা।
রোগীর হাঁপানির টান বৃদ্ধি পেল। আমি চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলাম। মানুষের কষ্ট দেখা কষ্টের। হাঁপানি রোগীর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সুস্থ মানুষেরও নিশ্বাসের কষ্ট হয়।
সকাল এগারোটার মতো বাজে। বাবার দেখা নেই। উঠোনে রোদ এসে পড়েছে। গা চিড়বিড় করছে। ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাবার খাদেমদের তৎপরতা চোখে পড়ছে। তারা ছেলেদের এক জায়গায় বসাচ্ছে, মেয়েদের এক জায়গায় বসাচ্ছে। সবারই উঠোনে চাটাইয়ে বসতে হচ্ছে, তবে চাটাইয়ের মাঝামাঝি চুনের দাগ দেয়া। এই দাগ আগে চোখে পড়েনি। চোখে সুরমা-দেয়া মেয়ে-মেয়ে চেহারার এক খাদেমকে নিচুগলায় বললাম, ময়লা-বাবা টাকা পয়সা কী নেন?
খাদেম বিরক্তমুখে বলল, বাবা টাকা পয়সা নেন না।
টাকা পয়সা না নিলে ওনার চলে কীভাবে?
ওনার কীভাবে চলে সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।
আপনাদেরও তো খরচপাতি আছে। এই যে চোখে সুরমা দিয়েছেন, সেই সুরমাও তো নগদ পয়সায় কিনতে হয়। বাবার জন্যে কিছু পয়সাকড়ি নিয়ে এসেছি, কার কাছে দেব বলেন।
বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন।
উনি দর্শন দেবেন কখন?
জানি না। যখন সময় হবে উনি একজন একজন করে ডাকবেন।
সিরিয়ালি ডাকবেন? যে আগে এসেছে সে আগে যাবে?
বাবার কাছে কোনো সিরিয়াল নাই। যাকে ইচ্ছা বাবা তাকে আগে ডাকেন। অনেকে আসে বাবা ডাকেনও না।
আমার ডাক তো তা হলে নাও পড়তে পারে। অনেক দূর থেকে এসেছি ভাইসাহেব।
বাবার কাছে নিকট-দূর কোনো ব্যাপার না।
তা তো বটেই, নিকট-দূর হলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্যে। বাবাদের জন্যে না।
আপনি বেশি প্যাচাল পাড়তেছেন। প্যাচাল পাড়বেন না, বাবা প্যাচাল পছন্দ করেন। না। বিম ধরে বসে থাকেন। ভাগ্য ভালো হলে ডাক পাবেন।
আমি ঝিম ধরে বসে রইলাম। আমার ভাগ্য ভালো, বাবার ডাক পেলাম। খাদেম আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, বাবার হুজরাখানা থেকে বের হবার সময় বাবার দিকে পিঠি দিয়ে বের হবেন না। এতে বাবার প্রতি অসম্মান হয়। আপনার এতে বিরাট ক্ষতি হবে।