জি না, ঠিক না।
আমাদের নিয়ম হচ্ছে পরীক্ষা ছাড়াই সিদ্ধান্ত। খারাপ না?
খুবই খারাপ।
আমি কথা বেশি বলায় বিরক্ত হবেন না। অনেকদিন পর আপনাকে পেয়েছি বলে এত কথা বলছি। আপনি তো আর সাধারণ মানুষের মতো না যে আপনার সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলতে হবে!
আমি সাধারণ মানুষের মতো না?
অবশ্যই না। ঐদিন আপনি আমার কন্যার বাড়ি ফেরা সম্পর্কে যে-সময় বলে গিয়েছিলেন, সে ঠিক সেই সময় ফিরেছে। আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। অ্যাজ এ ম্যাটার অভ ফ্যাক্ট আমার বিস্ময়ভাব এখনও যায়নি। প্ৰচণ্ড আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ তো আর আজকাল পাওয়া যায় না। যাদের এই ক্ষমতা আছে তারা তা প্ৰকাশ করেন না। তারা আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেন। আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেকের যোগাযোগ আছে। আপনি যদি দয়া করে এমন লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন তা হলে খুব খুশি হবো। আছে এমন কেউ?
আছে। একজন— ময়লা-বাবা। গায়ে ময়লা মেখে বসে থাকেন।
ময়লা মেখে বসে থাকে কেন?
বলতে পারব না। জিজ্ঞেস করিনি।
জিজ্ঞেস করেননি কেন?
জিজ্ঞেস করিনি। কারণ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তাঁর ঠিকানা জোগাড় করেছি। একদিন যাব।
হিমু সাহেব ভাই, যেদিন যাবেন অবশ্যই আমাকে নিয়ে যাবেন। ওনার ক্ষমতা
কেমন?
লোকমুখে শুনেছি। ভালো ক্ষমতা। মনের কথা হড়বড় করে বলে দেন। আপনার মনে কোনো খারাপ কথা থাকলে ওনার সঙ্গে দেখা না করাই ভালো। হড়বড় করে বলে দেবেন, আপনি পড়বেন লজ্জায়।
ওনার নাম কী বললেন, ময়লা-বাবা?
জি, ময়লা-বাবা।
কী ধরনের ময়লা গায়ে মাখেন?
এক-তৃতীয়াংশ নর্দমার পানির সঙ্গে এক-তৃতীয়াংশ ডাস্টবিনের ময়লা, একষষ্ঠমাংশ টাটকা গু প্লাস আরও কিছু হাবিজাবি দিয়ে সেমি সলিড একটা মিকশ্চার তৈরি করে তেলের মতো গায়ে মেখে ফেলেন।
সত্যি?
ভাই আমি রসিকতা করছি। সত্যি কি না এখনও জানি না। দেখা হলে জানিব। ময়লার ফর্মুলা নিয়ে আসব। ইচ্ছা করলে আপনিও গায়ে মাখতে পারেন।
একজন মানুষ যে অন্য একজনকে কী পরিমাণ বিরক্ত করতে পারে আমি আশরাফুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে রাত কাটিয়ে এই তথ্য জেনে গেলাম।
আমি পা গুটিয়ে বিছানায় বসে আছি। তিনি বসে আছেন আমার সামনে একটা বেতের চেয়ারে। তিনি ননস্টপ কথা বলে যাচ্ছেন। ঢাকা-চিটাগাং আন্তনগর ট্রেনও কিছু স্টেশনে থামে। উনি কোনো স্টেশনই ধরছেন না। ছুটে চলছে তুফান মেইল। তার সব গল্পই তার কন্যা এবং ভূত-স্ত্রী প্রসঙ্গে। আমি শুনে যাচ্ছি–মন দিয়েই শুনছি। অন্যের কথা মন দিয়ে শোনার বিদ্যা আমার ভালোই আয়ত্ত হয়েছে।
বুঝলেন হিমু ভাই, আজ আমি একজন মুক্ত মানুষ। এ ফ্রী ম্যান। মানে এখনও ফ্রী না, তবে হয়ে যাচ্ছি। যেদিন আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হবে, সেদিনই আমি হবো একজন স্বাধীন মানুষ। মেয়েটা সুন্দর হওয়ায় নানান সমস্যা হচ্ছিল। কলেজে ওঠার পর থেকে শুধু বিয়ের সম্বন্ধ আসে। শুধু সম্বন্ধ এলে ক্ষতি ছিল না। তারা নানানভাবে চাপাচাপি করে। ভয় পর্যন্ত দেখায় এমন অবস্থা বিয়ে না দিলে মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাব, এই জাতীয় কথাবার্তা পর্যন্ত বলে। শুধু যে ওরা চাপাচাপি করেছে তাই না, আমার আত্মীয়স্বজনরাও চাপাচাপি করেছে। আমি একা মানুষ, মেয়ে মানুষ করতে পারছি না–এইসব উদ্ভট যুক্তি। যখন বিয়ে দিতে মন ঠিক করলাম তখন অন্য সমস্যা। বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়, ছেলে পছন্দ হয়, কথাবার্তা পাকা হয়, তখন বিয়ে ভেঙে যায়। কবার এরকম হলো জানেন? পাঁচবার। এর মধ্যে তিনবার বিয়ের কার্ড পর্যন্ত ছাপা হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে কার্ড দেখােব। সব যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
বিয়ে ভেঙে যায় কেন?
দুষ্ট লোকেরা কানভাঙনি দেয়। আমার মেয়ের নামে আজেবাজে কথা বলে, উড়ো চিঠি দেয়। টেলিফোন করে। সুন্দরী মেয়েদের প্রসঙ্গে আজেবাজে ধরনের কথা মানুষ খুব সহজে বিশ্বাস করে। বিয়ে ভেঙে যায়। আমার মেয়ে এতে খুব কষ্ট পায়। আমি তেমন পাই না, কারণ আমার স্ত্রী আগেই আমাকে জানিয়ে দেয় বিয়ে ভেঙে যাবে। আমার ভেতর একধরনের মানসিক প্ৰস্তুতি থাকে। কিন্তু আমার মেয়ের ভেতর থাকে না বলে সে খুব কষ্ট পায়। বিয়ে হচ্ছে না। এইজন্যে কষ্ট না, অপমানের কষ্ট।
কষ্ট হবারই কথা।
তারপর সে ঠিক করল কোনোদিন বিয়েই করবে না। কঠিনভাবে আমাদের সবাইকে বলল, তার বিয়ে নিয়ে আর একটি কথাও যেন না বলা হয়। আমার মেয়ে আবার খুব কঠিন ধরনের–একবার যা বলবে তা-ই। এর কোনো নড়াচড় হবে না। আমরা বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা দীর্ঘদিন বলিনি। এতদিন পর হঠাৎ আবার কথা উঠল। অতিদ্রুত সব ফাইনাল হয়ে গেল।
ভালো তো!
ভালো তো বটেই। কী যে আনন্দ আমার হচ্ছে তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।
আপনার স্ত্রী? তিনিও কি আপনার মতোই আনন্দিত?
হ্যাঁ, সেও খুশি। খুব খুশি।
আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে?
জি, কথা হয়েছে।
তিনি আবার বলেননি তো যে এবারও বিয়ে ভেঙে যাবে?
না, বলেনি। অবিশ্যি সে ভবিষ্যতের কথা খুব আগেভাগে বলতে পারে না। শেষমূহুর্তে বলে। কে জানে এইবারও শেষমূহুর্তে কিছু বলে কি না।
শেষমূহুর্তে কিছু বলার সুযোগ না দিলেই হয়। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হবে, সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে। ধরে তক্তা মারো পেরেক অবস্থা। কেউ ভাঙানি দেবার সুযোগ পাবে না।
তা কি আর হয়! মেয়ের বিয়ে বলে কথা! এ তো আর চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়ার মতো ঘটনা না যে রাত আটটায় ঠিক করা হবে রাত নটায় খেতে যাওয়া হবে!