কণ্টক
কাঁটা, কণ্টক, শলা, তরুনখ, সূচী, চোঁচ
একবার তোমার গলায় কইমাছের কাঁটা বিধিল। তুমি বড়ই অস্থির হইলে। মাছের কাঁটার যন্ত্রণা তেমন অসহনীয় নয়, তবে বড়ই অস্বস্তিকর। কণ্টক নীরবেই থাকে, তবে প্রতিনিয়তই সে তার অস্তিত্ব স্মরণ করাইয়া দেয়। কন্টকের এই কোনো ব্যবস্থা করি নাই। তুমি কিছুদিন গলায় কাঁটা নিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলে। বাবা হিমালয়, তুমি কি জান যে মানুষের মনেও পরম করুণাময় কিছু কাঁটা বিধাইয়া দেন? একটি কাঁটার নাম-মন্দ কাঁটা। তুমি যখনই কোনো মন্দ কাজ করিবে: তখনই এই কাটা তোমাকে স্মরণ করাইয়া দিবে। তুমি অস্বস্তি বোধ করিতে থাকিবে। ব্যথা বোধ না-অস্বস্তিবোধ।
সাধারণ মানুষদের জন্য এইসব কাঁটার প্রয়োজন আছে। সিদ্ধপুরুষদের জন্য প্রয়োজন নাই। কাজেই কণ্টকমুক্তির একটা চেষ্টা অবশ্যই তোমার মধ্যে থাকা উচিত। যেদিন নিজেকে সম্পূর্ণ কণ্টকমুক্ত করিতে পারবে সেইদিন তোমার মুক্তি। বাবা হিমালয়, প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে একটা কথা বলি, মহাপাষণ্ডরাও কণ্টকমুক্ত। এই অর্থে মহাপুরুষ এবং মহাপাষণ্ডের ভিতরে তেমন কোনো প্রভেদ নাই।
গলায় কাঁটা নিয়ে রাতে আশরাফুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে কোনো ঘোরের মধ্যে আছেন। আমার মুণ্ডিত মস্তক তার নজরে এল না। তিনি হাসিমুখে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
ভাইসাহেব, আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আজ অপনি আসবেন।
অ্যাজ কি বিশেষ কোনো দিন?
জি। আজ আমার মেয়ের পানচিনি হয়ে গেছে।
বলেন কী।
কী যে আনন্দ আমার হচ্ছে ভাই! একটু পরপরই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। চোখ মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই মুছছেন। চোখ লাল হয়ে আছে। আমি বললাম, আপনার মেয়ে কোথায়? এত বড় উৎসব, বাসা খালি কেন?
মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমার কান্না দেখেই কাঁদছিল। শেষে তার মামাতো ভাইবোনরা এসে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিতে চাচ্চিল, আমি যাইনি।
যান নি কেন?
ইয়াসমিন একা থাকবে। তা ছাড়া মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলব। আমার দায়িত্ব এখন শেষ।
ওনার দায়িত্বও তো শেষ। মেয়েকে আর চোখে-চোখে রাখতে হবে না। উনি আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হবেন না তো? জীবিত শ্বাশুড়িকেই জামাইরা দেখতে পারে না–উনি হলেন ভূত-শ্বাশুড়ি।
আশরাফুজ্জামান সাহেব করুণ গলায় বললেন, আমার স্ত্রী সম্পর্কে এই জাতীয় বাক্য ব্যবহার করবেন না ভাই। আমি মনে খুব কষ্ট পাই।
আচ্ছা যান, আর করব না।
ভাই, আজ রাতটা আপনি আমার সঙ্গে থেকে যান। দুজনে গল্পগুজব করি।
আমি থাকলে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন কীভাবে?
ওর সঙ্গে তো সারাক্ষণ কথা বলি না। কথাবার্তা সামান্যই হয়। ওর কথা বলতে কষ্ট হয়।
ও আচ্ছা।
হিমু সাহেব! ভাই আমার অনুরোধটা রাখুন। থাকুন আমার সঙ্গে। বিছানায় ধোয়া চাদর দিয়ে দিচ্ছি।
চাদরফাদর কিচ্ছু লাগবে না। একটা বিড়াল লাগবে। আপনার বাসায় কি বিড়াল আছে?
জি না, বিড়াল লাগবে কেন?
আমার গলায় কাঁটা ফুটেছে। বিড়ালের পা ধরলে নাকি গলার কাঁটা যায়…
এইসব কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। এসব হচ্ছে কুসংস্কার। গরম লবণপানি দিয়ে গাৰ্গল করেন, গলার কাঁটা চলে যাবে। আমি গরম পানি এনে দিচ্ছি। গলার কাঁটার খুব ভালো হোমিওপ্যাথি অযুদ্ধ আছে। কাল সকালে আমি আপনাকে জোগাড় করে দেব–অ্যাকোনইট ৩স।
আপনি তা হলে হোমিওপ্যাথিও জানেন?
ছোট বাচ্চা মানুষ করেছি, হোমিওপ্যাথি তো জানতেই হবে। বই পড়ে পড়ে শিখেছি, স্বঅ্যাহৃত জ্ঞান। আপনার যদি দীর্ঘদিনের কোনো ব্যাধি থাকে বলবেন, চিকিৎসা করব। তখন বুঝতে পারবেন যে আমি আসলে একজন ভালো চিকিৎসক।
ভয়-পাওয়া রোগ সারাতে পারবেন?
ভয়-পাওয়া রোগ? আপনি ভয় পান?
একবার পেয়েছিলাম। সেই ভয়াটা মনে গেথে ক্রনিক হয়ে গেছে। কিংবা এমনও হতে পারে–পাগল হয়ে যাচ্ছি।
এই দুটি রোগেরই হোমিওপ্যাথিতে খুব ভালো চিকিৎসা আছে। ভূত-প্ৰেত দেখতে পেলে স্ট্রামোনিয়াম ৬, আর যদি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছেন তা হলে খেতে হবে প্ল্যাটিনা ৩০, দুটাই মানসিক অসুখ।
মনে হচ্ছে হোমিওপ্যাথিতে মানসিক রোগের ভাল চিকিৎসা আছে।
অবশ্যই আছে। যেমন ধরুন কেউ যদি মনে রে সব বিষয়ে তার টনটনে জ্ঞান তাকে দিতে হবে কফিয়া ৬, অনবরত কথা-বলা রোগের জন্যে ল্যঅকেসিস ৬, লোকের সঙ্গ বিরক্তি এলে নাক্সভমিকা ৩, উদাসীন ভাব অ্যাসিড ফস-৩, খুন করার ইচ্ছা জাগলে হায়াসায়েমাস ৩, আত্মহত্যা করার ইচ্ছ–অরাম সেট ৩০, কথা বলার সময় কান্না পেলে–পালস ৬, অতিরিক্ত ধর্মচিন্তা–নাক্সভমিকা।
অতিরিক্ত কথা বলার ইচ্ছা কমে কোন অষুধে বললেন?
ল্যাকেসিস ৬।
ঘরে আছে না?
জি আছে। গলার কাঁটার অষুধটা নেই। এইটা আছে।
আপনার তো মনে হয় ল্যাকেসিস ৬ অষুধটা নিয়মিত খাওয়া উচিত।
হিমু সাহেব, আমি কিন্তু কথা কম বলি। কথা বলার মানুষই পাই না–কথা বলব। কী করে? আমার মেয়ে তো আমার সঙ্গে কথা বলে না। যখন ছোট ছিল তখন বলত। এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই সে দূরে সরে যাচ্ছে। কথা কম-বলা রোগেরও ভালো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আছে–অ্যাসিড ফস ৬, উদাসীন ভাবের জন্যে অ্যাসিড ফস ৩, আর কথা কম-বলা রোগের জন্যে অ্যাসিড ফস ৬, কিন্তু আমার অষুধ খাবে না। ওর ধারণা হোমিওপ্যাথি হলো চিনির দলা। কোনো-একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। পরীক্ষা না করেই কেউ যদি বলে চিনির দলা, সেটা কি ঠিক?