সাদেক সাহেব সিগারেট ধরালেন। বেচারাকে দেখে সত্যি সত্যি মায়া লাগছে।
সাদেক সাহেব!
জি?
আপনি মন-খারাপ করবেন না। আমি আছি আপনার সঙ্গে।
আপনি আমার সঙ্গে আছেন মানে কী?
ওরা যা ইচ্ছা করুক। ওদের মিল-মহব্বতের আমরা তোয়াক্কা করি না। আমরা আমাদের মতো মামলা চালিয়ে যাব।
আবার রসিকতা করছেন?
ভাই, আমি মোটেই রসিকতা করছি না। আমি সিরিয়াস। আঁখির বাবা এবং দুই মামাকে আমরা হাজতে ঢুকিয়ে ছাড়ব। পুলিশকে দিয়ে রোলারের ডলা দেওয়াব। কানে ধরে উঠবোস করাব।
হিমু সাহেব। আপনার কি মাথা খারাপ? আপনি উন্মাদ?
আমি উন্মাদের মতো কথা বলছি?
অবশ্যই বলছেন।
তা হলে আরেকটা সাজেশান দিই। আপনি নিজেও কক্সবাজার চলে যান। আসামি ফরিয়াদি দুই পার্টিকেই একসঙ্গে ট্যাকল করুন। দুপাটিই আপনার চোখের সামনে থাকবে। আপনি বিচক্ষণ আইনবিদ। আইনের প্যাচে ফেলে হালুয়া টাইট করে দিন। ওরা বুঝুক হাউ মেনি প্যাডি, হাউ মেনি রাইস।
শুনুন হিমু সাহেব, আপনি আপনার মাথার চিকিৎসা করাবার ব্যবস্থা করুন। ইউ আর এ সিক পারসন।
আপনার চায়ের কথা বলা হয়নি। দাঁড়ান, চায়ের কথা বলে এসে আপনার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেব।
সাদেক সহেব উঠে দাড়ালেন এবং আমাকে দ্বিতীয় বাক্য বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেলেন। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে— ঝড়ের বেগে নিষ্ক্রমণ।
ফুপুর কাজের ছেলে রশিদ আমার খুব যত্ন নিল। আমাকে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। রশিদের বয়স আঠারো-উনিশ। শরীরের বাড় হয়নি বলে এখনও বালকবালক দেখায়। ফুপার বাড়িতে সে গত দুবছর হলো আছে। ফুপুর ধারণা রশিদের মতো এক্সপার্ট কাজের ছেলে বাংলাদেশে দ্বিতীয়টা নেই। সে একা একশো না, একাই তিনশো। কথাটা মনে হয় সত্যি।
রশিদ দাঁত বের করে বলল, আইজ আর কই ঘুরবেন, শুইয়া বিশ্রাম করেন। মাথামালিশ কইরা দিমু। দুপুরে আফনের জন্যে বিরানি পাকামু।
বিরানি রাঁধতে পারিস?
আমি পারি না এমন কাম এই দুনিয়াতে পয়দা হয় নাই। সব কিসিমের কাম এই জীবনে করছি।
বলিস কী?
আমার ভাইজান আফনের মতো অবস্থা। বেশিদিন কোনো কামে মন টিকে না। চুরিধারি কইরা বিদায় হই।
চুরিধারি করিস?
পরথম করি না। শেষ সময়ে করি। বিদায় যেদিন নিমু। তার একদিন আগে করি। ভাইজান, আফনের চুল বড় হইছে, চুল কাটবেন?
নাপিতের কাজও জিনিস?
জানি। মডান সেলুনে এক বছর কাম করছি। কলাবাগান। ভালো সেলুন। এসি ছিল। কারিগরও ছিল ভালো।
নাপিতের দোকান থেকে কী চুরি করেছিলি?
খুর, কেঁচি, চিরুনি, দুইটা শ্যাম্পু এইসব টুকটাক…
খারাপ কী? ছোট থেকে বড়। টুকটাক থেকে একদিন ধুরুমধারুম হবে। দে, চুল কেটে দে।
আমি হাত-পা ছড়িয়ে বারান্দায় মোড়ায় বসলাম। রশিদ মহা উৎসাহে আমার চুল কাটতে বসল।
মাথা কামাইবেন ভাইজান?
মাথা-কামানোর দরকার আছে?
শখ হইলে বলেন। মাথা কামানিটা হইল শখের বিষয়।
মাথা কামাতে তোর যদি আরাম লাগে তা হলে কামিয়ে দে। সমস্যা কিছু নেই। আমার মাথায় চুল থাকাও যা, না-থাকাও তা।
রশিদ গম্ভীরমুখে বলল, লোকের ধারণা মাথা-কামানি খুব সহজ। আসলে কিন্তু ভাইজান বড়ই কঠিন কাজ।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, জগতের যাবতীয় কঠিন কাজই আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হয়। সহজ কাজকে মনে হয় কঠিন। যেমন ধর সত্য কথা বলা। মনে হয় না খুব সহজ, ইচ্ছা করলেই পারা যাবে? আসলে ভয়ংকর কঠিন। যে-মানুষ একমাস কোনো মিথ্যা না বলে শুধুই সত্যিকথা বলবে, ধরে নিতে হবে সে একজন মহামানব।
ভাইজান!
বল।
আফনের সঙ্গে আমার একটা প্ৰাইভেট কথা ছিল।
বলে ফ্যাল।
আফনের কাছে আমি একটা জিনিস চাই ভাইজান— আফনে না বলতে পারবেন।
কী?
কী জিনিস চাস?
সেইটা ভাইজান পরে বলতেছি। আগে আফনে ওয়াদা করেন দিবেন।
তুই চাইলেই আমি দিতে পারব এটা ভাবলি কী করে?
আফনে মুখ দিয়া একটা কথা বললেই সেইটা হয়–এইটা আমরা সবেই জানি।
তোকে বলেছে কে?
বলা লাগে না ভাইজান। বুঝা যায়। তারপরে বাদল ভাই বলছেন। বাদল ভাইয়ের বিবাহ গেছিল ভাইঙ্গা। বাদল ভাই আফনেরে বলল–সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক।
তুই চাস কী?
বিদেশ যাইতে খুব মন চায় ভাইজান। দেশে মন টিকে না।
আচ্ছা যা, হবে।
রশিদ মাথা-কামানো বন্ধ করে তৎক্ষণাৎ আমার পা ছুঁয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করল। আমি সিদ্ধপুরুষদের মতোই তার শ্ৰাদ্ধ গ্রহন করলাম। মানুষকে ভক্তি করতে ভালো লাগে না–মানুষের ভক্তি পেতে ভালো লাগে।
আমার মাথা-কামানো হলো। মাথা-ম্যাসেজ করা হলো। গা-মালিশ করা হলো। দুপুরে হেভি খানাপিনা হলো। খাসির বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট। অতি সুস্বাদু রান্না, ভারপেট খাবার পরেও মনে হচ্ছে আরও খাই।
রশিদ, তুই তো ভালো রান্না জানিস!
চিটাগাং হোটেলে বাবুর্চির হেল্পার ছিলাম ভাইজান। বাবুর্চির নাম ওস্তাদ মনা মিয়া। এক লম্বর বাবুর্চি ছিল। রান্ধনের কাজ সব শিখছি ওস্তাদের কাছে।
ভালো শিখেছিস। খুব ভালো শিখেছিস।
রাইতে ভাইজান আফনেরে চিতলমাছের পেটি খাওয়ামু। এইটা একটা জিনিস।
কী রকম জিনিস?
একবার খাইলে মিত্যুর দিনও মনে পড়বা। আজরাইল যখন জান-কবিচের জন্যে আসব তখন মনে হইব–আহারে, চিতলমাছের পেটি। ওস্তাদ মনা মিয়া আমারে হাতে ধইরা শিখাইছে। আমারে খুব পিয়ার করত।
ওস্তাদের কাছ থেকে কী চুরি করলি?
রশিদ চুপ করে রইল। আমি আর চাপাচাপি করলাম না। দুপুরে লম্বা ঘুম দিলাম। রাতে খেলাম বিখ্যাত চিতলমাছের পেটি। সেই রান্না শিল্পকর্ম হিসেবে কতটা উত্তীর্ণ বলতে পারলাম না— কারণ শুরুতেই গলায় কাঁটা বিধে গেল। মাছের কাটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার, কিন্তু একে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রতিনিয়তই সে জানান দিতে থাকে। আমি আছি। আমি আছি। আমি আছি ঢোক গেলার প্রয়োজন নেই, তার পরেও ক্রমাগত ঢোক গিলে যেতে হয়। কাঁটার প্রসঙ্গে আমার বাবার কথা মনে পড়ল। তার বিখ্যাত বাণীমালায় কাঁটাসংক্রান্ত বাণীও ছিল।