আমার মাথার ভেতর আবারো কেউ একজন কথা বলল, এখনো সময় আছে, দাড়িয়ে থেকে না, চলে যাও! এই জিনিসটা যদি তোমার দিকে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তুমি আর পালাতে পারবে না। কুকুরগুলি তোমাকে রক্ষা করছে। আরো কিছুক্ষণ রক্ষা করবে। তুমি দৃষ্টি না ফিরিয়ে নিয়ে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করা। খবরদার এক পলকের জন্যেও দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবে না। এবং মনে রেখে আর কখনো এই গলিতে ঢুকবে না। কখনো না। এই গলি তোমার জন্যে নিষিদ্ধ।
আমি আস্তে আস্তে পেছন দিকে হাঁটছি-কুকুরগুলিও আমার হাঁটার তালে তাল মিলিয়ে পেছন দিকে যাচ্ছে।
জিনিসটার কোনো চোখ নেই। চোখ থাকলে বলতাম–জিনিসটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চৰ্য, চোখ ছাড়াও তা হলে দেখা যায়!
মাথার ভেতর আবারো কেউ একজন কথা বলল, তুমি জিনিসটার সীমার বাইরে চলে এসেছি। জিনিসটার ক্ষমতা প্রচণ্ড। কিন্তু তার ক্ষমতার সীমা খুব ছোট। এই গলির বাইরে আসার তার ক্ষমতা নেই। তুমি এখন চলে যেতে পার।
আমি চলে গেলাম না। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তার লাঠি নামিয়ে ফেলেছে। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হঁটিতে শুরু করেছে। তার গায়ে কঁথার মতো একটা মোটা কাপড়। এই কাপড়টাই শরীরে জড়ানো। সে হাঁটছে হেলেন্দুলে। একবার মনে হচ্ছে বামে হেলে পড়ে যাবে, আবার মনে হচ্ছে ডানে হেলে পড়ে যাবে। জিনিসটাকে এখন আগের চেয়ে অনেক লম্বা দেখাচ্ছে। যতই সে দূরে যাচ্ছে ততই লম্বা হচ্ছে। জিনিসটা আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কুকুরগুলি ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। ওদের দলপতি শুধু একবার আমার দিক তাকিয়ে ঘেউঘেউ করল। মনে হয় কুকুরের ভাষায় বলল, যাও, বাসায় চলে যাও।
ডিসেম্বর মাসের শীতেও আমার শরীর ঘামিছে। ইটার সময় লক্ষ করলাম ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। রাস্তা কেমন উঁচুনিচু লাগছে। নতুন নতুন চশমা পরলে যা হয় তা-ই হচ্ছে। বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাচের জগভরতি একজগ ঠাণ্ডা পানি এক চুমুকে খেতে পারলে হত। কার কাছে পানি চাইব? কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হল আমার দিক-ভুল হচ্ছে। আমি কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। কোনদিকে যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছি না। রিকশা চোখে পড়ছে না যে কোনো একটা রিকশায় উঠে বসব। হেঁস-হোস করে কিছু গাড়ি চলে যাচ্ছে। হাত তুলে দাড়িয়ে থাকলে এরা কেউ কি থামাবে? না, কেউ থামাবে না। ঢাকার গাড়িযাত্রীরা পথচারীর জন্যে গাড়ি থামায় না। নিয়ম নেই। আমি ফুটপাতেই বসে পড়লাম। আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে বমি চেপে রেখেছিলাম। বসামাত্রই হড়হড় করে বমি হয়ে গেল।
আফনের কী হইছে?
মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ফুটপাতে বস্তা মুড়ি দিয়ে যারা ঘুমায় তাদের একজন। কস্তার ভেতর থেকে মাথা বের করেছে। তার গলায় মমতার চেয়ে বিরক্তি বেশি।
আমি বললাম, শরীর ভালো না।
মিরগি ব্যারাম আছে?
না। পানি খাওয়া যাবে–? পানি খাওয়া দরকার।
রাইতে পানি কই পাইবেন?
রাতে পানির পিপাসা পেলে আপনারা পানি কোথায় পান?
লোকটা কস্তার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিল। আমার উদ্ভট প্রশ্নে সে হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। প্রশ্নটা তেমন উদ্ভট ছিল না। এই যে অসংখ্য মানুষ ফুটপাতে ঘুমায়, রাতে পানির তৃষ্ণা পেলে তারা পানি পায় কোথায়?
কটা বাজছে জানা দরকার। রাত শেষ হয়ে গেলে রিকশা বেবিট্যাক্সি চলা শুরু করবে-তখন আমার একটা গতি হলেও হতে পারে। বিটের পুলিশও দেখছি না। পূর্ণমা রাতে বোধহয় বিটের পুলিশ বের হয় না।
আমি বস্তা মুড়ি দেওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, ভাইসাহেব! এই যে ভাইসাহেব! এই যে কিস্তা-ভাইয়া!
একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। বমি হয়ে যাওয়ায় শরীরটা একটু ভালো লাগছে, তবে ভয়টা মাথার ভেতর ঢুকে আছে।
কারো সঙ্গে কথাটথা বলতে থাকলে হয়তো-বা তাকে ভুলে থাকা যাবে। আমি গলা উচিয়ে ডাকলাম, এই যে বস্তা-ভাই, ঘুমিয়ে পড়লেন?
লোকটা বিরক্তমুখে বস্তার ভেতর থেকে মুখ বের করুল।
কী হইছে?
এটা কোন জায়গা? জায়গাটার নাম কী?
চিনেন না?
জি না।
বুঝছি, মাল খাইয়া আইছেন। আরেক দফা গলাত আঙ্গুল দিয়া বমি করেন।–শইল ঠিক হইব। আরেকটা কথা কই ভাইজান, আমারে ত্যক্ত করবেন না।
রাত কত হয়েছে বলতে পারেন?
জে না, পারি না।
লোকটা আবার কস্তার ভেতর ঢুকে গেল। লোকটার পাশে খালি জায়গায় শুয়ে পড়ব? গায়ে চাদর আছে। চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ে বাকি রাতটা পার করে দেওয়া যায়। রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে অনেক রাত কাটিয়েছি। গাছের তলায় ঘুমিয়েছি। ফুটপাতে ঘুমানো হয় নি।
কস্তা-ভাইয়ের পাশে শুয়ে পড়ার আগে কি ভার অনুমতি নেওয়ার দরকার আছে? ফুটপাতে যারা ঘুমায় তাদের নিয়মকানুন কী? তাদেরও নিশ্চয়ই অলিখিত কিছু নিয়মকানুন আছে। ফুটপাতে অনেক পরিবার রাত কাটায়-স্বামী-স্ত্রী ছেলেমেয়ের সোনার সংসার। সেইরকম কোনো পরিবারের পাশে নিশ্চয়ই উটকে ধরনের কেউ মাথার নিচে ইট বিছিয়ে শুয়ে পড়তে পারে না।
বস্তা-ভাই। এই যে বস্তা-ভাই?
আবার কী হইছে?
আপনার পাশের ফাঁকা জায়গাটায় কি শুয়ে পড়তে পারি? যদি অনুমতি দেন।
কস্তা-ভাই জবাব দিলেন না, তবে সরে গিয়ে খানিকটা জায়গা করলেন। এই প্রথম লক্ষ করলাম-কস্তা-ভাই একা ঘুমাচ্ছেন না, তাঁর সঙ্গে তাঁর পুত্ৰও আছে। তিনি পুত্ৰকেও নিজের দিকে টানলেন এবং কঠিন গলায় বললেন,বস্তা-ভাই বস্তা-ভাই করতেছেন কেন? ইয়ারকি মারেন? গরিবরে লইয়া ইয়ারকি করতে মজা লাগে?