ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে–বস্তা-ভাইয়ের পুত্রের নাম সুলায়মান। সুলায়মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
স্লিপিংব্যাগের ভেতর পিতাপুত্ৰ দুজনই ঘুমাচ্ছিল। আমি তাদের ঘুম ভাঙালাম না। তাদের পাশে শুয়ে পড়লাম। এরা মনে হচ্চে আমার জন্যে জায়গা রেখেছে। পাশের জায়গাটায় খবরের কাগজ বিছিয়ে রেখেছে। শুধু যে খবরের কাগজ তা না, খবরের কাগজের উপর বড় পলিথিনের চাদর। আমি শোয়ামাত্র স্লিপিংব্যাগের মুখ খুলে গেল। সুলায়মান তার মাথা বের করল।
কী খবর সুলায়মান?
সুলায়মান হাসল। তার সামনের দুটা দাঁত পড়ে গেছে।
দাঁত-পড়া সুলায়মানকে সুন্দর দেখাচ্ছে। সুলায়মান লাজুক গলায় বলল, আফনের জন্যে বাপজান জায়গা রাখছে।
ভালো করেছে।
এখন থাইক্যা আফনের এই জাগা ‘রিজাভ’।
বাঁচা গেল! সব মানুষেরই কিছু-না-কিছু রিজার্ভ জায়গা দরকার। তুই কি পড়তে পারিস?
জ্বে না।
পড়াশোনা তো করা দরকার রে ব্যাটা।
গরিব মানুষের পড়ালেখা লাগে না।
কে বলেছে?
কেউ বলে নাই–আমি জানি।
এখন থেকেই নিজে নিজে জানা শুরু করেছিস? সুলায়মান দাঁত বের করে হাসল। চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, আফনেরে কী
ডাকুম?
যা ডাকতে ইচ্ছা হয় ডাক। কী ডাকতে ইচ্ছা করে?
মামা।
বেশ তো, মামা ডাকবি।
মামা, আফনে কিচ্ছা জানেন?
জানি— শুনিবি?
সুলায়মান হ্যাঁ-না কিছু বলল না। খুব সাবধানে ক্লিপিংব্যাগ থেকে বের হয়ে এল। সম্ভবত সে তার বাবার ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছে না। সুলায়মান এসে শুয়ে পড়ল আমার পাশে। আমি গল্প শুরু করলাম–আলাউদ্দিনের চেরাগের গল্প, যে-চেরাগের ভেতর অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন দৈত্য ঘুমিয়ে থাকে। তাঁর যদি ঘুম ভাঙানো যায় তা হলে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। সব মানুষকেই একটি করে আলাউদিনের চেরাগ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। অল্পকিছু মানুষই চেরাগে ঘুমিয়ে-থাকা দৈত্যকে জাগাতে পারে।
সুলায়মান জি মামা?
তোর মনের যে-কোনো একটা ইচ্ছার কথা বল তো দেখি! তোর যে-কোনো একটা ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
আমার কোনো ইচ্ছা নাই মামা।
আচ্ছা, তা হলে স্লিপিংব্যাগের ভেতর চলে যা। বাবার সঙ্গে ঘুমিয়ে থাক।
আমি আফনের লগে ঘুমামু।
সুলায়মান একটা হাত আমার গায়ে তুলে দিয়েছে। আমি চলে গেছি একটা অদ্ভুত অবস্থায়, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, অথচ ঘুম আসছে না। চোখ মেলে রাখতেও পারছি না, আবার বন্ধও করতে পারছি না। বিশ্ৰী অবস্থা!
হ্যালো, আঁখি কি বাসায় আছে?
আপনি কে বলছেন?
আমার নাম হিমু?
হিমুটা কে?
জি, আমি নীতুর বড় ভাই। নীতু হলো আঁখির বান্ধবী।
তুমি আঁখির সঙ্গে কথা বলতে চাও কেন?
নীতুকে গতকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আঁখিদের বাসায় যাচ্ছি বলে ঘর থেকে বের হয়েছে, আর ফিরে আসে নি। আমরা আঁখিদের বাসা কোথায়, টেলিফোন নাম্বার কী, কিছুই জানতাম না। অনেক কষ্টে টেলিফোন নাম্বার পেয়েছি। মা খুব কান্নাকাটি করছেন। ঘনঘন ফিট হচ্ছেন…
কী সর্বনাশ৷ ফিট হওয়ারই তো কথা। শোনো হিমু, নীতু নামে কেউ এ-বাড়িতে আসেনি। নীতু কেন, কোনো মেয়েই আসেনি।
আপনি একটু আঁখিকে দিন। আঁখির সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত মা শান্ত হবেন না। মা কথা বলবেন।
তুমি ধরো, আমি আঁখিকে ডেকে দিচ্ছি। আজকালকার মেয়েদের কী যে হয়েছে। মাই গড–চিন্তাও করা যায় না!
আমি ফোঁপানির মতো আওয়াজ করে নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আঁখিকে টেলিফোনে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না–এই অভিনয়টা সেই কারণেই দরকার হয়ে পড়েছিল।
আঁখি টেলিফোন ধরল। ভীত গলায় বলল কে?
আমি হিমু। নীতুর বড় ভাই।
আমি তো নীতু বলে কাউকে চিনি না।
আমি নিজেও চিনি না। নীতুর গল্পটা তৈরি করা ছাড়া উপায় ছিল না। কেউ তোমাকে টেলিফোন দিচ্ছিল না।
অপনি কে?
আমি হিমু।
হিমু নামেও তো আমি কাউকে চিনি না!
আমি বাদলের দূর সম্পর্কের ভাই। ঐ যে, যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছিল। তুমি পালিয়ে চলে গেলে বলে বিয়ে হয়নি।
আপনি কী চান?
আমি কিছুই চাই না— বাদলের কারণে তোমাকে টেলিফোন করেছি। ও বোকাটাইপের তো, বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় নানান ধরনের পাগলামি করছে–আমরা অস্থির হয়ে পড়েছি। তুমি ওকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভালো কাজ করেছ। বোকা স্বামীর সঙ্গে সংসার করা ভয়াবহ ব্যাপার।
উনি বোকা?
বোকা তো বটেই। ও হলো বোকান্দর। বোকা যোগ বান্দর–বোকান্দর। সন্ধি করলে এই দাঁড়ায়। বোকা মানুষদের প্রতি বুদ্ধিমানদের কিছু দায়িত্ব আছে। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, তুমি যদি এই দায়িত্ব পালন কর।
আমি বুদ্ধিমতী আপনাকে কে বলল?
শেষমূহুর্তে তুমি বাদলকে বিয়ে করতে রাজি হওনি–এটি হচ্ছে তোমার বুদ্ধির প্রধান লক্ষণ। আঁখি শোনো–তুমি বাদলের পাগলামি কমাবার একটা ব্যবস্থা করে দাও।
সরি, আমি কিছু করতে পারব না।
ও কী সব পাগলামি করছে শুনলে তোমার মায়া হবে। একটা শুধু বলি–রাত বারোটার পর ও তোমাদের বাসার সামনে হাঁটাহাটি করে। অন্য সময় করে না, কারণ অন্য সময় হাঁটাহাটি করলে তুমি দেখে ফেলবে। সেটা নাকি তার জন্যে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
শুনুন, ভালো একটা মেয়ে দেখে আপনারা ওনার বিয়ে দিয়ে দিন–দেখবেন পাগলামি সেরে যাবে।
সেটাই করা হচ্ছে। মেয়ে পছন্দ করা হয়েছে। মেয়ে খুব সুন্দর। শুধু একটু শর্টপাঁচ ফুট। হাইহিল পরলে অবিশ্যি বোঝা যায় না। মেয়ে গান জানে–রেডিওতে বি গ্রেডের শিল্পী।
ভালোই তো! ভালো তো বটেই। ছাত্রও খুব ভালো–এস.এস.সি-তে চারটা লেটার এবং স্টার পেয়েছে। চারটা লেটারের একটা আবার ইংরেজিতে। ইংরেজিতে লেটার পাওয়া সহজ না।