জি স্যার?
আপনার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আপনি আমাকে নিজের সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা প্ৰমাণ করার জন্যে আপনি অদ্ভুত আচার-আচরণ করেন। যেমন আপনার পায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আপনি প্রচুর হাটেন। মনে হচ্ছে রাতেই হাঁটেন। কারণ দিনে হাঁটা তো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে পড়ে। যেহেতু আপনি রাতে হাটেন–বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। আপনার ডিলিউশনকে পোক্ত করতে এরাও সাহায্য করে। এদের কেউ কেউ আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা মানেই আপনাকে সাহায্য করা। আমার ধারণা এদের কেউ-কেউ আপনাকে সাধুও ভাবে। আপনার পদধূলি নেয়।
মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই একজনকে সাধু হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করবে?
হ্যাঁ, তা করবে। মানুষ খুব যুক্তিবাদী প্ৰাণী হলেও তার মধ্যে অনেকখানি অংশ আছে যুক্তিহীন। মানুষ যুক্তি ছড়াই বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। প্রাণী হিসেবে মানুষ সবসময় অসহায় বোধ করে। সে সারাক্ষণ চেষ্টা করে অসহায়তা থেকে মুক্তি পেতে। পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসী, হস্তরেখা, অ্যাস্ট্রলজি, নিউম্যারোলজির প্রতি এইসব কারণেই মানুষের বিশ্বাস।
আপনার ধারণা, মানুষ কোনো বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে নি?
অবশ্যই মানুষ বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। একদিন যে-মানুষ সমগ্র নক্ষত্রমণ্ডল জয় করবে। তার ক্ষমতা অসাধারণ। তবে তার মানে এই না সে ভবিষ্যৎ বলবে। দুটা বেজে গেছে–আপনার কথা ছিল না। আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দেয়ার?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিসির আলি বললেন, চলুন আপনার সঙ্গে যাই। কোন দোকানটা রাত দুটার সময় খেলা থাকে আমাকে দেখিয়ে দিন। মাঝে মাঝে সিগারেটের জন্যে খুব সমস্যায় পড়ি।
মিসির আলি তার ঘরের দরজায় তালা লাগালেন না। তালা খুঁজে পাচ্ছেন না। ঘর খোলা রেখে গভীর রাতে বের হচ্ছেন তার জন্যেও তার মধ্যে কোনো অস্বস্তি লক্ষ্য করলাম না। ঘর খোলা রেখে বাইরে যাবার অভ্যাস তার নতুন না এটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার মধ্যেও খানিকটা হিমুভাব আছে।
হিমু সাহেব!
জি স্যার?
আপনি আমার কথায় আপসেট হবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করার জন্যে কিছু বলি নি।
আপনি যে এ-ধরনের কথা বলবেন তা আমি জানতাম।
সব জেনেশুনেই আমার কাছে এসেছেন?
জি স্যার।
আমার ধারণা। আপনি আমার কাছে এসেছেন। অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে–যা আপনি বলছেন না।
স্যার, আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।
কী জিনিস?
আমি কিছুদিন আগে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। যা দেখে ভয় পেয়েছিলাম, সেই জিনিসটা আপনাকে দেখাতে চাই।
কেন? আপনি চান যে আমিও ভয় পাই?
তা না।
তবে?
আমার কাছে শুনে আপনি ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন না।
তবু শুনি।
আমি ভয় পাবার গল্পটা প্ৰথম থেকে শেষ পর্যন্ত বললাম। মিসির আলি গল্পের মাঝখানে একবারও কিছু জানতে চাইলেন না–হাঁ-হুঁ পর্যন্ত বললেন না। সিগারেট কিনলাম। তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, আপনি একটা কাজ করুন। গল্পটা আবার বলুন।
আবার বলব?
হ্যাঁ, আবার।
কেন?
দ্বিতীয়বার শুনে দেখি কেমন লাগে।
আমি আবারও গল্প শুরু করলাম। মিসির আলি সিগারেট টানতে টানতে তার বাসার দিকে যাচ্ছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি এবং গল্প বলছি। তিনি নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছেন। আমি তাঁর মুখে চাপা হাসিও লক্ষ্য করছি।
হিমু সাহেব!
আপনার গল্পটা ইন্টারেস্টিং, আমি আপনার সঙ্গে পরে এই নিয়ে কথা বলব।
আপনি যদি চান, যে-জায়গাটায় আমি ভয় পেয়েছিলাম। সেখানে নিয়ে যেতে পারি।
আমি চাচ্ছি না।
তা হলে স্যার আমি যাই।
আচ্ছ। আবার দেখা হবে। ভালো কথা, যে-গলিতে আপনি ভয় পেয়েছিলেনতাপাতত সেই গলিতে না ঢোকা ভালো হবে।
এই কথা কেন বলছেন?
হঠাৎ ব্ৰেইনে চাপ সৃষ্টি না করাই ভালো। মানুষের একটা অসুখের নাম এরিকনোফোবিয়া–মাকড়সাভীতি। এই অসুখ থেকে মানুষকে মুক্ত করার একটা পদ্ধতি হচ্ছে তার গায়ে মাকড়সা ছেড়ে দেওয়া। মাকড়সা তার গায়ে কিলবিল করে হাঁটবে। এবং রোগী বুঝতে পারবে যে মাকড়সা অতি নিরীহ প্রাণী। তাকে ভয় পাবার কিছু নেই। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে মাঝে মাঝে রোগ ভালো হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে খুব খারাপ ফল হয়— রোগী তখন চারদিকে মাকড়সা দেখতে পায়। আমি চাই না— আপনার ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটুক।
স্যার যাই?
আচ্ছা।
আমি চলে আসছি। রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে ফিরে তাকালাম। মিসির আলি ঘরে ঢোকেননি। এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তাকিয়ে আছেন। আকাশের দিকে। কী দেখছেন, তারা? আমি একটু বিস্মিত হলাম।— মিসির আলি ধরনের মানুষেরা মাইক্রোসকেপ টাইপ–কাছের জিনিসকে তারা সাবধানে দেখতে ভালোবাসেন। ধরাছোঁয়ার বাইরের জগতের প্রতি তাদের আগ্রহ থাকার কথা না। তাঁরা অসীমের অনুসন্ধান করেন সীমার ভেতর থেকে।
মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে রাতটা হেঁটে হেঁটেই কাটিয়ে দিই, যদিও ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। পী ভরি হয়েছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বস্তা-ভাইয়ের পাশে গিয়ে কি শুয়ে থাকিব? সিপিংব্যাগ তাদের জীবন কেমন কাটছে সেটাও দেখতে ইচ্ছা করছে–ছেলেটার নাম যেন কি? গাবলু? না, গাবলু না। অন্যকিছু। নামটা কি সে আমাকে বলেছে? আচ্ছা প্রতিটি গাছের কি মানুষের মতো নাম আছে? গাছ-মা কি তার গাছশিশুদের নাম রাখে? আমরা যেমন গাছের নামে নাম রাখি–শিমুল, পলাশ, বাবলা–ওরাও কি পছন্দের মানুষের নামে তাদের পুত্রকন্যাদের নাম রাখে? যেমন একজনের নাম রাখল হিমু, আরেকজনের সোলায়মান।