আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, কথা বলার জন্যে রাত দুটা খুব উপযুক্ত সময় নয়। আপনি জেগে ছিলেন। তাই দরজার কড়া নেড়েছি। আপনি যদি বলেন তা হলে অন্য সময় আসব।
আমি জেগে ছিলাম না, ঘুমুচ্ছিলাম। যা-ই হোক, আসুন, ভেতের আসুন।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। মিসির আলি সাহেব দরজার হুক লাগালেন। দরজার হুকটা বেশ শক্ত, লাগাতে তার কষ্ট হলো। অন্য কেউ হলে দরজার হুক লাগাত না। যেঅতিথি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যাবে তার জন্যে এত ঝামেলা করে দরজা বন্ধ করার দরকারটা কী!
বসুন। ঐ চেয়ারটায় বসুন। হাতলের কাছে একটা পেরেক উঁচু হয়ে আছে। পাঞ্জাবিতে লাগলে পাঞ্জাবি ছিঁড়বে।
মিসির আলি সাহেব পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি বসে বসে ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগলাম। উল্লেখ করার মতো কিছুই চোখে পড়ছে না। কয়েকটা বেতের চেয়ার।। গোল একটা বেতের টেবিল। টেবিলের উপরে বাংলা ম্যাগাজিন। উপরের পাতা ছিঁড়ে গেছে বলে ম্যাগাজিনের নোম পড়া যাচ্ছে না। এক কোনায় একটা চৌকি। চৌকিতে বিছানা পাতা। এই বিছানায় কে ঘুমায়? মিসির আলি সাহেব? মনে হয় না। এই ঘরে আলো কম। বিছানায় শুয়ে বই পড়া যাবে না। মিসির আলি সাহেবের নিশ্চয়ই বিছানায় শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস। তার শোবার ঘরটা দেখতে পারলে হতো।
মিসির আলি ঢুকলেন। তার দুহাতে দুটা মগ। মগভরতি চা।
নিন, চা নিন। দুচামচ চিনি দিয়েছি–আপনি কি চিনি আরও বেশি খান?
জি না। যে যতটুকু চিনি দেয়। আমি ততটুকুই খাই।
তিনি আমার সামনের চেয়ারে বসলেন। এরকম বিশেষত্বহীন চেহারার মানুষ আমি কম দেখেছি। কে জানে বিশেষত্বহীনতাই হয়তো তার বিশষত্ব। চা খাচ্ছেন শব্দ করে। নিজের চায়ের স্বাদে মনে হয় নিজেই মুগ্ধ। আমি এত আরাম করে অনেকদিন কাউকে চা খেতে দেখিনি।
তারপর হিমু সাহেব, বলুন আমার কাছে কেন এসেছেন।
আপনাকে দেখতে এসেছি স্যার।
ও আচ্ছা। এর আগে বলেছিলেন কথা বলতে এসেছেন। আসলে কোনটা?
দুটাই। চোখ বন্ধ করে তো আর কথা বলব না–আপনার দিকে তাকিয়েই কথা বলব।
তাও তো ঠিক। বলুন, কথা বলুন। আমি শুনছি।
মানুষের যে নানান ধরনের অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতার কথা শোনা যায় আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
আমি সেরকম অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ এখনও কাউকে দেখিনি, কাজেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে না। আমার মন খোলা, তেমন ক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে দেখলে অবশ্যই বিশ্বাস করব।
আপনি দেখতে চান?
জি না। আমার কৌতূহল কম। নানান ঝামেলা করে কোনো এক পীরসাহেবের কাছে যাব, তার কেরামতি দেখব, সেই ইচ্ছা আমার নেই।
কেউ যদি আপনার সামনে এসে আপনাকে কোনো কেরামতি দেখাতে চায় আপনি দেখবেন?
মিসির আলি চায়ের মগ নামিয়ে রাখলেন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন—সম্ভবত সিগারেট খুঁজছেন। এই ঘরে সিগারেট নেই। আমি ঘরটা খুব ভালোমতো দেখেছি। মিসির আলি সাহেবের কাছে যেহেতু এসেছি। স্বভাবাটাও তার মতো করার চেষ্টা করছি। পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা। আমি লক্ষ্য করলাম, মিসির আলি সাহেবের চেহারায় সূক্ষ্ম হতাশার ছাপ পড়ল–অর্থাৎ শোবার ঘরেও সিগারেট নেই। নিকোটিনের অভাবে তিনি খানিকটা কাতর বোধ করছেন।
আমি বলরাম, স্যার, আমার কাছে সিগারেট নেই।
ভেবেছিলাম তিনি আমার কথায় চমকাবেন। কিন্তু চমকালেন না। তবে তার ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা হাসির ছায়া দেখলাম। হাসিটা কি ব্যঙ্গের? কিংবা আমার ছেলেমানুষিতে তার হাসি পাচ্ছে? না মনে হয়।
স্যার, আমি নিজেও সামান্য ভবিষ্যৎ বলতে পারি। ঠিক আড়াইটার সময় কেউ একজন এসে আপনাকে এক প্যাকেট সিগারেট দেবে।
মিসির আলি এবারে সহজ ভঙ্গিতে হাসলেন। চায়ের মাগে চুমুক দিয়ে দিতে বললেন, সেই কেউ-একজনটা কি আপনি?
জি স্যার। আড়াইটার সময় আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আপনাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে যাব।
দোকান খোলা পাবেন?
ঢাকা শহরে কিছু দোকান আছে খোলেই রাত একটার পর।
ভালো।
আমি মিসির আলি সাহেবের দিকে একটু বুকে এসে বললাম, আমি কিন্তু স্যার মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলতে পারি। সবসময় পারি না–হঠাৎ-হঠাৎ পারি।
ভালো তো!
আপনি কি আমার মতো কাউকে পেয়েছেন যে মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলতে পারে?
সব মানুষই তো মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। এটা আলাদা কোনো ব্যাপার না। ইনটিউটিভ একটা বিষয়। মাঝে মাঝে ইনটিউশন কাজে লাগে, মাঝে মাঝে লাগে। না। মস্তিষ্ক ভবিষ্যৎ বলে যুক্তি দিয়ে। সেইসব যুক্তির পুরোটা আমরা বুঝতে পারি না। বলে আমাদের মনে হয় আমরা আপনা-আপনি ভবিষ্যৎ বলছি।
আমার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা ইনটিউটিভ গেজ ওয়ার্কের চেয়েও সামান্য বেশি। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না বলে আপনার কাছে এসেছি।
আপনার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা সম্পর্কে অন্যরা জানে?
আপনার আশেপাশের মানুষদের এই ক্ষমতা দেখাতে আপনার ভালো লাগে, তাই না?
জি, ভালোই লাগে। একজন ম্যাজিশিয়ান সুন্দর একটা ম্যাজিক দেখাবার পর যেমন আনন্দ পায়–আমিও সেরকম আনন্দ পাই।
হিমু সাহেব!
জি স্যার?
আমার ধারণ আপনি একধরনের ডিলিউশনে ভুগছেন। ডিলিউশন হচ্ছে নিজের সম্পর্কে ভ্ৰান্ত ধারণা। যে-কোনো কারণেই হোক আপনার ভেতর একটা ধারণা জন্মেছে আপনি সাধুসন্ত-টাইপের মানুষ। আপনার খালি পা, হলুদ পাঞ্জাবি এইসব দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। যে-কোনো ডিলিউশন মানুষের মাথায় একবার ঢুকে গেলে তা বাড়তে থাকে। আপনারও বাড়ছে। আপনি নিজে আপনার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা নিয়ে একধরনের অহংকার বোধ করছেন। আপনাকে যতই লোকজন বিশ্বাস করছে। আপনার ততই ভালো লাগছে। এখন রাত দুটায় আপনি আমার কাছে এসেছেন–বিশ্বাসীর তালিকা বৃদ্ধির জন্যে। রাত দুটার সময় না এসে আপনি সকাল দশটায় আসতে পারতেন। আসেননি, কারণ যে সাধু সেজে আছে সে যদি সকাল দশটায় আসে তা হলে তার রহস্য থাকে না। রহস্য বজায় রাখার জন্যেই আসতে হবে রাত দুটার দিকে। হিমু সাহেব!