ঘুমের ভেতর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম–গাছ নিয়ে স্বপ্ন। গাছ আমার সঙ্গে কথা বলছে। তবে উলটাপালটা কথা বলছে–কিংবা মিথ্যা কথা বলছে। যেমন গাছটা বলল, হিমু, তুমি কি জািন এই পৃথিবীর সবচে প্রাচীন গাছটি বাংলাদেশে আছে–যার বয়স প্রায় ছহাজার বছর?
আমি বললাম, মিথ্যা কথা বলছি কেন? বাংলাদেশ উঠে এসেছে সমুদ্রগৰ্ভ থেকে। এমন প্ৰাচীন গাছ এদেশে থাকা সম্ভব নয়।
তোমাদের বিজ্ঞানীরা কি সব জেনে ফেলেছেন?
সব না জানলেও অনেক কিছুই জানেন।
গাছ যে একটা চিন্তাশীল জীব তা কি বিজ্ঞানীরা জানেন?
অবশ্যই জানেন। জগদীশচন্দ্র বসু বের করে গেছেন।
তা হলে বলো গাছের মস্তিষ্ক কোনটি। একটা গাছ তাঁর চিন্তার কাজটি কীভাবে করে।
আমি জানি না, তবে আমি নিশ্চিত উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা জানেন।
কাঁচকলা। কেউ কিছু জানে না।
বিরক্ত করবে না, ঘুমুতে দাও।
সৃষ্টিরহস্য বোঝার ব্যাপারে তোমরা গাছের কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর না কেন? আমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেই তো আমরা সাহায্য করতে পারি।
তোমরা সাহায্য করতে পার?
অবশ্যই পারি। আমাদের পাতাগুলি অসম্ভব শক্তিশালী অ্যান্টেনা। এই অ্যান্টেনার সাহায্যে আমরা এই বিপুল সৃষ্টিজগতের সব বৃক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি।
তাই নাকি?
মনে করো সিরাস নক্ষত্রপুঞ্জের একটা গ্রহে গাছ আছে। আমরা সেই গাছের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। আমরা সেই গাছ থেকে তোমাদের জন্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য এনে দিতে পারি।
বাহ, ভালো তো!
পৃথিবীর মানুষরা অমর হতে চায়। কিন্তু অমরত্বের কৌশল জানে না। এই অ্যাড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জেই একটা গ্ৰহ আছে যার অতি উন্নত প্রাণীরা অমরত্বের কৌশল জেনে গেছে। তোমরা চাইলেই আমরা তোমাদের তা দিতে পারি।
শুনে অত্যন্ত প্ৰীত হলাম।
তুমি কি চাও?
না, আমি চাই না। আমি যথাসময়ে মরে যেতে চাই হাজার হাজার বছর বেঁচে থেকে কী হবে?
তুমি চাইলে আমি তোমাকে বলতে পারি।
না, আমি চাচ্ছি না। স্বপ্নে প্ৰাপ্ত কোনো ঔষধের আমার প্রয়োজন নেই। তুমি যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এখন বিদেয় হও। ভালো কথা, তোমার নাম কী?
আমার নাম টরমেনালিয়া বেরোরিকা।
এমন অদ্ভুত নাম।
এটা বৈজ্ঞানিক নাম–সহজ নাম বহেরা। আমরা কিন্তু অদ্ভূত গাছ। শালবনের ফাঁকে গজাই এবং লম্বায় শালগাছকেও ছাড়িয়ে যাই। আমাদের বাকলের রঙ কী বলো তো? বলতে পারলে না। আমাদের বাকলের রঙ নীল। আচ্ছা যাও, আর বিরক্ত করব না। এখন ঘুমাও।
আমার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে-আগে। জেগে উঠে দেখি সত্যি সত্যি একটা বহেরা গাছের নিচেই শুয়ে আছি। গাছভরতি ডিমের মতো ফুল। আমি খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে–আমি শুয়েছিলাম শালগাছের নিচে। শালের ফুল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঢাকায় যেতে হবে পায়ে হেঁটে। সেটা খুব খারাপ হবে না। শীতকালে হাঁটার আলাদা আনন্দ। তবে ঢাকায় কতক্ষণে পৌছোব কে জানে। মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা করা দরকার। দেখাটা আজ রাতেও হতে পারে। এক কাপ চা খাওয়া দরকার। বনের ভেতর কে আমাকে চা খাওয়াবো! আমি গলা উচিয়ে বললাম, আমার চারদিকে যেসব গাছ-ভাইরা আছেন তাদের বলছি। আমার খুব চায়ের তৃষ্ণ হচ্ছে। আমি আপনাদের অতিথি–আপনারা কি আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারেন?
প্রশ্নটা করেই আমি চুপ করে গেলাম। উত্তরের জন্যে কান পেতে রইলাম। উত্তর পাওয়া গেল না, তবে কয়েক মুহুর্তের জন্যে আমার মনে হচ্ছিল। গাছরা উত্তর দেবে।
দরজায় কোনো কলিংবেল নেই
দরজায় কোনো কলিংবেল নেই।
পুরোনো সন্টাইলে কড়া নাড়তে হর। প্রথমবার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে শ্লেষ্মাজড়ানো গলায় জবাব এল-কে? আমি চুপ করে রইলাম। প্রথমবারের কে-তে জবাব দিতে নেই। দ্বিতীয়বারে জবাব দিতে হয়। এই তথ্য আমার মামার বাড়িতে শেখা। ছোটমামা বলেছিলেন–
বুঝলি হিমু, প্রথম ডাকে কখনো জবাব দিবি না। খবৰ্দার না! তুই হয়তো ঘুমুচ্ছিস, নিশুতিরাতে বাইরে থেকে কেউ ডাকল-হিমু তুই বললি, জি? তা হলেই সর্বনাশ! মানুষ ডাকলে সর্বনাশ না। মানুষ ছাড়া অন্য কেউ ডাকলে সর্বনাশ। বাঁধা পড়ে যাবি। তোকে ডেকে বাইরে নিয়ে যাবে। এর নাম নিশির ডাক। কাজেই সহজ বুদ্ধি হচ্ছে–যে-ই ডাকুক প্রথমবারে সাড়া দিবি না। চুপ করে থাকবি। দ্বিতীয়বারে সাড়া দিবি। মনে থাকবে?
আমার মনে আছে বলেই প্ৰথমবারে জবাব না দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যে অপেক্ষা করতে বললাম। আমার কড়া নাড়লাম যাতে মিসির আলি সাহেব দ্বিতীয়বার বলেন–কে? আমি আমার পরিচয় দিতে পারি।
মিসির আলি দ্বিতীয়বার কে বললেন না। দরজা খুলে বাইরে তাকালেন। খুব যে কৌতূহলী হয়ে তাকালেন তাও না। রাত একটার আগন্তুকের দিকে যতটুকু কৌতূহল নিয়ে তাকাতে হয় সে-কৌতূহলও তার চোখে নেই। পরনে লুঙ্গি। খালিগায়ে সাদা চাদর জড়ানো। ভদ্রলোকের মাথাভরতি কাঁচাপাকা চুল। আমি ভেবেছিলাম টেকোমাথার কাউকে দেখব। আইনস্টাইন-মার্ক এত চুল ভাবিনি। আমি বললাম, স্যার স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আমার নাম হিমু।
আচ্ছা।
আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে পারি?
মিসির আলি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি আগের মতো কৌতূহলশূন্য। তিনি কি বিরক্ত? বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক কি ঘুম থেকে উঠে এসেছেন? না বোধহয়। ঘুমন্ত মানুষ প্রথমবার কড়া নাড়তেই কে বলে সাড়া দেবে না।