জি আচ্ছা।
আমি নিচে নেমে দেখি ফুপুর মাথায় পানি ঢালাঢালি শেষ হয়েছে। তিনি গম্ভীরমুখে বসে আছে। আমি দরজা খুলে রাস্তায় চুপিচুপি নেমে যাব। ফুপু গম্ভীর গলায় বললেন, এই হিমু, শুনে যা। আমি পরিচয় করিয়ে দি, এ হচ্ছে সাদেক। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। আমার দূর সম্পর্কের ভাই হয়। ভয়ংকর কাজের ছেলে। মানহানির মামলা ঠুকতে বলেছিলাম, এখন মামলা সাজিয়েছে। কাল মামলা দায়ের করা হবে, তারপর দেখবি কত গমে কত আটা। সাদেক, তুমি হিমুকে মামলার ব্যাপারটা বলো।
সাদেক বিরক্তমুখে বললেন, ওনাকে শুনিয়ে কী হবে?
আহা, শোনাও-না! হিমু আমাদের নিজেদের লোক। মামলাটা কী সাজানো হয়েছে সে শুনুক, কোনো সাজেশন থাকলে দিক। এই হিমু, বসে ভালো করে শোন। সাদেক তুমি গুছিয়ে বলো।
সাদেক সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, শুধু মানহানি মামলা তো তেমন জোরলো হয়। না। সাথে আরও কিছু অ্যাড করেছি।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম,কী অ্যাড করেছেন?
সাদেক সাহেব ভারি গলায় বললেন, অ্যাড করেছি—কনেপক্ষ ভাড়াটে গুণ্ডার সহায়তায় কোনোরকম পূর্বউস্কানি ছাড়া ধারালো অস্ত্রশস্ত্র, যেমন লোহার রড, কিরিচসহ বরযাত্রীদের উপর আচমকা চড়াও হয়। বরযাত্রীদের দ্রব্যসামগ্ৰী, যেমন মানিব্যাগ, রিস্টওয়াচ লুণ্ঠন করে। মহিলাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পূর্বপরিকল্পিত এই আক্রমণে বরসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়। তাহারা বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছে। বরযাত্রীদের দুটি গাড়িরও প্রভূত ক্ষতিসাধন করা হয়। একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই আর কি! সব ডিটেল দেয়া হবে।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, বলেন কী!
সাদেক সাহেব তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, সাজানো মামলা অরিজিনালের চেয়েও কঠিন হয়। অরিজিনাল মামলায় আসামি প্রায়ই খালাস পেয়ে যায়। সাজানো মামলায় কখনো পায় না। কথা হলো এভিডেন্স ঠিকমতো প্লেস করতে হবে।
এভিডেন্স পাবেন কোথায়?
বাংলাদেশে এভিডেন্স কোনো সমস্যা না। মার খেয়ে পা ভেঙেছে চান? পা-ভাঙা লোক পাবেন। X-Ray রিপোর্ট পাবেন। রেডিওলজিক্টের সাটিফিকেট পাবেন। টাকা খরচ করলে দুনম্বরি জিনিস সবই পাওয়া যায়।
বড় ফুপ বললেন, টাকা আমি খরচ করব। জোঁকের মুখে আমি নুন ছেড়ে দেব। সাদেক মামলা শক্ত করার জন্য তোমার যা যা করা লাগে করো। দরকার হলে আমি আমার গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে বলব ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে।
তা লাগবে না। পুরানো গাড়ির দোকান থেকে ভাঙা একটা গাড়ি এনে আগুন লাগিয়ে দিলেই হবে। তবে গাড়ির ব্লু বুক লাগবে। এটা অবিশ্যি কোনো ব্যাপার না।
ফুপু তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি থাকায় ভরসা পচ্ছি। ওদের আমি তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ব।
সাদেক সাহেব বললেন, বাদলকে একটু দরকার। ওকে ব্যাক ডেট দিয়ে একটা ভাল ক্লিনিকে ভরতি করিয়ে দিতে হবে। মার খাবার পর মাথায় আঘাত পেয়ে আন্ডার অবজারভেশনে আছে। এটা প্রমাণ করার জন্যে দরকার। কিছু এক্সরে-টেক্সরে করা দরকার।
ফুপু উজ্জ্বলমুখে বললেন, তুমি অপেক্ষা করো। বাদল আসুক। আজই তাকে ক্লিনিকে ভরতি করিয়ে দেব। মাছ দেখেছে বড়শি দেখেনি।
ফুপু প্ৰবল উৎসাহে মামলার সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে সাদেক সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আমি নাকটা ঝেড়ে আসি ফুপু বলে বের হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও হলাম। সাদেক সাহেব ভয়াবহ ব্যক্তি! আমি উপস্থিত থাকলে পা-ভাঙা ফারিয়াদি হিসেবে আমাকেও হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিতে পারে। মামলা আরও পোক্ত করার জন্যে মুগুর দিয়ে পা ভেঙে ফেলাও বিচিত্র না।
পথে নেমেই মোফাজ্জল এবং জহিরুলের সঙ্গে দেখা। ওরা ঘোরাঘুরি করছে। আমাকে দেখে অকুলে কুল পাওয়ার মতো ছুটে এল–হিমু ভাইয়া না?
হুঁ।
স্যারের বাসাটা ভুলে গেছি। স্যার আসতে বলেছিলেন।
এই বাড়ি। বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন না। গেট দিয়ে সোজা ছাদে চলে যান।
স্যারের শরীর কেমন হিমু ভাইয়া?
শরীর ভাল।
ফেরেশতার মতো আদমি। ওনার মতো মানুষ হয় না। সারের জন্যে একটা পাঞ্জাবি এনেছি।
খুব ভালো করেছেন। দাড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। চলে যান।
তারা গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল।
রাত দশটার মতো বাজে। মীরাদের বাড়িতে একবার উঁকি দিয়ে যাব কিনা ভাবছি। মীরা ফিরেছে কিনা দেখে যাওয়া দরকার।
মীরার বাবা ঘরের বাইরে বারান্দায় বসে আছেন। আমাকে দেখে উঠে এলেন। আমি বললাম, মীরা এখনও ফেরেনি?
তিনি হাহাকার-মেশানো গলায় বললেন, জি না।
চিন্তা করবেন না, চলে আসবে। এখন মাত্র দশটা চল্লিশ। বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকে চলে আসবে।
ভদ্রলোক অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন। তিনি এখন পুরোপরি বিভ্রান্ত। আমি আবারও পথে নোমলাম।
ঘ্যাস করে গা-ঘেষে গাড়ি থেমেছে
গা-ঘেষে কোনো গাড়ি যদি হার্ডব্রেক করে তা হলে চমকে ওঠাই নিয়ম। শুধু চমকে ওঠা না, চমকে পেছন ফিরতে হবে। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি মাঝেমধ্যেই হই। রূপা এই কাণ্ডটা সবচে বেশি করে। গাড়ি নিয়ে হুট করে গা-ঘেষে দাঁড়াবে, এবং বিকট শব্দে হর্ন দেবে। ভেতরে ভেতরে চমকালেও বাইরে প্রকাশ করি না। কিছুই ঘটেনি ভঙ্গিতে হঠতে থাকে যতক্ষণ গাড়ির ভেতর থেকে চেঁচিয়ে কেউ না ডাকে।
এবারও তা-ই করলাম। ঘ্যাস করে গা-ঘেষে গাড়ি থেমেছে। হৰ্ণ দেয়া হচ্ছে। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনে এগুচ্ছি।
হিমু সাহেব। এই যে হিমু সাহেব!
আমি তাকালাম। স্টিয়ারিং হুইল ধরে অপরিচিত একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার মাথায় ইরানি মেয়েদের মতো রঙিন ঝলমলে স্কার্ফ। মেয়েটিকে দেখাচ্ছেও ইরানিদের মতো।