জি। মীরার মা সারাজীবন আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। এখনও করছে?
ওনার নাম কী?
ইয়াসমিন।
উনি কি সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলেন, না প্ল্যানচেটের মাধ্যমে তাকে আনতে হয়।
তিনি নিচুগলায় বললেন শুরুতে প্লানচেট আনতাম। এখন নিজেই আসে। যা বলার সরাসরি বলে।
তাকে চোখে দেখতে পান?
সবসময় পাইনা–হঠাৎ হঠাৎ দেখা পাই। আপনি বোধহয় আমার কোনো কথা বিশ্বাস করছেন না। অবিশ্বাসের একটা হাসি আপনার ঠোঁটে।
আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করছি। আমি তো মিসির আলি না যে সব কথা অবিশ্বাস করব। আমি হচ্ছি হিমু। হিমুর মূলমন্ত্র হচ্ছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূরে।
মিসির আলি কে?
আছেন একজন। তার মূলমন্ত্র হচ্ছে তর্কে মিলায় বস্তু, বিশ্বাসে বহুদূর। তার ধারণা— জীবনটা অঙ্কের মতো। একের সঙ্গে এক যোগ করলে সবসময় দুই হবে। কখনো তিন হবে না।
তিন কি হয়?
অবশ্যই হয়–আপনার বেলায় তো হয়ে গেল। আপনি এবং মীরা–এক এক দুই হবার কথা। আপনার বেলায় হচ্ছে তিন। মীরার মা কোথেকে যেন উপস্থিত হচ্ছেন।
আপনি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। চা খাবেন?
চা কে বানাবে, মীরা তো বাসায় নেই।
চা আমিই বানাব। ঘর-সংসারের কাজ সব আমিই করি। চা বানানো, রান্না–সব করতে পারি। মোগলাই ডিশও পারি।
আপনার কোনো কাজের লোক নেই?
না।
নেই কেন? মীরার মা পছন্দ করেন না?
জি না। আপনি ঠিক ধরেছেন।
কোনো কাজের মানুষের সাহায্য ছাড়া মেয়েকে বোড় করতে আপনার কোনো সমস্যা হয়নি?
সমস্যা তো হয়েছেই। তবে ইয়াসমিন আমাকে সাহায্য করেছে। যেমন ধরুন মেয়ে রাতে কথা ভিজিয়ে ফেলেছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না, ঘুমে অচেতন। ইয়াসমিন আমাকে ডেকে তুলে বলবে–মেয়ে ভেজা কাথায় শুয়ে আছে।
বাহ, ভালো তো।
মীরার একবার খুব অসুখ হলো। কিছু খেতে পারে না, যা খায় বমি করে ফেলে দেয়—শরীরে প্রবল জ্বর। ডাক্তাররা কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, জ্বর সারছে না। তখন ইয়াসমিন এসে বলল, তুমি মেয়েকে অষুধ খাওয়ানো বন্ধ করো। কাগজিলেবুর শরবত ছাড়া কিছু খাওয়াবে না।
আপনি তা-ই করলেন?
প্ৰথম দিকে করতে চাইনি ভরসা পাচ্ছিলাম না–কারণ মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ। তাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। এরকম একজন রোগীর অষুধপত্র বন্ধ করে দেয়াটা কঠিন কাজ।
অর্থাৎ আপনি আপনার স্ত্রীর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি?
জি করেছি। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। মেয়ের অবস্থা আরও যখন খারাপ হলো তখন প্রায় মরিয়া হয়েই ওষুধপত্র বন্ধ করে লেবুর শরবত খাওয়াতে শুরু করলাম। দুদিনের মাথায় মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল।
এরকম ভূত-ডাক্তার ঘরে থাকাতো খুব ভালো।
দয়া করে আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোনো রসিকতা করবেন না। আমি এমিতেই রসিকতা পছন্দ করি না। স্ত্রীকে নিয়ে রসিকতা একেবারেই পছন্দ করি না। চা খাবেন কি না তা তো বলেননি।
চা খাব।
আশরাফুজ্জামান সাহেব চা আনতে গেলেন। সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। পুরো রাত আমার সামনে পড়ে আছে। আশরাফুজ্জামান সাহেব চা বানাতে থাকুন, আর আমি বসে। বসে গুছিয়ে ফেলি। রাতে কী কী করব। অনেকগুলি কাজ জমে আছে।
ক) আঁখি নামের মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। যোগাযোগ করতে হবে। টেলিফোন করলেই ওপাশ থেকে পোঁ-পোঁ শব্দ হয়। বাদল কি টেলিফোন নাম্বারা ভুল এনেছে?
খ) বড় ফুপু জরুরি খবর পাঠিয়েছেন। আমার মনে হয় আঁখিসংক্রান্ত বিষয়েই আলাপ করতে চান।
গ) এক পীরের সন্ধান পাওয়া গেছে— নাম ময়লা-বাবা। সারা গায়ে ময়লা মেখে বসে থাকেন। তার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার।
ঘ) মিসির আলি সাহেবের ঠিকানা পাওয়া গেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা। উনি কথা বলবেন কি না কে জানো যুক্তিসঙ্গত কারণ উপস্থিত না করলে উনি কথা বলবেন বলে মনে হয় না। এই ধরনের মানুষরা যুক্তির বাইরে পা দেন না। তারা জানেন অ্যান্টিলজিক হচ্ছে লজিকেরই উলটো পিঠ।
হিমু সাহেব!
জি?
আপনার চা নিন। চায়ে আপনি ক’চামচ চিনি খান?
যে যত চামচ দেয় তত চামচই খাই। আমার কোনোকিছুতেই কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই।
আমি এক চামচ চিনি দিয়েছি।
খুব ভালো করেছেন। এবং চা অসাধারণ হয়েছে— গরম মশল্লা দিয়েছেন নাকি?
সামান্য দিয়েছি–এক দানা এলাচ, এক চিমটি জাফরান। ফ্লেভারের জন্যে দেয়া।
খুব ভালো করেছেন।
আমার স্ত্রী চা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত। কমলালেবুর খোসা শুকিয়ে রেখে দিত। মাঝে মাঝে চায়ে সামান্য কমলালেবুর খোসা দিয়ে দিত। অসাধারণ টেষ্ট। কমলালেবুর শুকানো খোসা আমার কাছে আছে, একদিন আপনাকে খাওয়াব।
জি আচ্ছ। একটা কথা-আপনার স্ত্রী কি এই বাড়িতেই থাকেন, মানে ভূত হবার পর আপনার সঙ্গেই আছেন?
ইয়াসমিন প্রসঙ্গে ভূত-প্ৰেত এই জাতীয় শব্দ দয়া করে ব্যবহার করবেন না।
জি আচ্ছ, করব না। উনি কি এখন আশেপাশেই আছেন?
হ্যাঁ।
তার উপস্থিতি আপনি বুঝতে পারেন?
পারি।
আমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
আপনি কথা বললে সে শুনবে। সে আপনার সঙ্গে কথা বলবে কি না তা তো জানি না। সে মীরার সঙ্গেই কথা বলে না। মীরা তার নিজের মেয়ে।
আমি আপনার স্ত্রীকে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম। কীভাবে বলব? বাতি নিভিয়ে বলতে হবে?
বাতি নেভাতে হবে না। যা বলার বলুন, সে শুনবে।
সম্বোধন করব কী বলে? ভাবি ডাকব?
হিমু সাহেব, আপনি পুরো ব্যাপারটা খুব হালকাভাবে নেবার চেষ্টা করছেন। এটা ঠিক না। আমার স্ত্রীকে আপনার যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে জিজ্ঞেস করুন। আমি তার কাছ থেকে জবাব এনে দিচ্ছি।