আমার বাবা মহাপুরুষ তৈরির কারখানার চিফ ইনজিনিয়ার সাহেব যদিও আমাকে বলেছেন ভয়কে পাশ না-কাটাতে, তবুও আমি ভয়কে পাশ কাটাচ্ছি। সব ভয়কে না–বিশেষ একটা ভয়কে। আচ্ছা, ঘটনাটা বলি।
আমার তারিখ মনে নেই। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হতে পারে। শীত তেমন নেই। আমার গায়ে সুতির একটা চান্দর। কানো ঠাণ্ডা লাগছিল বলে চাদরটা মাথার উপর পেঁচিয়ে দিয়েছি। আমি বের হয়েছি পূর্ণিমা দেখতে। শহরের পূর্ণিমার অন্যরকম আবেদন। সোডিয়াম-ল্যাম্পের হলুদ আলোর সঙ্গে মেশে চাঁদের ঠাণ্ডা আলো। এই মিশ্র আলোর আলাদা মজা। তার উপর যদি কুয়াশা হয় তা হলে তো কথাই নেই। কুয়াশায় চাঁদের আলো চারদিকে ছড়ায়। সোডিয়াম-ল্যাম্পের আলো ছড়ায় না। মিশ্র আলোর একটি ছড়িয়ে যাচ্ছে, অন্যটি ছড়াচ্ছে না-খুবই ইন্টারেষ্টিং!
সে-রাতে সামান্য কুয়াশাও ছিল। মনের আনন্দেই আমি শহরে ঘুরছি। পূর্ণিমার রাতে লোকজন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা সত্যি। অল্প কিছু মানুষ সারারাত জাগে। তারা ঘুমাতে যায়। চাঁদ ডোবার পরে।
ইংরেজিতে এই ধরনের মানুষদের একটা নাম আছে Moon struck, এরা চন্দ্ৰাহত। এদের চলাফেরায় ঘোর-লাগা ভাব থাকে। এরা কথা বলে অন্যরকম স্বরে। এরা কিন্তু ভুলেও চাঁদের দিকে তাকায় না। বলা হয়ে থাকে চন্দ্ৰাহত মানুষদের চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ে না। এদের যখন আমি দেখি তখন তাদের ছায়ার দিকে আগে তাকাই।
অনেকক্ষণ রাস্তায় হঁটেলাম। একসময় মনে হল সোডিয়াম-ল্যাম্পের অ্যালো বাদ দিয়ে জোছনা দেখা যাক। কোনো একটা গলিতে ঢুকে পড়ি। দুটা রিকশা পাশাপাশি যেতে পারে না। এমন একটা গলি। খুব ভালো হয় যদি অন্ধ গলি হয়। আগে থেকে জানা থাকলে হবে না। হাঁটতে হাঁটতে শেষ মাথায় চলে যাবার পর হঠাৎ দেখব পথ নেই। সেখানে সোডিয়াম ল্যাম্প থাকবে না-শুধুই জোছনা।
ঢুকে পড়লাম একটা গলিতে। ঢাকা শহরের মাঝখানেই এই গলি। গলির নাম বলতে চাচ্ছি না। আমি চাচ্ছি না কৌতুহলী কেউ সেই গলি খুঁজে বের করুক। কিছুদূর এগুতেই কয়েকটা কুকুর চোখে পড়ল। এরা রাস্তার মাঝখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল—আমাকে দেখে সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সব মিলিয়ে চারটা কুকুর। কুকুরদের স্বভাব হচ্ছে সন্দেহজনক কাউকে দেখলে একসঙ্গে ঘেউঘেউ করে ওঠা। ভয় দেখানোর চেষ্টা। এরা তা করল না। এদের একজন সামান্য একটু এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। বাকি তিনজন তার পেছনে। সামনের কুকুরটা কি ওদের দলপতিঃ লিডারশিপ ব্যাপারটা কুকুরদের আদি গোত্র নেকড়েদের মধ্যে আছে। কুকুরদের নেই। তবে সামনের কুকুরটাকে লিডার বলেই মনে হচ্ছে-। আমি ভাবি জমাবার জন্য বললাম, তারপর তোমাদের খবর কী? জোছনা কুকুরদের খুব প্রিয় হয় বলে শুনেছি, তোমাদের এই অবস্থা কেন? মনমরা হয়ে শুয়ে আছ? Is anything wrong?
কুকুরদের শরীর শক্ত হয়ে গেল। এরা কেউ লেজ নাড়ছে না। কুকুর প্রচণ্ড রেগে গেলে লেজ নাড়া বন্ধ করে দেয়। লক্ষণ ভালো না।
এদের অনুমতি না নিয়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়া ঠিক হবে না। কাজেই বিনয়ী গলায় বললাম, যেতে পারি?
আমার ভাষা না বুঝলেও গলার স্বরের বিনয়ী অংশ বুঝতে পারার কথা। অধিকাংশ পশুই তা বোঝে।
এরা নড়ল না। অর্থাৎ এরা চায় না। আমি আর এগুই। তখন একটা কাণ্ড হল- আমি স্পষ্টই শুনলাম কেউ একজন আমাকে বলছে- তুমি চলে যাও। জায়গাটা ভালো তা— তুমি চলে যাও। চলে যাও!
অবচেতন মনের কোনো খেলা? কোনো কারণে আমি নিজেই গলিতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি বলে আমার অবচেতন মন আমাকে চলে যেতে বলছে? না, ব্যাপারটা তা না। আমি তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলেই গলির ভেতর ঢুকতে চাচ্ছি। আমাকে গলির ভেতরের জোছনা দেখতে হবে। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে। আমি কোনো দুর্বল মনের মানুষ না যে অবচেতন মন আমাকে নিয়ে খেলবে। আর যদি খেলেও থাকে সেই খেলাকে প্রশ্ৰয় দেওয়া যায় না। ধরে নিলাম। অবচেতন মনই আমাকে চলে যেতে বলছে–অবচেতন মনকে শোনানোর জন্যেই স্পষ্ট করে বললাম, আমার এই গলিতে ঢোকা অত্যন্ত জরুরি। কুকুরগুলি একসঙ্গে আমাকে কামড়ে না ধরলে আমি অবশ্যই যাব।
তখন একটা কাণ্ড হল। সবকটা কুকুর একসঙ্গে পেছনের দিকে ফিরল। দলপতি কুকুরটা এগিয়ে গিয়ে দলপতির আসন নিল। তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেও সামান্য পরিবর্তন লক্ষ করলাম। পরিবর্তনটা কী বোঝার চেষ্টা করছি তখন অস্পষ্টভাবে লাঠির ঠিকঠাক আওয়াজ কানে এল। লাঠি-হাতে কেউ কি আসছে? গ্রামের মানুষ সাপের ভয়ে লাঠি ঠকঠক করে যেভাবে পথে ইহঁটে তেমন করে কেউ একজন হাঁটছে। পাকা রাস্তায় লাঠির শব্দ। কুকুরদের শ্রবণেন্দ্ৰিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, তারা কি শব্দের মধ্যে বিশেষ কিছু পাচ্ছে? এদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা গেল। অস্থিরতা সংক্রামক। আমার মধ্যেও সেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। আর তখনই আমি জিনিসটা দেখলাম। লাঠি ঠিকঠক করে একজন মানুষ আসছে। তাকে মানুষ বলছি কেন? সে কি সত্যি মানুষ? সে কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়াল। চারটা কুকুর একসঙ্গে ডেকে উঠে থেমে গেল। তারা একটু পিছিয়ে গেল।
আমি দেখলাম রাস্তার ঠিক মাঝখানে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখ, নাক, মুখ, কান কিছুই নেই। ঘাড়ের উপর যা আছে তা একদলা হলুদ মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু না। সেই মাংসপিণ্ডটা চোখ ছাড়াও আমাকে দেখতে পেল, সে লাঠিটা আমার দিকে উঁচু করল। আমি দ্বিতীয় যে,–ব্যাপারটা লক্ষ করলাম তা হচ্ছে চাদের আলোয় লাঠিটার ছায়া পড়েছে, কিন্তু মানুষটার কোনো ছায়া পড়ে নি। ধক করে নাকে পচা মাংসের গন্ধ পেলাম। বিকট সেই গন্ধ। পাকস্থলী উলটে আসার উপক্রম হল।