তোর সঙ্গেই কথা বলেনি, আমার সঙ্গে কি আর বলবে?
তোমার সঙ্গে বলবে–কারণ তুমি হচ্ছ হিমু।
টেলিফোন করে কী বলবি?
বাদল চুপ করে রইল। আমি হাসিমুখে বললাম, তুই নিশ্চয়ই চাস না–কেমন আছ, ভালো আছি-টাইপ কথা বলে রিসিভার রেখে দি? মেয়েটাকে আমি কী বলব সেটা বলে দে।
তোমার যা ইচ্ছা তা-ই বলো।
আমি কি বলব–আঁখি শোনো, মগবাজার কাজি অফিস চেন? এক কাজ করো–রিকশা করে কাজি অফিসে চলে আসো। আমি বাদলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি এলে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেব। কোনো সমস্যা নেই।
বাদল মাথা নিচু করে ফেলল। মনে হচ্ছে সে খুবই লজ্জা পাচ্ছে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, তুমি আসতে বললে আঁখি চলে আসবে।
তোর তা-ই ধারণা?
হ্যাঁ।
তুই কিন্তু ভালোই বোকা।
আমি বোকা হই যা-ই হই তুমি হচ্ছে হিমু। তুমি যা বলবে তা-ই হবে।
আচ্ছা পরীক্ষা হয়ে যাক-আমি আঁখিকে আস্তে বলি বলব?
বাদল প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, বলো।
বেশ কয়েকবার টেলিফোন করা হলো। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরছে না। বাদল শুকনোমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাদলকে দেখে খুবই মায়া লাগছে। মায়া লাগলেও কিছু করার নেই। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে প্রতি পদেপদে মায়াকে তুচ্ছ করতে হয়।
সন্তানপ্রসবজনিত জটিলতায় স্ত্রীবিয়োগ
কোনো ভদ্রলোকের যদি বিয়ের দুবছরের মাথায় সন্তানপ্রসবজনিত জটিলতায় স্ত্রীবিয়োগ হয়, তিনি যদি আর বিয়ে না করেন এবং বাকি জীবন কাটিয়ে দেন সন্তানকে বড় করার জটিল কাজে তখন তার ভেতর নানান সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যার মূল কারণ অপরাধবোধ। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে তিনি নিজেকে দায়ী করেন। সন্তানের জন্ম না হলে স্ত্রী মারা যেত না। সন্তানের জন্মের জন্যে তাঁর ভূমিকা আছে। এই তথ্য তার মাথায় ঢুকে যায়। মাতৃহারা সন্তানকে মাতৃস্নেহবঞ্চিত করার জন্যেও তিনি নিজেকে দায়ী করেন। তার নিজের নিঃসঙ্গতার জন্যেও তিনি নিজেকে দায়ী করেন। তিনি সংসারে বেঁচে থাকেন অপরাধীর মতো। যতই দিন যায়। তার আচার, আচরণ, জীবনযাপন পদ্ধতি ততই অসংলগ্ন হতে থাকে। স্ত্রী জীবিত অবস্থায় তাকে যতটা ভালোবাসতেন, মৃত্যুর পর তারচে অনেক বেশি ভালোবাসতে শুরু করেন। সেই ভালোবাসাটা চলে যায় অসুস্থ পর্যায়ে।
আশরাফুজ্জামান সাহেবকে দেখে আমার তা-ই মনে হলো। মীরার বাবার নাম আশরাফুজ্জামান। একসময় কলেজে শিক্ষক ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়ে দেন। এটাই স্বাভাবিক। অস্থিরতায় আক্রান্ত একটা মানুষ স্থায়ীভাবে কিছু করতে পারে। না। বাকি জীবনে তিনি অনেককিছু করার চেষ্টা করেছেন–ইনসিউরেন্স কোম্পানির কাজ, ট্র্যাভেলিং এজেন্সির চাকরি থেকে ইনডেনটিং ব্যবসা, টুকটাক ব্যবসা সবই করা হয়েছে। এখন কিছু করছেন না। পৈতৃক বাড়ি ভাড়া দিয়ে সেই টাকায় সংসার চালাচ্ছেন। সংসারে দুটিমাত্র মানুষ থাকায় তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের প্রচুর অবসর। এই অবসরের সবটাই কাটাচ্ছেন মৃত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পদ্ধতি উদ্ভাবনে। ভদ্রলোক খুব রোগী। বড় বড় চোখ। চোখের দৃষ্টিতে ভরসা-হারানো ভাব। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই বয়সে মাথায় কাচাপাকা চুল থাকার কথা। তার মাথার সব চুলই পাকা। ধবধবে সাদা চুলে ভদ্রলোকের মধ্যে ঋষি-ঋষি ভােব চলে এসেছে। তার গলার স্বর খুব মিষ্টি। কথা বলার সময় একটু বুকে কাছে আসেন। তার হাত খুবই সরু। মৃত মানুষের হাতের মতো— বিবর্ণ। কথা বলার সময় গায়ে হাত দেয়ার অভ্যাসও তার আছে। তিনি যতবারই গায়ে হাত দিয়েছেন, আমি ততবারই চমকে উঠেছি।
আপনার নাম হিমু? জি।
মানিব্যাগ নিয়ে রাতে আপনি যখন এসেছিলেন তখন আপনার চেহারা একরকম ছিল— এখন অন্যরকম।
আমি বললাম, তাজমহল দিনের একেক আলোয় একেক রকম দেখা যায়— মানুষ তো তাজমহলের চেয়েও অনেক উন্নত শিল্পকর্ম, মানুষের চেহারাও বদলানোর কথা।
আমার ধারণা ছিল, আপনি মানুষ না।
এখন কী ধারণা, আমি মানুষ?
আশরাফুজ্জামান সাহেব সরুচোখে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখমুখে একধরনের অস্বস্তি। মনে হচ্ছে তিনি আমার ব্যা ব্যাপারে এখনও সংশয়মুক্ত না। আমি হাসিমুখে বললাম, একদিন দিনের বেলা এসে আপনাকে দেখাব–রোদে দাঁড়ালে আমার ছায়া পড়ে।
আশরাফুজ্জামান সাহেব নিচুগলায় বললেন, মানুষ না, কিন্তু মানুষের মতো জীবদেরও ছায়া পড়ে।
তা-ই নাকি?
জি। এরা মানুষদের মধ্যেই বাস করে।
ও আচ্ছা।
আমি অনেককিছু জানি, কিন্তু কাউকে মন খুলে বলতে পারি না। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না–পাগল ভাববে। মীরাকেও আমি তেমনকিছু বলি না।
আমাকে বলতে চাচ্ছেন?
জি না।
বলতে চাইলে বলতে পারেন।
আচ্ছা, আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয় আমি অসুস্থা?
না, তা মনে হচ্ছে না।
মীরার ধারনা আমি অসুস্থ। যতই দিন যাচ্ছে ততই তার ধারণা প্রবল হচ্ছে। অথচ আমি জানি আমি খুবই সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। আমার অস্বাভাবিকতা বলতে এইটুকু যে মীরার মার সঙ্গে আমার দেখা হয়, কথাবার্তা হয়।
তা-ই বুঝি?
জি। মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। আমি খুবই আপসেট হয়ে বাসায় এসেছি। আমি মোটামুটিভাবে দরিদ্র মানুষ–এতগুলি টাকা! মীরাকে খবরটা দিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছি–তখন মীরার মার সঙ্গে আমার কথা হলো। সে বলল, তুমি মনখারাপ কোরো না, টাকা আজ রাতেই ফেরত পাবে। আমি মীরাকে বললাম, সে হেসেই উড়িয়ে দিল।
হেসে উড়িয়ে দেয়াটা ঠিক হয়নি। টাকা তো সেই রাতেই ফেরত পেয়েছিলেন। তা-ই না?